মো. রেজাউল করিম, দেলদুয়ার (টাঙ্গাইল) থেকে
আগামী ৭মে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার ৮ ইউনিয়নে চতুর্থ ধাপের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ইতিমধ্যে উপজেলা প্রশাসন ও নির্বাচন অফিসের পক্ষ থেকে বেশির ভাগ প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। প্রার্থীদের প্রচারণায় উপজেলার সর্বত্র উৎসব মুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। প্রার্থীর অফিসের চেয়েও ভোটের হিসাব নিকাশ হচ্ছে হাট-বাজারের চায়ের দোকানগুলোতে। চায়ের প্রতিটি চুমুকেই যেন ভোটের হিসাব। উপজেলার খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের আলোচনায় দেখা যায়, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ উপজেলার কোন ইউনিয়নেই শক্তিশালী প্রার্থী দিতে পারেনি। ফলে অধিকাংশ ইউনিয়নে রয়েছে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী। আর বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ে আওয়ামী লীগ ক্রমশ পড়ছে বিপাকে। অধিকাংশ প্রার্থী নিয়ে নারাজ দলটির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মাঝে বিরাজ করছে ক্ষোভ। আওয়ামী লীগের দুর্বল প্রার্থী নির্বাচন হওয়ায় মাঠে নেমেছে জেলা উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। প্রার্থী ও কর্মীদের চাঙ্গা করতে অনেক সময় নির্বাচনী সভায় নেতারা উগ্র বক্তব্য দিয়ে চলছেন। পাথরাইল ইউনিয়নের পুটিয়াজানী, পুরতম পাথরাইল ও চন্ডী শশ্মানে নির্বাচনী সভায় দলের হ্যাভিওয়েট নেতারা নৌকার পক্ষে আপত্তিকর বক্তব্য দেয়ায় সাধারণ ভোটারা নৌকার ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে। সাধারণ মানুষের ধারণা, নৌকার মাঝি নির্বাচন সঠিক হলে প্রার্থীর জন্য হ্যাভিওয়েট নেতাদের মাঠে নামতে হত না। এদিকে সবগুলো ইউনিয়নে বিএনপি একক প্রার্থী দিলেও অর্থনৈতিক মেরুদ-হীনতায় মাঠে নামাতে পারছে না কর্মীদের।। ফলে নির্বাচনী প্রচারণার চেয়ে আলোচনা সমালোচনাই বেশি হচ্ছে। দু’একটি ইউনিয়নে জামায়াত ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী থাকলেও কর্মীর অভাবে আলোচনায় আসতে পারছে না দল দুটির প্রার্থীরা। আওয়ামী লীগ মরণ কামড় দিয়ে লেগেছে জয় লাভ করতে। বিএনপির হিসেব এখনও শেষ হয়নি। এদিকে বিএনপি প্রার্থীদের এখনও ভাবনা, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরোপেক্ষ হবে কিনা? উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের ৫টিতেই দলের মনোনয়ন বঞ্চিতরা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। ফলে বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ে বেকায়দায় রয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। পাশাপাশি ৮ ইউনিয়নেই বিএনপির একক প্রার্থী রয়েছে। দেলদুয়ার সদরে রয়েছে ৯ জন চেয়ারম্যান প্রার্থী, পাথরাইল ৩জন, ফাজলহাটী ৩জন, ডুবাইল ৪৬ন, আটিয়া ৮ জন, লাউহাটী ৩জন, দেউলী ১১জন ও এলাসিন ইউনিয়ন পরিসদে ৫জন প্রার্থীসহ মোট ৪৬ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এছাড়া সংরক্ষিত নারী পদে ৮০ জন, সাধারণ সদস্য ৩১৮ জন। মোট ভোটার সংখ্যা ১ লাখ ৫৩ হাজার ৯৮০ জন। এখানে ভোট কেন্দ্র রয়েছে ৭৫টি। দেলদুয়ার সদর ইউনিয়ন : দেলদুয়ার উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কাশেম খান দেলদুয়ার সদর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু মনোনয়ন বাছাই কমিটি অপেক্ষাকৃত কম জনপ্রিয় নতুন মুখ মো. মোয়াজ্জেম হোসেন খান মিলনকে এ মনোনয়ন দেয়। এ কারণে আবুল কাশেম খান বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। এর ফলে উপজেলা আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাকর্মী গোপনে অবস্থান নিয়েছেন এ বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে। এ ইউনিয়নে শুধু দলীয় হেভিওয়েট বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থীই নয়, রয়েছে বিএনপি মনোনিত প্রার্থী রকিব উদ্দিন বাবুল ও স্বতন্ত্র প্রার্থী তিনবারের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবু তাহের তালুকদার বাবলু। ফলে এই ইউনিয়নে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে বর্তমান চেয়ারম্যান (স্বতন্ত্র) আব্দুর রাজ্জাক। তিনি নির্দিষ্ট কয়েকটি এলাকা বেছে নিয়ে ঐ এলাকেই প্রচারণা ও অর্থ খরচ করছেন। আবু তাহের বাবলুর (স্বতন্ত্র) ভোট সব এলাকাতেই রয়েছে। এদিকে ফাঁকা এলাকা পেয়ে হুমায়ন একটা অবস্থানে রয়েছে। প্রধান দুই দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী একই গ্রামের হওয়ায় বেকায়দায় পড়েছে উভয় প্রার্থী। পাথরাইল ইউনিয়: পাথরাইল ইউনিয়নে সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা হেলাল উদ্দিন দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন। মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম জোয়াহের এর বাসার ভাড়াটিয়া ইউপি সদস্য রাম প্রসাদ সরকার। এ ইউনিয়নে সাবেক চেয়ারম্যান হানিফুজ্জামান লিটন ও বিএনপির উপজেলা শাখার সভাপতি সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল আজিজ চান খাঁ রয়েছেন সিংহভাগ ভোটারের অন্তরে। এ ইউনিয়নে বিভিন্ন সময় হ্যাভিওয়েট নেতারা আপত্তিকর বক্তব্য দিয়ে নৌকার ভোট বাড়ার পরিবর্তে হ্রাস পেয়েছে। এদিকে বর্তমান চেয়ারম্যান হানিফুজ্জামান লিটন এর কম বেশি ভোট অধিকাংশ এলাকাতে রয়েছে। সবচেয়ে লাভবান অবস্থায় রয়েছে ধানে শীষ। কারণ হিসেবে আলোচনায় এসেছে, সাবেক ৩নং ওয়ার্ডেই রয়েছে আওয়ামী লীগ ও বর্তমান চেয়ারম্যন হানিফুজ্জামান লিটন। ১ ও ২নং ওয়ার্ডে রয়েছে বিএনপির একটি প্রার্থী। তার নিজের গ্রামের দুই ওয়ার্ডে রয়েছে প্রায় ৪৫০০ রিজার্ভ ভোট। ফলে এ ইউনিয়নে বিএনপি প্রার্থী জয়ের সম্ভাবনার কথা বলেন ভোটাররা। ডুবাইল ইউনিয়ন: ডুবাইল ইউনিয়নে টানা চারবারের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আতোয়ার রহমান দলীয় মনোনয়ন চেয়ে বঞ্চিত হয়েছেন। নৌকার টিকিট পেয়েছেন দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস মিয়া। এর ফলে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন আতোয়ার রহমান। ব্যক্তি ইমেজ ও চারবারের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এ ইউনিয়নে বিদ্রোহী প্রার্থী আতোয়ারের জয়ের সম্ভাবনাই প্রকট বলে জানা গেছে। এছাড়াও বিএনপি মনোনীত প্রার্থী খোরশেদ আলম বাদলও রয়েছেন শক্ত অবস্থানে। ফাজিলহাটি ইউনিয়ন: ফাজিলহাটি ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ নেতা কনক রঞ্জন বসু ও হুমায়ুন কবির নৌকার মনোনয়ন চেয়েছিলেন। এ দুই নেতাকে বঞ্চিত করে শওকত আলী শওকতকে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়। এর ফলে এ ইউনিয়নটিতে বিরোধীতার মুখে পড়েছে দলীয় প্রার্থী। এ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান এম.এ মবিন সরকার ও বিএনপির শক্তিশালী প্রার্থী মো. তোফাজ্জল হোসেন রয়েছেন সুবিধাজনক অবস্থানে। এর আগের বিএনপির তোফাজ্জল হোসেন মাত্র ২১ ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন। তাই এবারের নির্বাচনে ভোটারদের অনেকটা সহানুভূতি তোফাজ্জলের প্রতি। লাউহাটি ইউনিয়ন: লাউহাটি ইউনিয়নে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম শিবলী সাদিকের বড় ভাই গোলাম ফারুক পান্না নৌকার প্রার্থী হয়েছেন। এখানে সাবেক চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম ফিরোজ বিএনপির ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করছেন। এছাড়া সাবেক চেয়ারম্যান শাহীন মোহাম্মদ খানও শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। তবে এ ইউনিয়নে ফিরোজের জয়ের সম্ভাবনাই বেশি এমনটাই এলাকার ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। আটিয়া ইউনিয়ন : আটিয়া ইউনিয়নে সাবেক চেয়ারম্যান বাবুলউজ্জামান মোল্লা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম মল্লিক নৌকার মনোনয়ন চেয়েছিলেন। দলীয় কোন্দলের কারণে তারা উভয়ই বাছাই কমিটির মন জয় করতে ব্যর্থ হয়েছেন। মনোনয়ন দেয়া হয়েছে মাসুদুল হাসান তালুকদারকে। এ দুই হেবিওয়েট বিদ্রোহী প্রার্থীকে পরাজিত করে নৌকার প্রার্থীর জয় এ ইউনিয়নে খুবই কঠিন বলে ভোটারা জানান। এ ইউনিয়নে বর্তমান চেয়ারম্যান বাবুলউজ্জামান মোল্লা (স্বতন্ত্র), উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম মল্লিক (স্বতন্ত্র) ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মামুন এদের মধ্যে ত্রিমুখী ভোট যুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এলাসিন ইউনিয়ন: এলাসিন ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে সাবেক চেয়ারম্যান বেলায়েত হোসেনকে। এখানে আরেক বর্তমান চেয়ারম্যান গোলাম কিবরিয়া ও বিএনপির একক প্রার্থী আব্দুল লতিফ মিয়া, মানিক রতন রয়েছেন শক্ত প্রতিপক্ষ রূপে। তবে শেষ পর্যায়ে মানিক রতন আওয়ামীলীগ বিদ্রোহী (সতন্ত্র) ও গোলামাম কিবরিয়ার সাথে ভোট যুদ্ধের কথা উঠে এসেছে। দেউলী ইউনিয়ন: দেউলী ইউনিয়নে খন্দকার জাহাঙ্গীর হোসেন ও কামরুল ইসলাম সাচ্চু অওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে পাননি। পেয়েছেন দেওয়ান তাহমিনা। কামরুল ইসলাম সাচ্চু মনোনয়ন না পেয়ে জাতীয় পার্টিতে যোগদান করে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন। ভোটের সমীকরণে সাচ্চু এ ইউনিয়নে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছেন। এছাড়া আওয়ামী লীগের দুই বিদ্রোহীসহ বিএনপির উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান রয়েছেন শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী। দেলদুয়ার উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের নির্বাচনের বিষয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি খন্দকার ফজলুল হক বলেন, সব ইউনিয়নেই বিদ্রোহী প্রার্থী নেই। বিদ্রোহী প্রার্থী থাকলেও আশা করছি ফলাফলে আমাদের প্রার্থীরা ভালই করবে। উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এসএম ফেরদৌস আহমেদ বলেন, অবাদ, সুষ্ঠ ও নিরোপেক্ষ নির্বাচন হলে সংখ্যা গরিষ্ঠ ইউনিয়নে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীরা জয় লাভ করবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন