মোঃ আবদুল লতিফ নেজামী
শিক্ষা জাতির মেরুদ-। জাতীয় ঐক্য ও সংহতির প্রধান উপকরণ। মেরুদ-হীন কোনো প্রাণী বা মানুষ যেমন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, তেমনি জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধর্মীয় চেতনা ও আদর্শের পটভূমিতে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া কোনো জাতিও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করার জন্য এযাবৎ বহু কমিশন, শিক্ষা সংস্কার কমিটি, অন্তর্বর্তীকালীন টাস্কফোর্স ও শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি গঠিত হয়েছে। কারণ এটা অনস্বীকার্য যে, কোনো নীতিই চিরকালীন, স্থির, অবিচল ব্যাপার হয় না। সময় ও অবস্থা এবং পরিবর্তিত পরিবেশ ও পরিস্থিতি বিবেচনায় অন্যান্য নীতির মতো শিক্ষানীতিতেও প্রয়োজনীয় রদবদল প্রয়োজন হয়। তাই ব্রিটিশ আমলে ১৯৩৯ সালে শেরেবাংলার ঘোষণা, পাকিস্তান আমলে ১৯৪৯ সালে শরীফ কমিশন, ১৯৫১ সালে আকরাম খাঁ কমিশন, ১৯৫৬ সালে আশরাফউদ্দিন চৌধুরী কমিটি, ১৯৫৭ সালে আতাউর রহমান খান কমিটি, ১৯৬৩ সালে মোয়াজ্জাম কমিশন, ১৯৬৬ সালে হামুদুর রহমান কমিশন, ১৯৬৯ সালে নুর খান কমিশন, ১৯৭০ সালে শিক্ষা কমিটি, বাংলাদেশ আমলে ১৯৭৪ সালে কুদরত-ই-খুদা কমিশন, ১৯৭৮ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন কমিটি, ১৯৭৯ সালে অন্তর্বর্তীকালীন শিক্ষা কমিটি, জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি ১৯৯৭, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০০, শিক্ষা সংস্কার কমিটি ২০০২, জাতীয় শিক্ষা কমিশন ২০০৩, জাতীয় শিক্ষা উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন কমিশন ২০০৯ গঠিত হয়। এসব কমিশন ও কমিটির সুপারিশ কখনো পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হয়নি।
বর্তমান সরকারও শিক্ষানীতি প্রণয়ন করার জন্য ২০০৯ সালে অধ্যাপক কবির চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি জাতীয় শিক্ষা উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন কমিটি গঠন করে। সেই কমিটির সদস্যদের অতিমাত্রায় ইহজাগতিকপ্রীতি ও ধর্মবিদ্বেষ সর্বজনবিদিত। তারা স্বজাতির শিক্ষাব্যবস্থাকে দেখেন ব্রাহ্মণ্যবাদী ও নাস্তিক্যবাদী প্রকরণে এবং তারা যে সা¤্রাজ্যবাদ, ইহুদিবাদ ও ব্রাহ্মণ্যবাদের বলয়াবৃত, তা তাদের কৃতকর্মে প্রতিফলিত। পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে বিভ্রান্ত বিশ^াসের অনুবর্তী এসব লোকের উপলব্ধিতে বিজাতীয় সম্প্রকাশ ঘটেছে। তাছাড়া শিক্ষানীতির ব্যাপারে সার্বিক সুপারিশ করার মতো অভিজ্ঞতালব্ধ এবং মতামত দেওয়ার ব্যাপারে যোগ্যতা রাখেন এমন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি এই কমিশনে রাখা হয়নি। তাছাড়া মাদ্রাসা শিক্ষা, ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের ধারক সর্বজনগ্রহণযোগ্য বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষাবিদদের সাথে শিক্ষানীতি নিয়ে আলোচনাও করা হয়নি। যাদের সাথে শলাপরামর্শ করা হয়েছে তারা প্রায় সবাই একই মতাদর্শে বিশ্বাসী। অর্থাৎ এ কমিটি বিশেষ মতের অনুসারী লোকদের নিয়ে গঠিত। তাই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চিন্তা-চেতনার পরিপন্থী একশ্রেণীর লোকদের নিয়ে গঠিত শিক্ষা কমিটি সম্পর্কে বিভিন্ন শিক্ষাবিদ, সমাজকর্মী ও সুধীজনদের পক্ষ থেকে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয় এবং বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।
জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনার চেয়ে ক্ষমতাসীনদের নিজস্ব রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রয়াস চালানো হচ্ছে বলে অবস্থাদৃষ্টে অনুমিত হচ্ছে। ইসলামী ভাবধারার মুসলিম লেখকদের প্রবন্ধ-নিবন্ধ, নাটক ও গল্প-কবিতার পরিবর্তে বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকে নাস্তিক্যবাদী ও ব্রাহ্মণ্যবাদী ভাবাদর্শের রচনা, গল্প, নাটক ও কবিতা প্রতিস্থাপন তারই প্রকৃষ্ট প্রমাণ। তাই বলা যায় যে, বর্তমান শিক্ষানীতির দার্শনিক ভিত্তি হচ্ছে ব্রাহ্মণ্যবাদী ও পতিত সমাজতান্ত্রিক চেতনা সৃষ্টি করা।
ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতিচ্ছায়ারূপী এসব ব্যক্তি এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ঈমান-আক্বিদা, বিশ^াস, মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বিনাশী প্রবন্ধ-নিবন্ধ স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় বাধ্যতামূলকভাবে পড়ানোর ব্যবস্থা করে শিক্ষার্থীদের মন থেকে সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসূলের (সা.)-এর প্রতি বিশ^াস দূরীভূত করার অপপ্রয়াস চালিয়েছেন।
যেমন দ্বিতীয় শ্রেণীতে আগে পড়ানো হতো ‘সবাই মিলে করি কাজ’ শিরোনামে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহানবীর (সা.) সংক্ষিপ্ত জীবন চরিত। তৃতীয় শ্রেণীর বইয়ে ইসলামের প্রথম খলিফা ‘খলিফা হযরত আবু বকর’ শিরোনামের সংক্ষিপ্ত জীবনী। চতুর্থ শ্রেণীতে দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা.)-এর জীবনী পড়ানোর ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু নতুন শিক্ষানীতির অধীনে প্রণীত পাঠ্যবই থেকে মহানবীর (সা.) এবং ইসলামের প্রথম ও দ্বিতীয় খলিফার জীবনী বাদ দেওয়া হয়েছে।
একইভাবে পঞ্চম শ্রেণীর পাঠ্যবই থেকে মহানবীর (সা.) জীবনী, কাজী কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষা গুরুর মর্যাদা’ শীর্ষক কবিতা, ‘শহীদ তিতুমীর’ নামক একটি জীবনীর পরিবর্তে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে হুমায়ুন আজাদ লিখিত ‘বই’ নামক একটি কবিতা, যা পবিত্র কোরআনবিরোধী বলে পরিচিত।
ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে ধর্মীয় শিক্ষণীয় ঘটনা সম্বলিত ড. শহীদ উল্লাহর ‘সততার পুরস্কার’ নামক একটি লেখা, কায়কোবাদের লেখা ‘প্রার্থনা’ কবিতা বাদ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে দেবী দুর্গার প্রশংসা সম্বলিত কবিতা ‘বাংলাদেশের হৃদয়’ এবং লালগরুটা নামক ছোট গল্প, যা গরুকে দেবতার আসনে বসানো হয়েছে। একই শ্রেণীতে পাঠ্য ‘নীলনদ আর পিরামিডের দেশ’ নামক একটি ভ্রমণ কাহিনীর পরিবর্তে ‘রাঁচির ভ্রমণ কাহিনী’ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
সপ্তম শ্রেণীর বই থেকে ‘মরু ভাস্কর’ নামক শেষ নবীর (সা.) জীবন চরিত বাদ দিয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে পাঁঠা বলি দেয়ার নিয়মকানুন সম্বলিত ‘লালু’ নামক একটি গল্প।
অষ্টম শ্রেণী থেকে ‘বাবরের মহত্ত্ব’ ও বেগম সুফিয়া কামালের লেখা ‘প্রার্থনা’ কবিতা বাদ দেওয়া হয়েছে। এর পরিবর্তে সংযোজন করা হযেছে ‘রামায়ণের সংক্ষিপ্ত কাহিনী’।
নবম-দশম শ্রেণীর জন্য লিখিত বই থেকে কবি শাহ মুহম্মদ সগীরের লেখা ‘বন্দনা’, কবি আলাওলের ‘হামদ’ ও আবদুল হাকিমের ‘বঙ্গবাণী’, ‘জীবন বিনিময়’ এবং কাজী নজরুল ইসলামের ‘ওমর ফারুক’ নামক কবিতা বাদ দেওয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে একই শ্রেণীর বইয়ে দেবী অন্নপূর্ণার প্রশংসা সম্বলিত মঙ্গল কাব্য ‘আমার সন্তান’, ‘সাঁকোটা দুলছে’ ও রাধা-কৃষ্ণের লীলা কীর্তন ‘সুখের লাগিয়া’ প্রভৃতি কবিতা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। ‘সাঁকোটা দুলছে’ কবিতাটি ৪৭-এর ভারত বিভক্তিকে হেয় করা হয়েছে। তাছাড়া ভারতের পর্যটন স্পট ‘পালামৌ’-এর ভ্রমণ কাহিনী এবং বাউলদের যৌনাচার সম্বলিত ‘সময় গেলে সাধন হবে না’ নামক বই নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে সংযোজন করা হয়েছে। উপরন্তু প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে পাঠ্য করা হয়েছে যৌন শিক্ষার বই ‘নিজেকে জানুন’।
আধিপত্যবাদীরা বাংলাদেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে তাদের আধিপত্য লিপ্সা চরিতার্থ করতে চায় তাদের এদেশীয় দোসরদের মাধ্যমে। বাংলাদেশ টেক্সট বুক বোর্ডের বইগুলোতে নাস্তিক্যবাদী, ব্রাহ্মণ্যবাদী ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তাচেতনা সম্বলিত প্রবন্ধ, গল্প ও কবিতার সংযোজন তারই সুস্পষ্ট নজির। আর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার পাঠ্যপুস্তক প্রণেতারাও যে আধিপত্যবাদী সংস্কৃতির অন্ধ অনুসারী তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই তারা দেশ-জাতি ও জনগণের স্বতন্ত্র জাতীয়তাবোধ, আদর্শ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, তাহযিব-তমদ্দুন, বিশ^াস ও মূল্যবোধ এবং সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের চেতনা বিধ্বংসী শিক্ষা আইন প্রণয়নে প্রবৃত্ত হয়েছেন। স্বকীয়তার চেতনাকে সঞ্জীবিত রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে স্বচেষ্ট ইসলামী শিক্ষা রহিতকরণের ষড়যন্ত্র, মূলত শিক্ষাকে বিধর্মীয়করণ প্রক্রিয়ারই ধারাবাহিকতা মাত্র। এই শিক্ষানীতি একপেশে, একমুখী, মূল্যবোধহীন, নৈতিকতাহীন ধর্ম এবং ইতিহাস-ঐতিহ্য বিরোধী। শিক্ষানীতিতে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের ইসলাম ধর্ম চর্চা থেকে সরিয়ে নৈতিকতা ও ব্রত চর্চয়ি উজ্জীবিত করার প্রয়াস লক্ষণীয়। ধর্ম ও মাদ্রাসা শিক্ষা সম্পর্কে শিক্ষা আইনে যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তা শুধু অনাকাক্সিক্ষত এবং চিরায়ত মূল্যবোধের সম্পূর্ণ পরিপন্থী নয়, বরং এদেশের জনগণের লালিত ও ধারণকৃত চেতনার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন