কে.এস. সিদ্দিকী
মেরাজে ফেরেশতার আজান
মেরাজ রজনীতে নামাজ ফরজ হওয়ার ঘটনা বিখ্যাত। এ রাতে আসমানে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে ফেরেশতা প্রেরিত হয়েছিল তাকে আজান শেখানোর জন্য। বস্তুত আজানের মর্মবানীর প্রতি মনোনিবেশ করলে অনুধাবন করা যাবে যে, তাতে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব, তাওহিদের প্রতি সাক্ষ্য প্রদান, নামাজের প্রতি এবং কল্যাণের প্রতি আহ্বান রয়েছে এবং তার উম্মতের জন্য নামাজের সাথে আজানও উপহার প্রদান করা হয়। সুতরাং আজানের মর্যাদা-তাৎপর্য এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচ্য বিষয়। নামাজ ঈমানের অন্যতম অংশ এবং জামাতসহকারে নামাজ পড়ার জন্য সবাইকে সমবেত হতে আহ্বান করা হয় এ আজানের মাধ্যমে। আজানের এ ধর্মীয় মর্যাদা আল্লাহ প্রদত্ত। এর প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা সবার কর্তব্য। কেউ এর প্রতি অবজ্ঞা-অসম্মান বা ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করলে তা হবে অন্যায়। কোরআনের সূরা বনি ইসরাইল ও সূরা নজমে মেরাজের বিভিন্ন দিক বর্ণিত হয়েছে। বহু হাদিসে মেরাজের বিবরণ রয়েছে। একটি হাদিস গ্রন্থে আজান প্রসঙ্গও এসেছে যা নি¤œরূপ :
আবু নাঈম মোহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া থেকে বর্ণনা করেন যে, নবী করীম (সা.) শবে মেরাজে আকাশের এক জায়গায় পৌঁছে থেমে যান। আল্লাহতায়ালা একজন ফেরেশতা প্রেরণ করলেন। ফেরেশতা এসে এক জায়গায় দাঁড়াল, যেখানে ইতিপূর্বে সে কখনো দাঁড়ায়নি। ফেরেশতাকে বলা হলো, তাঁকে আজান শিক্ষা দাও। ফেরেশতা বলল, আল্লাহ আকবার, আল্লাহু আকবার। আল্লাহ বললেন, আমার বান্দা সত্য বলেছে। অর্থাৎ আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ। ফেরেশতা বলল, আশহাদু আল্লা ইল্লাহা লাইলা ইল্লাহ। আমার বান্দা সত্য বলেছে। ফেরেশতা বলল, আশহাদু আন্না মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। আল্লাহ বললেন, আমার বান্দা সত্য বলেছে। আমি তাঁকে রাসূল করেছি। আমি তাঁকে মনোনীত করেছি। আমি তাঁকে আমিন তথা বিশ্বস্ত করেছি। ফেরেশতা বলল, হাইয়্যা আলাছ ছালা। আল্লাহ বললেন, আমার বান্দা সত্য বলেছে। আমার ফরজের দাওয়াত দিয়েছে। এখন সে সওয়াবের নিয়তে নামাজ পড়বে, নামাজ তার জন্যে সব গোনাহের কাফফারা হবে। ফেরেশতা বলল, হাইয়্যা আলাল ফালাহ। আল্লাহ বললেন, আমার বান্দা সত্য বলেছে, আমি আমার ফরজ, তার সংখ্যা ও তার সময় নির্ধারণ করেছি। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা.) কে বলা হলো, সম্মুখে অগ্রসর হোন। তিনি অগ্রসর হলেন এবং আকাশের বাসিন্দাদের ইমামতি করলেন। এভাবে সব উম্মতের ওপর তাঁর গৌরব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হলো। ইবনে মরদুওয়াইহি যায়দ ইবনে আলী থেকে এবং তিনি আলী (রা.) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে শবে মেরাজে আজান শিক্ষা দেওয়া হয় এবং তার ওপর নামাজ ফরয করা হয়। মেরাজ রজনীতে রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঞ্জেগানা নামাজের ন্যায় আজানও প্রদান করা হয়। (খোসায়েসে কুবরা)।
উপরে উল্লিখিত বিবরণ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মেরাজ রজনীতে আল্লাহর দিদার লাভের পর রাসূলুল্লাহ (সা.) ফরজ হিসেবে নামাজে পাঞ্জেগানা লাভ করেন এবং মেরাজের একই সফরে নামাজের আনুষঙ্গিক বিষয় আত্তাহিয়তি আজান-একামতও প্রাপ্ত হয়। বোখারি ও মুসলিমে হজরত আবু হোরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদিসে আজানের শব্দ শুনে শয়তানের পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি এভাবে এসেছে : ‘আন আবি হোরায়রাতা আন্না রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা কালা: ইযা নুদিয়া বিছ ছালাতি আদবারাশ শয়তানু, ওয়া লাহু যোরাতুন হাত্তা লা ইয়াসমাউল আজানা ... লা ইয়াদরি কাম ছাল্লা।’
অনুবাদ : রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন যে, আজানের শব্দ শুনে শয়তান পীঠ ফিরিয়ে পলায়ন করে, তখন তার বায়ু নির্গত হতে থাকে। যেন সে আজান শুনতে না পায়। আজানের পর সে আবার ফিরে আসে। অতঃপর যখন একামত বলা হয়, পালিয়ে যায়। একামতের পর আবার ফিরে আসে এবং নামাজিদের অন্তরে নানা প্রকারের কুমন্ত্রণা দেয়, এমনকি নামাজি ভ্রমে পতিত হয় কয় রাকাত পড়েছে এবং কী পড়েছে।
আজানের শব্দ শুনে শয়তানের পলায়নের যখন এ অবস্থা যে, আজানের শব্দ থেকে সে বাঁচতে চায়, যেন আজানের শব্দ শুনে কেয়ামতের দিন সাক্ষ্য দিতে না হয়। কেননা হুজুর (সা.) বলেছেন যে, কেয়ামতের দিন জিন, মানব এবং দুনিয়ার প্রতিটি বস্তু যে আজানের শব্দ শুনেছে তাকে সাক্ষ্য দিতে হবে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেন হুজুর (সা.)-এর সামনে এক ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হয় যে, সূর্য উদয়ের পর (বিলম্বে) ঘুম থেকে জাগ্রত হয়েছিল। হুজুর (সা.) বললেন, ওই ব্যক্তির কানে শয়তান প্র¯্রাব করে দিয়েছিল। (বোখারি ও মুসলিম)।
পূর্বে উল্লিখিত আজানের ঘটনাটি আসমানে মেরাজ রজনীর এবং আল্লাহর পক্ষ হতে একজন ফেরেশতা কর্তৃক রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে শেখানোর এবং শয়তানের আজান ভীতির ঘটনা মদিনায় আজান প্রবর্তিত হওয়ার পরের অবস্থা। নামাজের একামত শেষে নামাজ আরম্ভ হয়ে যায়। পালিয়ে যাওয়া শয়তান আবার ফিরে এসে মুসল্লিদের নামাজে গোলমাল সৃষ্টির প্রয়াস পায়, নামাজরত অবস্থায় কুমন্ত্রণা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। বর্ণিত হাদিসে শয়তান ফিরে এসে যে চাল চালায় তার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। শয়তান সে চাল কীভাবে চালায় অন্য হাদসে তারও উল্লেখ রয়েছে।
শয়তানের আজান ভীতির কথা বলা হয়েছে। অজু করার সময় শয়তান মুসল্লিদের কীভাবে কুমন্ত্রণা দেয় তা একটি হাদিস থেকে জানা যায়। হযরত মোজাহেদ (রা.)-এর বর্ণনা অনুযায়ী শয়তানের দুই পুত্র লাকিস এবং ওয়ালহান অজু এবং নামাজে গোলমাল সৃষ্টির জন্য নিয়োজিত। তিরমিজি শরিফে হজরত ওবাই ইবনে কাব (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : অজুতে গড়বড় সৃষ্টি করার জন্য একজন শয়তান নিয়োজিত। তার নাম ওয়ালহান। তাই পানির ওয়াস ওয়াসা (কুমন্ত্রণা) হতে আত্মরক্ষা কর। অর্থাৎ অজু করার সময় নিয়ম পালনে শয়তান ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। কোন অঙ্গের অজু আগে করল, কতবার করল ইত্যাদি ক্রিয়া পালনে শয়তান পুত্র নানাভাবে সংশয়ের সৃষ্টি করে। ফলে মুসল্লি ধাধায় পড়ে যায়, এমনকি একই ক্রিয়া বার বার করতে থাকে। এভাবে শয়তান তাকে সন্দেহে পতিত করে।
হযরত উসমান ইবনে আবিল আছ (রা.) বর্ণনা করেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সমীপে নিবেদন করি যে, শয়তান আমার নামাজের মধ্যে প্রতিবন্ধক হয়ে যায়। হুজুর (সা.) বললেন, এর নাম খনজব শয়তান। এর থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় হচ্ছে, আউযুবিল্লাহ পড়ে বাম দিকে থু থু ফেলবে। (মুসলিম) নামাজি মুসল্লিরা চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন যে, অজু করার সময় এবং নামাজে কোন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। মনে রাখতে হবে, হাদিসে বর্ণিত ওয়ালহান ও খনজবÑ এ দুই শয়তান তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করার কাজে সর্বাবস্থায় নিয়োজিত।
নামাজে পাঞ্জেগানা ফরজ করা হয়
ইসলামের পঞ্চ ভিত্তির মধ্যে নামাজ দ্বিতীয়। মেরাজ রজনীতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন আল্লাহর দিদার লাভ করার পর প্রত্যাবর্তন করছিলেন তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে তাকে দৈনিক পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হিসেবে দান করা হয়। বিনা বাক্যে তিনি তা গ্রহণ করেন। ফেরার পথে ষষ্ঠ আসমানে হযরত মূসা (আ.)-এর সাথে সাক্ষাৎ হয়। তিনি জিজ্ঞাসা করেন, আল্লাহর পক্ষ হতে কি নির্দেশ হয়েছে? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, প্রতিদিন পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজের নির্দেশ হয়েছে। মূসা (আ.) বললেন আপনার উম্মত প্রতিদিন পঞ্চাশ নামাজ পড়তে পারবে না, আপনি স্বীয় উম্মতের ওপর হতে এ বোঝা হাল্কা করান। অতএব তিনি বার বার আল্লাহর দরবারে গমন করে কমাতে থাকেন, শেষ পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্ত অক্ষুণœ থাকে এবং এতে তিনি রাজি হয়ে যান। (বোখারি ও মুসলিম)।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি আল্লাহ সালাম জানান
শবে মেরাজে রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন কাবা কাউমাইন নামক স্থানে পৌঁছেন তখন আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে তাঁকে এভাবে সালাম পেশ করা হয় :
আস্-সালামু আলাইকা আইয়্যহান নাবিয়্যু, ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। অর্থাৎ হে নবী, আপনার প্রতি সালাম এবং আল্লাহর রহমত ও বরকত। এর জবাবে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, আস সালামু আলাইনা ওয়া আলা ইবাদিল্লাহিছ ছালেহীন। অর্থাৎ সালাম আমাদের প্রতি এবং আল্লাহর নেক বান্দাদের প্রতি। বর্ণিত বাক্য আলাইনা (আমাদের প্রতি) বহু বচন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং ছালেহীনকে আলাদাভাবে উল্লেখ করে উম্মতের গুনাগার বান্দাদেরকে অতি দয়াদ্র হয়ে সালামে নিজের সাথে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
হে নবী : আপনার প্রতি সালাম। নামাজে ‘তাশাহ হুদ’ অবস্থায় নামাজি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে উপরোক্ত মর্মে সম্বোধন করবে এবং তিনি ব্যতীত সৃষ্টির আর কাউকে অনুরূপভাবে সম্বোধন করা হয় না। শবে মেরাজে আল্লাহতায়ালা রাসূলুল্লাহ (সা.) কে উল্লিখিত রূপে সম্বোধন করেছেন। এ সম্পর্কে ইমাম আবদুল ওহাব শারানীর একটি বক্তব্যের উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি স্বীয় বিখ্যাত গ্রন্থ মীজানুল কোবরায় ‘ছিফতে ছালাত’ অধ্যায়ে লিখেছেন :
‘সাইয়্যিদি আলী খাওয়াছকে এই কথা বলতে আমি শুনেছি যে, শারেয়ে (আ.) অর্থাৎ শরীতের প্রবর্তক নামাজীকে আত্তাহিয়্যাত পড়ার সময় রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি দরূদ পাঠের নির্দেশ এ কারণে দিয়েছেন যে, গাফেল-অসাবধান ব্যক্তিরা যেন অবহিত হয়ে যায় যে, তোমরা আল্লাহর সামনে বসে আছো। তাঁর এ দরবারে তোমাদের নবীও উপস্থিত আছেন। কেননা দরবারে এলাহী হতে তিনি কখনো বিচ্ছিন্ন থাকেন না। তাই নামাজিরা তাকে সালামের সাথে সম্মান ও মর্যাদা করেন। বিষয়টি নিয়ে আরো অনেক ইতিবাচক মতামত রয়েছে। মেরাজ রজনীতে মহান আল্লাহর পক্ষ হতে রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে তার উম্মতের জন্য প্রদত্ত উপহার সওগাতের মধ্যে পাঞ্জেগানা নামাজ ফরজ করার পাশাপাশি আত্তাহিয়্যাত পাঠ করা নামাজের মধ্যে ওয়াজিব করা হয়। মুসলিম উম্মার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) এ অপূর্ব উপহার দান করে আল্লাহতায়ালার অসীম দয়া প্রদর্শন করেছেন এবং অপর একটি বর্ণনা অনুযায়ী মেরাজ রজনীতেই আল্লাহ একামতও দান করেছন (চলবে)।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন