শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য টুটুল : দিন দিন পরিবারের মানুষের মাঝে বিরাজমান আত্মিক বন্ধন ভেঙে যাচ্ছে। কেউ কাউকে মানতে চায় না। সবাই মনে করে আমার চেয়ে বড় আর কে আছে। আমিই সবার বড়। মানুষের এই আকাক্সক্ষা সব শুভ বিষয়-আশয় দূরে ঠেলে দিচ্ছে। তার মধ্যে নেশার বেড়াজালে পড়ে আমাদের যুব সমাজের একটা অংশ এতোটাই বিপথগামী হয়েছে যে, এর মূল্য দিতে হচ্ছে পরিবারের লোকজনকে। যন্ত্রণায় অতীষ্ঠ হয়ে পরিবারের লোকজনও নেশাগ্রস্ত সন্তান কিংবা ভাই-ভাতিজাকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে আজ বাধ্য হচ্ছে। আমরাতো এমন কথাও শুনে থাকি কিংবা পত্রপত্রিকার সংবাদে দেখেছি, নেশাগ্রস্ত ভাই তার বড় ভাইয়ের কাছে নেশার টাকা না পেয়ে খুন করার হুমকি দিয়েছে। ভাই বলেছে, তোকে আর কত টাকা দেব? আমার পক্ষে তোকে দিনে এক হাজার টাকা দেয়া সম্ভব নয়। তুই যা পারিস তাই করিস। শেষে গর্ভধারিণী মা সবকিছু জেনে নেশাগ্রস্ত ছেলেকে হত্যা করে বলেছেন, খারাপ ছেলেটাকে মেরে ভাল ছেলেকে রক্ষা করলাম। আমরা যখন জানবো এক মা তার নেশাগ্রস্ত ছেলের জ্বালায় বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত তাকে মেরে ফেলেছেন, তখনতো আমরা সহজেই বুঝে নিতে পারবো নৈতিক অবক্ষয় আমাদের সমাজ ব্যবস্থাকে কোথায় নিয়ে গেছে। একশ্রেণীর লোভী মানুষ নিজেদের স্বার্থের জন্য নেশার সামগ্রী দিয়ে বাজার ভরে দিচ্ছে। যেন আমাদের আগামী প্রজন্মের একটা অংশ একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়। যেন তারা মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একজন বিদ্যালয়ের শিক্ষক নেশার টাকা না পেয়ে তার পিতাকে খুন করেছেন। ঘাতক পুত্র প্রাথমিক স্কুলের সহকারী শিক্ষক ছাত্র অবস্থায় নেশার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। তিনি এই নেশাগ্রস্ততার জন্য ঠিকমতো লেখাপড়া করতে পারেননি। প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকের চাকরি পাওয়ার পরও তিনি নেশাকে না বলতে পারেননি অর্থাৎ মাদকদ্রব্য পরিত্যাগ করতে পারেননি। স্কুল চলাকালীন সময়েও অভিযুক্ত ওই শিক্ষক নেশায় বিভোর হয়ে থাকতেন। যার জন্য সংশ্লিষ্ট স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকরা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে। ওই শিক্ষককে অভিভাবকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অন্যত্র বদলি করা হলেও তিনি তার নতুন কর্মস্থলেও ঠিকমতো শিক্ষকতা করতে পারতেন না। সেখানেও তিনি নেশার মাঝে ডুবে থাকতেন। মাদক নেয়ার জন্য প্রথম স্ত্রীর সাথে তার ছাড়াছাড়ি হয়। দ্বিতীয় স্ত্রীও আলাদা থাকেন। মাদকাসক্ত শিক্ষক পরিবারের লোকজন এমনকি তার বাবার কাছে নেশার জন্য টাকা চাইতেন। বাবা টাকা দিতে অস্বীকার করলে প্রথমে সে প্রতিবেশীর ওপর হামলা চালায়। শেষে পিতাকে ঘরের দুয়ার বন্ধ করে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে আহত করে। পরিবারের লোকজন পিতাকে উদ্ধারের জন্য পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ এসে ওই শিক্ষকের হাত থেকে পিতাকে উদ্ধার করে। নেশাগ্রস্ত শিক্ষক পুলিশের ওপরও হামলা করে এবং পুলিশও আহত হয়। শিক্ষকের পিতাকে প্রথমে বাজিতপুর জহিরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। পরে অবস্থার অবনতি হলে সেখান থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলে তিনি মারা যান।
আমরা যদি প্রতিবেদনটি বিচার-বিশ্লেষণ করতে যাই তাহলে একটি বিষয়ে সবাই একমত হবো যে, আমাদের পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা যেমন একটা শিক্ষককে স্বাভাবিক শিক্ষক বানাতে পারছে না তেমনি করে এই পুঁজিবাদ পুত্রের হাত থেকে পিতাকেও নিরাপদ রাখতে পারছে না। আজকাল পত্রপত্রিকা খুললেই আমরা দেখতে পাই ইয়াবা-গাঁজাসহ বড় বড় মাদক সামগ্রীর চালান পুলিশ, র্যাবসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ছে। বলা হয়ে থাকে, চোরাই পথে আসা মাদকদ্রব্যের খুব ক্ষুদ্রতম অংশই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে থাকে। বেশিরভাগই থেকে যায় অধরা অবস্থায়। এই অধরা অবস্থায় থাকা মাদকদ্রব্য আমাদের উদীয়মান প্রজন্মকে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। বলা হয়ে থাকে, এসব মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত পর্দার অন্তরালে থাকা রাঘববোয়ালরা কখনোই ধরা পড়ে না। তারা কখনো অর্থাৎ মূল মাদক ব্যবসায়ীরা সামনে আসে না। তাদের পরিচয় জানার চেষ্টাও কেউ করে না। অনেকেই মনে করেন, এসব রাঘববোয়াল এতোই ক্ষমতাশালী যে, তাদের পর্দার ভিতর থেকে জনসমুদ্রে টেনে আনতে গেলে দেখা দেবে বিপত্তি। যারা এই মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকেন তাদের জন্য বিপদ-আপদের আশংকা আরও বেড়ে যাবে। মাদকের চালান বহন করার ব্যাপারে যেসব ব্যক্তির কথাবার্তা এবং চেহারা আমরা পত্রপত্রিকায় দেখে থাকি কিংবা লোক মুখে শুনে থাকি তাতে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। সমাজে এমন সব ব্যক্তি তা বহন করে থাকে যা ভাবতে গেলেই আমাদের ভাবনার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। আমরা দেশবাসী বেশি কিছু চাই না। আমরা চাই আমাদের সন্তানরা থাকুক দুধে-ভাতে। আমরা চাই আমাদের সন্তানরা যেন বিপথগামী না হয়। কেউতো আর মায়ের পেট থেকে মাতাল হয়ে কিংবা মাদক ব্যবসায়ী হয়ে জন্মায় না কিংবা বলা যায় কোনো সন্তান তার মায়ের পেট থেকেই পিতার হত্যাকারী হয়ে জন্মায় না। তাকে এই চলমান সামাজিক অবক্ষয় সব শুভ দিক থেকে দূরে ঠেলে দেয়। একশ্রেণীর আত্মস্বার্থবাদী মানুষ আমাদের সন্তানদের কাছে নেশার সামগ্রী পৌঁছে দিয়ে তাদের রঙ্গীন স্বপ্ন দেখায়। সমাজ এবং রাষ্ট্রের একশ্রেণীর কর্তাব্যক্তি এ ব্যাপারে একেবারে নিশ্চুপ। তাদেরও লাভলোকসানের ব্যাপার আছে। অনেক সময় তারাও জড়িয়ে পড়েন অনৈতিক কাজে। আমরা যদি আগামী প্রজন্মকে নেশা থেকে মুক্ত করতে চাই তাহলে আমাদের প্রথম কাজটিই হবে দ্বিধাহীন চিত্তে সকল রাজনৈতিক মতবাদের ঊর্ধ্বে ওঠে ন্যায়-অন্যায়বোধকে সবার আগে স্থান দেয়া। তা-না হলে কিছুতেই সম্ভব হবে না সমাজের অবক্ষয় দূর করা। দেশের মানুষ ঠিক করে বলতে পারছে না কোথায় গেলে সকল অপকর্মের বিনাশ হবে। তাদের না বলতে পারার কারণ একশ্রেণীর মানুষ বিভিন্নভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। যখন মানুষ বিভ্রান্ত অবস্থায় থাকে তখন তার পক্ষে ভাল-মন্দের বিচার করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সবাইকে মনে রাখতে হবে, আমরা এমন একটি সমাজে বসবাস করে থাকি, যেখানে একজন শিক্ষক থেকে শুরু করে সবাই বসবাস করছেন ক্ষয়িষ্ণু নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন সামাজিক কাঠামোর মাঝে। চলমান সমাজ ব্যবস্থায় একজন মানুষ যতোই লেখাপড়া করে থাকুক না কেন, সে যে লেখাপড়া করে মানুষের মতো মানুষ হবে তার গ্যারান্টি কেউ দিতে পারে না। কেননা পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা যতোই সুন্দর স্বপ্ন দেখাক না কেন, তারপরও কিন্তু আমরা চলমান পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা থেকে কোনো শুভ মঙ্গল বার্তা আশা করতে পারি না। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা তার জন্মলগ্ন থেকেই শরীরে ক্যান্সারের জীবাণু নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। বর্তমান অবস্থায় একশ্রেণীর মানুষ আমাদের চাওয়া-পাওয়াকে এমন এক শূন্যতার মাঝে নিয়ে গেছে, যেখানে দাঁড়ালে ঝলমল করা শূন্যতায় পরিপূর্ণ স্বপ্নের হাতছানি ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। তারপরও কথা থাকে আর সেই কথা হলো, আমাদের আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে অবশ্যই সকল অন্যায়ের বিনাশ ঘটাতে হবে। শুধু গেল গেল বলে চিৎকার করে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকলে চলবে না। আমাদের প্রথম কাজটি হবে সকল অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং প্রতিরোধ গড়ে তুলেতে হলে শত্রুমিত্র চিহ্নিত করতে হবে। যারা এই সমাজ ও রাষ্ট্রের মানুষকে রসাতলে নিয়ে যাচ্ছে তাদেরকে সকল ক্ষেত্রে পরিত্যাগ করে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। যারা বাজারে চোরাই পথে মাদকদ্রব্য কিংবা নিষিদ্ধ পণ্যের আমদানি করে সবকিছু ধ্বংস করে দিতে চায় তারা নিশ্চয়ই ভাল মানুষ নয়। আবার যারা এসব নষ্ট মানুষদের সাহায্য করে তারাও আমাদের কাছের মানুষ নয়। তাই এই শ্রেণীর নষ্ট মানুষদের আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে চিরকালের জন্য সরাতে হবে। তাহলেই দেখা যাবে আমাদের আগামী প্রজন্ম মানুষের মতো মানুষ হয়ে আমাদের চারপাশে সুন্দরের বীজ রোপণ করছে।
লেখক : কবি, গল্পকার ও আইনজীবী
কালীবাড়ী রোড, হবিগঞ্জ।
*********
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন