মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাহিত্য

শিশু সাহিত্যে নজরুল

শা হ রি য়া র সো হে ল | প্রকাশের সময় : ১২ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

শিশুরা ফুলেই মতই সুন্দর, নিষ্পাপ, পবিত্র। যিশু বলেছেন,‘যদি শিশুর মত সরল নিষ্পাপ হওয়া যায়, তা হলেই স্বর্গরাজ্য লাভ করা সম্ভব।’ এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, শিশু ভগবানের কতখানি প্রিয়! শিশু দেবোপম। এজন্য ইংরেজি বা য়ুরোপীয় সাহিত্য শিশুকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়। ইংরেজী বা য়ুরোপীয় শিশু সাহিত্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। সে তুলনায় বাংলায় শিশু সাহিত্য তেমন সমৃদ্ধ নয়। তবে যারা এগিয়ে এসেছিলেন এবং চমৎকারভাবে সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে শিশুদের মন জয় করেছিলেন, তাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে অন্যতম হলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি সাহিত্যের দু’কূল প্লাবিত করে শিশুদের জন্য লিখেছেন। আমাদের কাছে যা সর্বদাই মূল্যবান। কাজী নজরুল ইসলাম অত্যন্ত চমৎকারভাবে শিশুদেরকে উপলব্ধি করতেন। খুব সহজে মজা করে তিনি তাদের কাছে নিজের সাহিত্যকে উপস্থাপন করেছেন। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমি চির শিশু, চির কিশোর’। তাঁর মধ্যে একটা শিশু সুলভ সারল্য ছিল। শুধু তাই নয়, তার মন ছিল শিশুর প্রতি আশ্চর্য সংবেদনশীল। সেজন্য তিনি অতি সহজে শিশুদের সাথে একাত্ম হতে পেরেছেন এবং শিশুদের মনস্তত্ব অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছেন। তাই শিশুর স্বপ্ন, সাধ, আশা-আকাক্সক্ষা, কীর্তি-কলাপ, খেলা-ধুলা, ঠাট্টা-তামাশা, অনুকরণ প্রিয়তা, স্কুল জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা, মা-বাবার সাথে মান-অভিমান, বুড়ো দাদুকে নিয়ে হাস্যালাপ, ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্ন, কল্পনার রথে চড়ে দুঃসাহসিক অভিযান এসব তিনি নিবিড়ভাবে উপলব্ধি এবং সাহিত্যে সার্থক রূপদান করেছেন। শিশুদের প্রতি তার ভালবাসা ছিল একান্ত নিবিড়, হৃদয়ের গভীরতম ভালবাসা। নজরুল অনুভব করেছেন, শিশুর জগৎ মাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। তাই শিশুর সকল জিজ্ঞাসা, মান-অভিমান, আদর-আবদার মার কাছেই। আবার মার কাছেও শিশু যেন চির রহস্যময় এবং এই রহস্যের কোন অন্ত নেই। শিশু অবাক বিষ্ময়ে মাকে প্রশ্ন করে,

মাগো! আমায় বলতে পারিস
কোথায় ছিলাম আমি
কোন না জানা দেশ থেকে তোর
কোলে এলাম নামি ?

মাও শিশুকে ভালবেসে উত্তর দেয়
তুই যে আমার, এই ত সেদিন
আমার বুকে ছিলি!

কাজী নজরুল ইসলাম মা ও সন্তানের যে বিচিত্র, মধুর ও আন্তরিক সম্পর্ক, তা উজ্জ্বল রঙে ফুটিয়ে তুলেছেন। বাৎসল্য রসের চরম অভিব্যক্তি ফোটাতে পেরেছেন। শিশুকে ঘুম পাড়াবার জন্য যেমন ঘুম পাড়ানী গান লিখেছেন, তেমনি জাগরনী গীতও লিখেছেন ঃ

ভোর হলো দোর খেলো খুকুমনি ওঠরে
ঐ ডাকে জুঁই শাখে ফুলখুকী ছোটরে
খুকুমনি ওঠরে।

নজরুল উপলব্ধি করেছেন, শিশু-মন আশ্চর্য কল্পনা প্রবণ। তাই শিশু কল্পনার রথে চড়ে উড়ে যেতে চায় সূর্যিমামার আগে।

আমি হবো সকাল বেলার পাখী
সবার আগে কুসুম বাগে
উঠবো আমি ডাকি।
শিশু যাবে অচিন দেশে, তুহিন মেরু পার হয়ে, বরফ ঢাকা পাহাড় ডিঙিয়ে, হাওয়ায় চড়ে চাঁদের দেশে আর না হয় পাতালে। সমস্ত দুনিয়াকে সে হাতের মুঠোয় পেতে চায় ঃ

থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে
দেখবো এবার জগৎটাকে
কেমন করে ঘুরছে মানুষ
যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে

শিশুমন স্কুলে যেতে চায় না, এর অন্যতম কারণ শিক্ষকদের প্রতি ভীতি; এবং এ বিষয়টিও তিনি চমৎকারভাবে লিখেছেন :

সেথায় আবার থাকে
এক যে জুজু, গুরুমশাই বলে তাকে
নাকের ডগায় চশমা তাঁহার, মাথার ডগায় টিকি
হাতের ডগায় কঞ্চি বাঁশের, তাই দেখি আর লিখি

শিশুর দুরন্তপনার অবস্থাই এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। বস্তুত ‘লিচু চোরের’ মতো অভিনয় উপযোগী কবিতা বাংলা শিশু সাহিত্যে খুবই বিরল। এ কবিতার আবৃত্তি শুনে পাঠক বা দর্শক এক অনাবিল হাস্যরসে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। কবিতাটি নাটকীয় গুণে যথেষ্ট সমৃদ্ধ। নজরুল শিশুদের জন্যে শুধু ছড়া বা নাট্যধর্মী কবিতা রচনা করেন নি, নাটিকাও রচনা করেছেন। - যেমন: পুতুলের বিয়ে। শিশুদের জন্য এ নাটিকাটি খুব উপভোগ্য। বিয়ের সমস্যা শুধু বড়দের নয়, শিশুদেরও। ডালিম কুমারের কাহিনী নিয়ে এ নাটিকাটি রচিত। খুবই চমৎকার এবং হাস্যোদ্দীপক। পুরুত মশাই বিয়ে পড়াবার জন্য আসতে চায় না। তবু অর্থযোগে আনা হয়। তিনি ডালিম কুমারকে বিয়ের মন্ত্র পাঠ করতে বলেন ঃ

যদিদং অদয়ং তব
তদিদং হৃদয়ং মম।

যদি অনুস্বার বিসর্গ সংস্কৃত হয়, তবে মনিই বা বসে থাকবে কেন। সেও চীনে ফুচুংকে বিয়ের মন্ত্র পড়ায়ঃ

ওয়ানং মর্নং আই সেটং এ লেসং ম্যনিং
ক্লোজ টু মাই ফার্মং

কাজী নজরুল ইসলাম শিশুকে প্রাণ-মন দিয়ে ভালোবাসেন বলেই শিশুর প্রতি এই মাঙ্গলিক উচ্চারণ করেছেন। শিশুর প্রতি অন্তরের নিখাঁদ দরদ শিশু সাহিত্যকে করে তুলেছে আরও দেশী প্রাণস্পর্শী ও আবেগময়। ‘ঝিঙেফুল’ (১৯২৬), ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘পিলে পটকা’ (১৯৬৪), ‘সঞ্চয়ন’ (১৯৫৫), ‘পুতুলের বিয়ে’(১৯৬৪), ‘চয়নিকা’ ‘ঘুম পাড়ানী গান’(১৯৩৩), ইত্যাদি নাটিকা ও কবিতা। বাংলা ভাষায় শিশু সাহিত্য তার হাতে সত্যিকার অর্থে হয়ে উঠেছে সার্থক ও অনবদ্য। বাংলা ভাষায় শিশু সাহিত্য খুবই বিরল। তবু এর ভেতর থেকেও যারা সত্যিকার অর্থে হৃদয়ের দরদ দিয়ে শিশুদের প্রতি ভালবাসা জানিয়েছেন তিনি নজরুল, এক চমৎকার শিশু সাহিত্য নির্মাতা, ভবিষ্যৎ এর সঠিক দ্রষ্টা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন