শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

হজ্বঃ বিশ্ব মুসলিমের সেতু বন্ধন

গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির | প্রকাশের সময় : ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১২:০২ এএম

হজ¦ শব্দটি আরবী, যার অর্থ ইচ্ছা করা, সংকল্প করা, মহান বস্তুর আশা পোষন করা ইত্যাদি। শরীয়তের পরিভাষায় ইসলামের মহান একটি রুকন আদায় করার নিমিত্ত সম্মানার্থে পবিত্র কাবা ঘরে যাওয়ার ইচ্ছা পোষন করাকে হজ¦ বলা হয়। হজ্বের আভিধানিক অর্থ কোন স্থান পরিদর্শনের সংকল্প করা। ইসলামের পরিভাষায় নিদ্দিষ্ট দিনগুলোর পবিত্র কাবাঘর ও নিদিষ্ট কয়েকটি সম্মানিত স্থানে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশ অনুসারে অবস্থান করা, যিয়ারত করা ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করা। মোট কথা, হজ¦ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে কাবা পরিদর্শন। সঙ্গতি সম্পন্ন প্রত্যেক মুসলমানের জন্য পৃথিবীর প্রথম উপাসনালয় কাবা শরীফে তাওয়াফ এবং মদিনা মনোয়ারা জিয়ারত অবশ্য কর্তব্য। হজ্বের প্রথম তাৎপর্য হচ্ছে, এটি সমগ্র বিশ্ব মুসলিমের এমন এক মহা সমাবেশ যেখানে সমগ্র বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের, বিভিন্ন বর্ণের, ভাষা এবং আকার- আকৃতির মানুষ একই ধরনের পোশাকে সজ্জিত হয়ে একই কেন্দ্র বিন্দুতে এসে সমবেত হন। সকলেরই লক্ষ্য বিশ্ব মানবের প্রথম উপাসনা কেন্দ্র কাবার জেয়ারত, সবার মুখে একই ভাষার একটি মাত্র কথা “ লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক” যার বাংলা অর্থ- হাজির হয়েছি ওগো আল্লাহুম্মা! হাজির হয়েছি! এসেছি, তোমার ডাকে সাড়া দেওয়ারজন্য এসেছি। আমার সকল কিছু তোমার কাছে সমর্পণ করতে এসেছি। তাই বলতে হয়, হজ্বের এ সফরে অন্য কোন উদ্দেশ্য নয়, কোনো লক্ষ্য নয়, কোনো পার্থিব স্বার্থের আকর্ষন নয়, শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি, আল্লাহর নির্দেশে সমগ্র বিশ্বমানবকে আপন করে পাওয়ার আকুতিটুকুই একান্ত কাম্য হয়ে দাঁড়ায়। আর এভাবেই হৃদয়ের গভীরে অঙ্কুরিত হয় বিশ্ব মুসলিমের ঐক্যের সেতু বন্ধন।
দ্বিতীয়তঃ হজ্বের এ মহাসমাবেশে সমগ্র বিশ্বমানব এমনই একটি কেন্দ্র বিন্দুতে এসে সমবেত হন, যা মানব জাতির প্রথম আবাসস্থল। “উম্মুল কোরা’’ মক্কা নগরীতেই যে আদি মানব হযরত আদম (আঃ) প্রথম বসতি স্থাপন করেছিলেন এ তথ্য সন্দেহাতীত। সে আদি বসতির মধ্যেই এক আল্লাহর এবাদত আরাধনার লক্ষ্যে স্থাপিত প্রথম গৃহ পবিত্র বাইতুল্লাহ, এ তথ্যও পবিত্র কোরআনে পরিবেশিত হয়েছে। বর্ণিত আছে, হযরত আদম (আঃ) “উম্মুল কোরা” পবিত্র মক্কায় স্থিত হওয়ার পর মোনাজাত বা প্রার্থনা করেছিলেন। ঊর্দ্ধজগতে ফেরেশতাগণের উপাসনাস্থল বাইতুল মামুরের অনুরূপ একখানা উপাসনালয় পাওয়ার জন্য। আল্লাহপাক সে প্রার্থনা মঞ্জুর করেই ফেরেশতা জিব্রাঈল (আঃ) মারফতে বাইতুল মামুরের সঠিক বরাবরেই মাটির উপর পবিত্র কাবাঘর নির্মাণের স্থান নির্দেশ করেন। এ ঘরের যে চৌহদ্দিটুকু “হেরেম” বা পবিত্রতার সীমারেখায় চিহ্নিত সেটুকুও ফেরেশতার মাধ্যমেই আল্লাহপাক দেখিয়ে দিয়েছিলেন। ইতিহাসের সে প্রথম গৃহে মানব সন্তানের জন্য সৃষ্ট প্রথম এবাদতগাহ বা উপাসনালয়ে আদি মানবের বাৎসরিক এ মহা সমাবেশে যে আবেগময় অনুভূতি সৃষ্টি করে সে অনুভূতি সমগ্র বিশ্ব মানব তথা আদি সন্তানের একই রক্তের উত্তরাধিকার এবং আত্মীয়তার অবিচ্ছেদ্য সেতু বন্ধনকেই নবায়িত করার অনুভূতি। পবিত্র কোরআনে এও বর্ণিত আছে, আমাদের আদি পিতা-মাতা প্রথম যেখানে সেজদা করেছিলেন সৃষ্টিকর্তা মহান প্রভুর উদ্দেশ্যে। তাঁর এবাদতের লক্ষ্যেই গড়ে তোলা হয়েছিল সে ঘরটি। সুতরাং সে ঘরের প্রতি একটা আবেগপূর্ণ আর্কষন প্রতি মানব সন্তানের মন-মস্তিষ্কে সুপ্ত হয়ে থাকাটা স্বাভাবিক।
হজ্বের বাৎসরিক সমাবেশ সে ঘরের জেয়ারত, সে ঘরের তাওয়াফ, স্মরনীয় সে ময়দানে গিয়ে অবস্থান যেখানে দীর্ঘ বিরহ- যাতনা ভোগ করার পর আমাদের প্রথম পিতা-মাতা এসে পুনমিলিত হয়েছিলেন, প্রাণভরে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার সুযোগ লাভ করেছিলেন। মুক্তি এবং শান্তিধারা প্রাপ্তির আশ্বাস প্রাপ্ত হয়ে পূর্ণ প্রশান্তিতে রাত যাপন করেছিলেন। কয়েক দিনের হজ্বের সফর প্রতিটি হজ্বযাত্রীকে নিয়ে যায় মানুষের এ জন্ম প্রবাহ শুরুর সেই আদি দিনগুলোতে। আজকের ভাষা, বর্ণ ও ভৌগোলিক সীমারেখা কন্টকিত মানুষগুলো যখন কিছু দিনের জন্য সেই আদি মানবের সহজ-সরল পোশাক মাত্র দু টুকরো কাপড় পরিধান করে হজ্বের অনুষ্ঠানগুলো পালন করেন, তখন তার মধ্যে যে উপলব্দি জন্ম হয়, সেটা সকল মানুষের প্রতি বন্ধু প্রতিম মমত্ববোধ ছাড়া আর কি হতে পারে। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে হজ্ব অন্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবাদত। শারীরিক, মানসিক এবং আর্থিক দিক দিয়ে সামর্থ্যবান লোকজন হজ্ব করতে যাবেন এটাই প্রত্যাশিত। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গে বাংলাদেশ থেকেও কয়েক হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলমান মক্কা শরীফে হজ্ব ও মদীনা শরীফ জেয়ারত করতে যান। হজ্বের প্রধান শিক্ষাই হচ্ছে সমগ্র বিশ্ব মানবের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য এক ভ্রাতৃত্ববোধ এবং সেতু বন্ধন তৈরী করা এবং ঐক্য গড়ে তোলার জন্য ব্রতী হওয়া। হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ হজ্বের ভাষণের মধ্যে এ শিক্ষাই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বের সঙ্গে প্রদান করেছেন এবং উদাত্তকন্ঠে তিনি আহবান জানিয়ে বলেছিলেন- “লোক সকল, তোমাদের সকলের প্রভু এক, তোমাদের সকলের আদি পিতাও এক ব্যক্তি। সুতরাং কোনো আরব অনারবের উপর, কোনো কৃষ্ণকায় শ্বেতাঙ্গের উপর কিংবা কোনো কৃষ্ণকায়ের উপর কোনো শ্বেতাঙ্গের জন্মগত কোনো প্রাধান্য নেই। সম্মান যোগ্য হবে সে ব্যক্তি যে একনিষ্ঠ খোদাভীরু। মনে রেখো, প্রত্যেক মুসলমান একে অন্যের ভাই, আর বিশ্বের সকল জনগোষ্ঠী মিলে এক মহাজাতি। হজ্বের মধ্যে উদ্দেশ্যের ঐক্য, পোষাকের ঐক্য, ভাষার ঐক্য এবং লক্ষ্যের ঐক্য বজায় রাখার তাগিদ এবং তৎসহ মূল লক্ষ্য ব্যাহত হওয়ার মত সবকিছু থেকে দূরে থাকার তাগিদ ও কোরআনে সুষ্পষ্ট ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। যেমন “হজ্বের সফরে অশোভন বা কেনো অন্যায় আচরণ আর ঝগড়া বিবাদ যেন না হয়।’ হাদীস শরীফের ভাষায়- “তোমরা পরস্পর বিদ্ধেষ পোষণ করো না, একে অন্যের মর্যাদা হানির চেষ্টা করো না। অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ো না। আল্লাহর সকল অনুগত ব্যক্তি মিলে ভাই -ভাই হয়ে বাস করো।
হজ্বের উল্লেখযোগ্য দুটি অনুষ্ঠান কোরবানি ও সাফা- মারওয়ার সায়ী। হযরত ইসমাইল ও তার পুন্যবর্তী মা হাজেরার দুটো পূর্ণ স্মৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। মহান পিতা-পুত্র হযরত ইব্রাহিস এবং ইসমাইলের অপূর্ব ত্যাগ-তিতিক্ষার পরীক্ষা সমাপ্ত হওয়ার পর আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁদেরকে বাইতুল্লাহ শরীফ পূনঃ নির্মাণ করার নির্দেশ দেন। কাবা ঘরের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হওয়ার পর হযরত ইব্রাহিমের প্রতি নির্দেশ হয়, সারা বিশ্বে হজ্বের ঘোষণা প্রচার করার। তাঁকে আশ্বাস দেওয়া হল, ‘‘ঘোষণা প্রচার করা তোমার কাজ আর কিয়ামত পর্যন্ত ভক্তজনের হৃদয় কন্দরে সে ঘোষণা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমার। হযরত ইব্রাহিমের সে ঘোষণার যেসব বাক্য হাদীস শরীফ থেকে জানা যায় তাতে দেখা যাচ্ছে, কোনো বিশেষ দেশ, অঞ্চল বা জনগোষ্ঠীর প্রতি তাঁর সে আহবান ছিল না, এ আহবান ছিল সমগ্র মানব জাতির জন্য। মোট কথা, যে কোনো দিক থেকেই বিচার করা হোক না কেন হজ্ব এমন একটা আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান যার বিকল্প আর কোনো কিছু কল্পনাও করা যায় না। বিশ্বে এমন আর একটা অনুষ্ঠান খুঁজে পাওয়া যাবে না, যার মধ্যে বর্ণ, ভাষা ও জাতীয়তা নির্বিশেষে পৃথিবীর সকল এলাকার সব ধরণের মানুষ এমন একমুখী এবং একাত্ম হওয়ার সুযোগ পায়।
মানুষের অন্তরে তার জন্মগত ঐক্যের অনুভূতি দৃঢ়তর করার উদ্দেশ্যেই পারস্পরিক কতগুলো প্রক্রিয়া অত্যাবশক করে দেওয়া হয়েছে। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত মসজিদে সমবেত হওয়া, সপ্তাহে জুম্মার দিন এবং বছরে দু’বার বৃহত্তম সমাবেশ দুই ঈদের জামাতে গিয়ে হাজির হওয়া আবশ্যক। হজ্বের সর্ববৃহৎ সমাবেশ সে ধরনের একটা বিশ্ব সম্মেলন। এ সম্মেলনের জামাতে দাঁড় করাতে। তাই বিশ্বজনীন এ অবিচ্ছেদ্য ভ্রাতৃত্ববোধের শিক্ষাই হচ্ছে হজ্বের প্রধান শিক্ষা। আমরা কামনা করি এবারের হজ্ব যেন বিশ্ব মুসলিমের জন্য সেতু বন্ধন তথা একতা, ঐক্য ও সহযোগীতামূলক হয়। আর এ শিক্ষায় যদি আমরা উজ্জীবিত হতে পারি তাহলেই সফল হব আমরা। আল্লাহ তায়ালা যেন আমাদের সবাইকে হজে¦ তাৎপর্য ও গুরুত্ব অনুধাবন করে সঠিক ভাবে হজ¦ পালনের তাওফিক দান করেন। আল্লাহ হাফেজ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন