বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

পবিত্র হজ

| প্রকাশের সময় : ২০ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০২ এএম

স্মরণ কালের ভয়াবহ তাপদাহের মধ্যেই এবার হজ কাফেলায় শামিল হয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ২০ লাখের অধিক আল্লাহর মেহমান। নানা দেশ, ভাষা, বর্ণ ও সংস্কৃতির লাখো মানুষ মহান স্রষ্টা ও পালনকর্তা আল্লাহর প্রেমে আপ্লুত হয়ে এত উষ্ণ আবহাওয়া ও সকল কষ্ট উপেক্ষা করে পালন করছেন হৃদয়ের গহীনস্পর্শী এ ফরজ ইবাদত। হজ ইসলামের পাঁচটি ভিত্তির একটি। আরবী হজ শব্দের অর্থ ও মর্ম খুবই ব্যাপক এবং বিস্তৃত। শব্দার্থের দিক দিয়ে হজ হলো, কোনো কাজের ইচ্ছা করা বা দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করা। বৈয়াকরনিক ইমাম খলীলের ভাষায়, হজ অর্থ কোনো মহৎ ও বিরাট কাজের জন্য বারবার ইচ্ছা ও সংকল্প করা। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় হজ হলো, আল্লাহর ঘরের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে কতকগুলো বিশেষ ও নির্দিষ্ট কাজের মাধ্যমে আল্লাহর ঘরের জিয়ারতের সংকল্প করা। পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক বলেছেন, আল্লাহরই জন্য লোকদের কর্তব্য হলো, আল্লাহর ঘরের হজ করা-সে লোকের জন্য যার সেই পর্যন্ত যাতায়াতের সামর্থ্য আছে। রাসূলে করিম (সা.) হজ ফরজ হওয়ার বিষয়টি ঘোষণা করে বলেছেন, আল্লাহর ঘরের হজ আদায় করো যদি সেখানে যাতায়াতের সামর্থ্য তোমাদের থাকে। হজ, বলাই বাহুল্য, সুপ্রাচীন কাল থেকে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এর সঙ্গে আদি মানব-মানবী হযরত আদম (আ.) ও মা হাওয়া (আ.), হযরত ইব্রাহীম (আ.), হযরত হাজেরা (আ.), হযরত ইসমাঈল (আ.) ও মহানবী (সা.)-এর স্মৃতি জড়িয়ে আছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম যে গৃহ নির্মিত হয় তা তো বাক্কায় (মক্কায়), তা বরকতময় ও বিশ্বজগতের দিশারী। এই গৃহ নির্মাণ করেছিলেন হযরত আদম (আ.)। পরবর্তীকালে হযরত ইব্রাহীম (আ.) তা পুননির্মাণ করেন। কাবাগৃহের ১২ কিলোমিটার দূরে আরাফাত ময়দান। এই ময়দানে হযরত আদম (আ.)-এর সঙ্গে হযরত হাওয়া (আ.)-এর পুনর্মিলন হয়। স্বীয় ভুলের জন্য তিনি আল্লাহর দরবারে তওবা ও মোনাজাত করেন এবং সে মোনাজাত কবুল হয়। হাজীদের এই আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করতে হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আরাফাতই তো হজ। যে ব্যক্তি মুজদালিফায় যাপন করা রাতের ফজরের নামাজের পূর্বে এখানে এসে পৌঁছবে, তার হজ পূর্ণ হয়ে গেল। আরাফাত ময়দানে জাবালে রহমত অবস্থিত। এই পর্বতের ওপরে দাঁড়িয়ে মহানবী (সা.) বিদায় হজের ভাষণ দেন। খানায়ে কাবা থেকে মিনার দূরত্ব কয়েক কিলোমিটার। এ প্রান্তরে হজের আগে ও হজের পরে তাঁবুতে অবস্থান করতে হয়। মিনা প্রান্তরে রয়েছে মসজিদে খায়েফ, যেখানে আদিকাল থেকে মহানবী (সা.) পর্যন্ত বহু নবী রাসূল ইবাদত-বন্দেগী করেছেন।
হজ সম্পাদনে হাজীদের সুনির্দিষ্ট ও নির্ধারিত কিছু কাজ করতে হয়। এগুলো হলো খানায়ে কাবা তাওয়াফ করা। সহজ ও সম্ভব হলে রুকনে ইয়ামানি স্পর্শ ও হজরে আসওয়াদ চুম্বন করা, মাকামে ইব্রাহীমে নামাজ পড়া, সাফা ও মারওয়ায় সাঈ করা, মিনায় গমন করা, মুজদালিফায় অবস্থান করা, কঙ্কর নিক্ষেপ করা, কোরবানি আদায় করা, মাথা মুন্ডন বা চুল ছাঁটা, তাওয়াফে জিয়ারত আদায় করা, বিদায়ী তাওয়াফ সম্পন্ন করা। এসব করার মাধ্যমে হজের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। আরাফাতের পথে হাজীরা ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্নিয়ামাতা লাকা ওয়ারমুলক লা শারিকা লাকা’ পড়তে থাকেন। এটা মূলত হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর হজের দাওয়াতেরই জবাব। মক্কায় হজ সম্পন্ন করার পর হাজীরা মদীনায় রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর রওজা জিয়ারতে যান। এটা সুন্নাত। রাসূল (সা.) বলেছেন, যে হজ করল কিন্তু আমার রওজা জিয়ারত করল না, সে আমার প্রতি জুলুম করল। তিনি আরো বলেছেন, যে আমার রওজা জিয়ারত করল, তার জন্য আমার শাফায়াত ওয়াজিব হয়ে গেল। মদীনায় অবস্থানকালে হাজীদের প্রথম ও প্রধান কাজ হলো, মসজিদে নববীতে হাজিরা দেয়া এবং সম্ভব হলে সেখানে ৪০ ওয়াক্ত নামাজ পড়া। মসজিদে নববীতে এক রাকাত নামাজের সওয়াব ৫০ হাজার রাকাত নামাজের সমান। হজের এসব ইবাদতের মূল্য কত অপরিসীম, সহজেই তা বোঝা যায়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি হজ করে, আর তাতে কোনোরূপ অশ্লীল ও অন্যায় আচরণ করে না, তার পূর্ববতী গোনাসমূহ মাফ করে দেয়া হয়। হজের ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক দিক ছাড়াও আরো নানা দিক রয়েছে। হজ বিশ্ব মুসলিমের এক মিলনমেলা। সারাবিশ্বের মুসলমানগণ একই পোশাক পরে, লাব্বাইক ধ্বনি উচ্চারণ করে, একই অবস্থানে অবস্থান করে মহান আল্লাহর রেজামন্দি লাভের জন্য কাতরভাবে প্রার্থনা জানায়। তাদের দেহ-মনে থাকে ক্ষমা ও মুক্তিলাভের বাসনা। তাদের প্রার্থনা, কাতরোক্তি এতই গ্রহণযোগ্য হয় যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাদের সমুদয় গোনাখাতা মাফ করে দেন। মানুষের জন্য এর চেয়ে বড় খোশখবর আর কিছু হতে পারে না।
হজ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত নানা বর্ণ, গোত্র, ভাষার মানুষের মধ্যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধি করে। পরস্পরকে জানার এর চেয়ে বড় সুযোগ আর কোনো বিশ্ব সম্মেলনে সম্ভব নয়। হজ ব্যবস্থাপনার এ বিশাল খিদমত সউদী সরকার আঞ্জাম দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা করা বিশ্বের সকল মুসলিম দেশের দায়িত্ব। হজ অনুষ্ঠান ও হাজীদের নিরাপত্তায় কোন আপোস করা যাবে না। প্রয়োজনে এ বিষয়ে সম্মিলিত শক্তি নিয়ে মুসলিম জাহানকে এগিয়ে আসতে হবে। সউদী আরব হজ ব্যবস্থাপনায় যখনই যে সহযোগিতা চাইবে মুসলিম বিশ্ব তা দিতে দেরি করবে না। অবশ্য সউদী আরবকেও দায়িত্ব নিতে হবে হজের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক রূপ এবং ভাবমর্যাদা ধরে রাখতে। যেন এটি কেবল অর্থ আয়ের একটি পথ বলেই গণ্য না হতে পারে। এমনিতেই আল্লাহর ঘর ও মসজিদে নববীর বরকতে সারা বছর কোটি কোটি জিয়ারতকারী সে দেশে যান। ওমরা ও হজযাত্রীসহ সউদী আরবগামী মানুষ যে অর্থনৈতিক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেন তাতেই সউদী আরব বিশাল উপকার পেতে পারে। ভবিষ্যতে কখনোই রুক্ষভাবে অর্থ আয়ের টার্গেট যেন নেয়া না হয়, কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি সে দিকে রাখতে হবে। প্রসঙ্গত বাংলাদেশ থেকে যাওয়া লক্ষাধিক হজযাত্রীর কথাও বলে রাখা কর্তব্য। যাদের কয়েক’শ শেষ পর্যন্ত হজেই যেতে পারেননি। যাদের অবহেলা বা অন্যায়ে এরা এমন দুঃখ পেলেন তাদের বিচার করা সরকারের দায়িত্ব। হজে গিয়েও দুরাচারী এজেন্সিগুলোর অত্যাচার সইছেন অনেকে। এ অব্যবস্থাপনার হেতু খুঁজে বের করা সরকারের কাজ। সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় সমন্বিত বৈঠক করে সমস্যার মূল উৎসগুলো খুঁজে বের করাই সমাধানের পথ। মধ্যস্বত্বভোগী দালাল শ্রেণির খপপর থেকে হজ্জযাত্রীদের মুক্ত করে গোটা ব্যবস্থাপনাটি যদি সরকার নিজের হাতে নিয়ে নেয় আর বেসরকারি হজ্জ এজেন্সিগুলোকে অংশীজন হিসেবে কঠোর তদারকীর ভেতর রেখে কাজে লাগায় তাহলে হজ্জ ব্যবস্থাপনা সুন্দর ও নিবিঘর্œ হতে পারে। পরিশেষে, হজ আল্লাহপাকের ক্ষমা, করুণা ও নৈকট্য লাভের অছিলা হোক, বিশ্ব মুসলিমের ঐক্য-সংহতি ও সৌভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধিতে কার্যকর ভূমিকা রাখুক, আমরা একান্তভাবে এই কামনাই করি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন