শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ০৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৮ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে হবে

মোহাম্মদ আবু নোমান | প্রকাশের সময় : ১৭ নভেম্বর, ২০১৮, ১২:০৫ এএম

রাজনীতিতে মতভেদ থাকবে, প্রতিদ্ব›িদ্বতা থাকবে, বিরোধিতা থাকবে; কিন্তু প্রতিহিংসা বা সংঘাত মেনে নেয়া যায় না। নির্বাচন এলেই একদিকে আন্দোলন, অন্যদিকে নির্বাচনের চ্যালেঞ্জে দেশ একটি অস্থির অবস্থায় পড়ে যায়। সর্বত্রই উদ্বেগ, আতঙ্ক ও ভয়ভীতি বিরাজ করে। এমন হওয়াটা সত্যিই দুর্ভাগ্যের। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যদি বিতর্কিত হয়, তাহলে দেশ ভয়াবহ পরিণতির মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা পর্যবেক্ষকদের।

স্বাধীনতার পর থেকে ১০টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে। এখন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। আগামী ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণের কথা। অতীতেও জাতির কাক্সিক্ষত স্বচ্ছ নির্বাচন বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ইসির নির্বাচনের পুনঃতফসিল রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করে নির্ধারণ করলে এমন কি ক্ষতি হতো? কারণ, সামনের নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে জনমনে সংশয় রয়েছে। প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনই দেশ ও জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও সামনের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অতীতের যেকোনো নির্বাচনের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এখন নির্বাচন কমিশনসহ সব অংশীজনের দায়িত্ব নির্বাচনের অনুক‚ল পরিবেশ নিশ্চিত করা। নির্বাচন আসবে এবং সবাই যার যার ইশতেহার প্রকাশ করবে। দলগুলো জনগণের কাছে দেশের কল্যাণে নানা অঙ্গীকার ও পরিকল্পনা উপস্থাপন করবে। সর্বসাধারণের কাছে যাদের ইশতেহার পছন্দ হবে, তাদেরকে ভোট দেবে। পরবর্তীতে যারা বিজয়ী হবেন তারা সরকার গঠন করবেন। আর বিরোধী দল সংসদ গিয়ে সরকারের কর্মকান্ডের ওপর নজরদারি রাখবে। রাজনীতি মানেই দেশকে সামনে নিয়ে যাওয়া, মানুষের জন্য কথা বলা। যখন কোনো সরকার নির্বাচিত হয়, তখন যারা বিরোধী থাকে, তারা সরকারের ভালো-মন্দ নিয়ে আলোচনা করতে পারে। আলোচনা-সমালোচনা থাকবে শুধুমাত্র দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে। এ জন্য অতি জরুরি একটি গতিশীল সংসদের।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারি দল ও বিরোধী দল পরিপুরক সত্তা। গণতন্ত্রে সংঘাত ও অস্থিতিশীলতার কোনো স্থান নেই। কিন্তু বাংলাদেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে সংঘাত ও অস্থিতিশীলতা সর্বদাই অনিবার্য, যার মূল কারণ ছাড় দেওয়ার মানসিকতা কারোরই নেই। জনগণের সেবার নামে জনগণকে জিম্মি করাই যেন মূল লক্ষ্য। এই মানসিকতার পরিবর্তন না হলে রাজনীতিতে কখনোই স্থিতিশীলতা আসবে না। দেশ রক্ষা ও দেশের উন্নয়নের স্বার্থে সব রাজনীতিবিদের ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, রাজনীতিকদের কোনো অবিবেচক সিদ্ধান্ত বা ভুলের কারণে যদি দেশের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বিপন্ন হয়ে পড়ে, নির্বাচন ভুন্ডুল হয়ে যায়, তাহলে দেশ অগণতান্ত্রিক অপশক্তির কবলে পড়তে পারে, ভয়ংকর বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতিও বেশির ভাগ দল শ্রদ্ধাশীল নয়। এ কারণেই আমাদের রাজনীতি ও নির্বাচন দিন দিন সংঘাতপূর্ণ হয়ে উঠছে। প্রায়ই রাজনীতিকরা প্রতিপক্ষকে উৎখাত, নিশ্চিহ্ন বা নির্মূল করার হুমকি দেন। সুস্থধারার রাজনীতিতে এ ধরনের আচরণ কাম্য নয়। সার্থক নির্বাচনের জন্য দরকার সব দলের ও সব মতের লোকের অংশগ্রহণ। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের ভ‚মিকাই মুখ্য, তবে সরকারকে অবশ্যই সহায়ক হতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার বিরোধ-বৈরিতা দূর করতে হবে।
তফসিল ঘোষণা মানেই সব শেষ হয়ে যাওয়া নয়। ইসিকে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের যুক্তিসম্মত সব সমস্যার সমাধান করতে হবে। রাজনৈতিক দলকেও সদিচ্ছা ও সুবিবেচনার পরিচয় দিতে হবে। তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনী পরিবেশ ও নিয়ম বজায় থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা কতটা আছে, তা নিয়ে সংশয় আছে। নির্বাচন কমিশনের কথা ও কাজে মিল থাকতে হবে। কিন্তু সুষ্ঠু ও স্বচ্ছতার পক্ষে অবস্থান নির্বাচন কমিশন ধরে রাখতে পারবে কিনা এটাই সচেতন মহলের শঙ্কা ও প্রশ্ন? সরকার নির্বাচনের ক্ষেত্রে সহায়ক শক্তি মাত্র, মুখ্য শক্তি নির্বাচন কমিশন। কিন্তু আমাদের দেশে ঘটে থাকে এর সম্পূর্ণ উল্টো। নির্বাচন কমিশনের ওপর এখনো জনগণের আস্থা পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে ইসিকে নিরপেক্ষ ও জোরালো ভূমিকা নিয়ে কাজ করতে হবে। এটা ইসির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ বিগত নির্বাচনের নেতিবাচক অস্বস্তি নতুনভাবে সর্বসাধারণ গ্রহণ করবে না। বিরোধী দলের লোকদের বিরুদ্ধে অকারণে মামলা ও গ্রেপ্তার বন্ধ করতে হবে। গতবারের মতো জোড়াতালি দেওয়া নির্বাচন করা যাবে না। এ জন্য ইসিকে শক্ত ভূমিকা নিতে হবে।
নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে সহিষ্ণু হতে হবে। অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সুনিশ্চিত করতে হলে তার পূর্বশর্তগুলো সরকার ও বিরোধী দলকে মেনে চলতে হবে। সমঝোতা ছাড়া গণতন্ত্র সুনিশ্চিত করা সম্ভব নয়। একথাও ঠিক যে, নির্বাচনের সবটাই কমিশনের দায়িত্ব নয়। নির্বাচন কমিশনকে কার্যকর করতে হলে সরকার ও বিরোধী দলকে সমঝোতার ভিত্তিতে তা করতে হবে।
প্রত্যেক নির্বাচনকর্মীকে তাদের দক্ষতা, নিরপেক্ষতা নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে। পরিমিত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়োগ দেওয়াসহ তাদের নিরপেক্ষতা, দক্ষতা, একাগ্রতার সাথে, সব ধরনের বিশৃঙ্খলা ও নাশকতা রোধে দেশের সব নাগরিকের সার্বিক সহযোগিতা প্রয়োজন। জনগণের মধ্যে ব্যাপক কৌত‚হল রয়েছে সামনের নির্বাচন নিয়ে। বারবার নির্বাচনব্যবস্থার পরিবর্তন আনা হলেও সর্বসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য কাক্সিক্ষত স্বচ্ছ নির্বাচন বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। স্বচ্ছতার প্রশ্নে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন বর্জন করার ইতিহাস দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে একাধিকবার। নির্বাচনব্যবস্থার অসংগতি, অস্বচ্ছতা, পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণকে বারবার কলঙ্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে আমাদের অতীতের নির্বাচন। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করতে হলে অবশ্যই সব দলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ একান্ত কাম্য।
নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে আজ্ঞাবাহী হলে চলবে না। কারো ইশারা-ইঙ্গিতের ‘পুতুল’ হলে চলবে না। সব দলকে সমান সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। নির্বাচনকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে আরো বেশি শক্তিশালী ও স্বাধীনভাবে কাজ পরিচালনা করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে দূরে থাকতে হবে। গত নির্বাচনে জনগণ তাদের পছন্দের প্রার্থীদের ভোট দিতে পারেনি। আর যেন সেই ধরনের ঘটনা না ঘটে। নির্বাচনের সময় ভোটকেন্দ্রে প্রার্থীর পক্ষের এজেন্ট নিয়োগ প্রক্রিয়াটি সুষ্ঠু নির্বাচনের বড় বাধা। বরাবরই ক্ষমতাসীন দল নিজেদের মর্জিমাফিক এর সুবিধা নিয়ে থাকে বলে অভিযোগ ওঠে। গ্রামাঞ্চলে চেয়ারম্যান ও মেম্বরদের পালিত সন্ত্রাসী বাহিনী ও কর্মীরা অন্য দলের এজেন্টদের ওপর শারীরিক নির্যাতন করতেও দ্বিধা করে না। কেন্দ্রের আসপাশে ওত পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা এ সময়ে যাতে অঘটন ঘটাতে না পারে, এ জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কঠোর পাহারা নিশ্চিত করতে হবে।
পুলিশের বিনা ওয়ারেন্টে কাউকে হয়রানি, গায়েবি মামলা, নির্বাচনকে সামনে রেখে অহেতুক গ্রেফতার বাণিজ্য করে প্যানিক সৃষ্টি না করতে পারে সেদিকে নির্বাচন কমিশনকে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে মানুষের দৃষ্টির বাইরে, জনগণের সমর্থন ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে নির্বাচনে জয়ী হওয়া বা ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ নেই। মানুষ নির্বাচন চায় এবং যোগ্য প্রার্থী ও দলকে ভোট দিতে চায়।
বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্বে এক সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে পরিচিত। এই সম্মানজনক অবস্থান ধরে রাখতে হলে অবশ্যই দূরদর্শী, বিচক্ষণ, দৃঢ়চেতা, সাহসী ও রাজনীতিতে অভিজ্ঞ নেতৃত্বের প্রয়োজন। ভোটকেন্দ্রের পরিবেশ রক্ষা, ভোটারদের নিরাপত্তা বিধান এবং কোনো অনিয়মকে প্রশ্রয় না দিয়ে সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণ, গণনা ও নিরপেক্ষ মানসিকতা না হলে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হয়। আমাদের দেশে সমস্যা হলো, আমরা দল, সরকার ও দেশকে আলাদা করে দেখার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। নিয়ম হচ্ছে, দল দলের জায়গায় থাকবে, সরকার সরকারের জায়গায়; দল ও সরকারের ঊর্ধ্বে থাকতে হবে দেশপ্রেম। দল ও সরকার যদি এক হয়ে যায়, তাহলে নির্বাচন কমিশনের অবস্থাতো ‘...পুতুলের কি দোষ’!
জনগণের স্বার্থে, দেশের কল্যাণে স্বচ্ছতার মাধ্যমে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ করা হলে, জাতীয় নির্বাচনে জনগণ বিপুল অংশগ্রহণ করবে এবং তাদের পছন্দমতো প্রার্থীকে ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে। তাই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের মূল কাজ হবে সৎ ও যোগ্য প্রার্থীকে নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়া। সব মিলিয়ে দেশের জনসাধারণের একটাই আশা, আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও সফল হবে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Jens ২০ নভেম্বর, ২০১৮, ৫:০৩ এএম says : 0
I really like it when individuals come together and share thoughts.
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন