শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ০৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৮ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

এ ধরনের সংঘর্ষ মোটেই কাম্য নয়

মহিউদ্দিন খান মোহন | প্রকাশের সময় : ১৭ নভেম্বর, ২০১৮, ১২:০৫ এএম

সবকিছু বেশ ভালোভাবেই এগোচ্ছিল। দেশের সব রাজনৈতিক দল আসন্ন নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, এটা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর জনমনে স্বস্তির ভাব লক্ষ করা গেছে। সংঘাত-সংঘর্ষের আশঙ্কায় যারা উদ্বিগ্ন ছিলেন, তারা আশ্বস্ত হয়েছিলেন এই ভেবে যে, সব দল নির্বাচনে অসায় দেশটি আর রণক্ষেত্রে পরিণত হবে না, রক্ত ঝরবে না। কিন্তু গত ১৪ নভেম্বর দুপুরে নয়াপল্টনে বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে পুলিশের সঙ্গে দলটির নেতাকর্মীদের অনাকাক্সিক্ষত ও আকস্মিক সংঘর্ষ অনেকেরই কপালে ভাঁজ ফেলেছে। তাহলে কী হতে যাচ্ছে? যে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের আশা করছে দেশবাসী, তা কি শেষ পর্যন্ত সম্ভব হবে? 

গত ১২ নভেম্বর থেকে মনোনয়ন আবেদন ফরম বিতরণ শুরু হওয়ার পর থেকেই নয়াপল্টনের রাস্তায় বিএনপি নেতাকর্মীদের প্রচন্ড ভীড় লক্ষ করা যাচ্ছিল। নেতাকর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতির কারণে বিএনপি অফিসের সামনের রাস্তার একাংশ বন্ধই থেকেছে। পুলিশও এ ক্ষেত্রে প্রথম দিকে সহযোগিতাই করেছে। তারা ফকিরেরপুল মোড় ও বিজয়নগর মোড়ে কাঁটতারের ব্যারিকেড দিয়ে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছিল। এতে একটু যানজট সৃষ্টি হলেও তা নিয়ে তেমন কোনো অভিযোগ কারো ছিল না। কিন্তু ১৪ নভেম্বর নয়াপল্টনের রাস্তা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। পুলিশ বিএনপি নেতাকর্মীদের রাস্তা ছেড়ে দিতে বললে বাকবিতন্ডার এক পর্যায়ে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। পুলিশ বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর বেধড়ক লাঠিচার্জ করে, টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট ছোঁড়ে। এতে সব মিলিয়ে কমপক্ষে পঞ্চাশজন আহত হয়। বিক্ষুব্ধ কর্মীরা পুলিশের দু’টি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলে তা পুড়ে যায়।
ঘটনার পর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী তাৎক্ষণিক এক সংবাদ সম্মেলনে বিনা উস্কানিতে পুলিশ বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর হামলা করেছে বলে অভিযোগ করেন। অপরদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলের ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, মির্জা আব্বাসের নেতৃত্বে পুলিশের ওপর হামলা করা হয়েছে। তারা নির্বাচন বানচালের জন্য পরিকল্পিতভাবে পুলিশের ওপর হামলা করেছে। তিনি বলেন, ২০১৪ সালে নির্বাচন বানচালের জন্য তারা যা করেছিল, আজও তাই করলো। এতে প্রমাণিত হয়, তারা নির্বাচন চায় না। আর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে পুলিশ বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালিয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সরকার নির্বাচনী পরিবেশ নষ্ট করছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, নির্বাচন বানচালের জন্য নয়াপল্টনে পরিকল্পিতভাবে পুলিশের ওপর হামলা ও গাড়ি পোড়ানো হয়েছে। এটা নাশকতা করে ধূম্রজাল সৃষ্টি করে নির্বাচন বানচালের অপচেষ্টা। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে দোষী ব্যক্তিদের শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন। এদিকে ১৫ নভেম্বর এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিঞা জানিয়েছেন, বিভিন্ন সিসিটিভি ফুটেজে অনুসন্ধান চালিয়ে পুলিশের ওপর হামলা ও গাড়ি পোড়ানোর ঘটনার সঙ্গে জড়িত ৩০ জনকে ইতোমধ্যেই শনাক্ত করা হয়েছে। তিনটি মামলায় মোট আসামী করা হয়েছে ১ শ’ ৭৫ জনকে।
ঘটনার পর প্রতিদ্ব›দ্বী দুই দলের মধ্যে শুরু হয়েছে বাগযুদ্ধ। এক দল আরেক দলকে দায়ী করে বক্তব্য দিচ্ছে। পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর ও আগুন দিয়েছে যে দুই যুবক, তাদের ছবি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। দিয়াশলাই সহযোগে আগুন দিচ্ছে যে যুবক তার ছবি স্পষ্ট। বিএনপি বলছে, সে ছাত্রলীগ নেতা অপু। আর আওয়ামী লীগ ও পুলিশ বলছে, সে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল শাহজাহানপুর কমিটির নেতা। এখন পুলিশ তদন্ত করে সত্য ঘটনা বের করতে পারবে। সংঘর্ষের সময় হঠাৎ করেই আবির্ভাব ঘটেছিল হেলমেট বাহিনীর। তারা লাঠিসোঁটা নিয়ে গাড়ি ভাংচুর করেছে, এলোপাতাড়ি মানুষকে পিটিয়েছে। বিএনপি এদেরকে সরকারি দলের লোক বলছে। আর পুলিশ এদেরকে বিএনপির কর্মী বলে অভিযোগ করেছে।
এ অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ যে চলতেই থাকবে সে কথা সবারই জানা। যে কোনো ঘটনায় এক দলের আরেক দলকে অভিযুক্ত করা আমদের রাজনীতির অন্যতম ট্র্যাডিশন। এ ক্ষেত্রে কোনো পক্ষই সত্যাসত্যের ধার ধারে না। পল্টনে যে ঘটনা ঘটেছে, তার দায় পুলিশের এড়াবার উপায় নেই। পুলিশ যদি এত অল্পতেই বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর ঝাঁপিয়ে না পড়তো, তাহলেও অপ্রীতিকর এ ঘটনাটি এড়ানো যেতো। পুলিশের বোঝা উচিত ছিল, এখন নির্বাচনের সময়। সামান্য একটু ভুলের কারণে গোটা আয়োজন ভুন্ডুল হয়ে যেতে পারে। বিএনপির নেতাকর্মীদেরও আরো ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করা উচিত ছিল।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কোনো বক্তব্য না আসা। ঘটনার পর ২৪ ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও (এ নিবন্ধ লেখার সময় পর্যন্ত) তারা কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। অথচ নির্বাচনী শিডিউল ঘোষণার পর সবকিছু দেখভাল করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। এতবড় একটি ঘটনা ঘটার পরও তারা কেন নিশ্চুপ তা নিয়ে অনেকেরই মনে প্রশ্ন রয়েছে। পুলিশ বলেছে, রাস্তায় জনসমাগম করা নির্বাচনী আচরণ বিধির লঙ্ঘন। তাই তারা নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুয়ায়ী অ্যাকশনে গিয়েছে। বেশ ভালো কথা। যদি তাই হয়, তাহলে সবার ক্ষেত্রেই তা প্রয়োগ হওয়া উচিত। এ প্রসঙ্গে অনেকেই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন আবেদন ফরম বিক্রি ও জমার সময় ধানমন্ডি ও তৎসংলগ্ন এলাকায় সৃষ্ট যানজট ও জনদুর্ভোগের কথা তুলেছেন। সে সময় ওইসব এলাকায় অসহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। ক্ষমতাসীন দল ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের মিছিলের কারণে শহবাগ মোড়, সায়েন্স ল্যাবরেটরী, জিগাতলা, ধানমন্ডি ১৫ নম্বর ও সংলগ্ন এলাকায় তীব্র যানজট সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত লেগেই ছিল। সে সময় পুলিশকে জনদুর্ভোগ দূর করার জন্য রাস্তা পরিষ্কারের কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। শোনা যায়নি নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনার কথা। তাহলে নয়াপল্টনের রাস্তাটি পরিষ্কার রাখার তাগিদ তারা কেন অনুভব করলেন? একই বিষয়ে প্রতিদ্ব›দ্বী দুই পক্ষের ক্ষেত্রে দুই রকম দৃষ্টিভঙ্গী ও অ্যাকশন সঙ্গতকারণেই প্রশ্নের উদ্রেক করে। তাছাড়া বিএনপি-আওয়ামী লীগের মনোনয়ন আবেদন ফরম বিক্রির কারণে সৃষ্ট যানজট ও জনদুর্ভোগ নিয়ে কাউকে বিরক্তি বা উষ্মা প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। বরং সবাই বেশ উৎফুল্ল এ কারণে যে, দেশে একটি ইনক্লুসিভ ইলেকশন হতে যাচ্ছে, এবং তারই অংশ হিসেবে নাগরিকদের একটু অসুবিধা পোহাতে হচ্ছে। যানজটের শিকার অনেককে এমনও বলতে শোনা গেছে, আরে ভাই, এমন ঘটনা তো প্রতিদিন বা প্রতি সপ্তাহে ঘটে না। পাঁচ বছর পর পর ঘটে। এমনিতে কত দুর্ভোগ পোহাই আমরা। আর একটি সুন্দর নির্বাচনের জন্য দু’চার দিন নাহয় একটু কষ্টই করলাম। সচেতন ব্যক্তিরা বলছেন যে, পুলিশ ইচ্ছা করলেই নয়াপল্টনের ঘটনাটি এড়াতে পারতো। তারা ওই রাস্তাটিতে যান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়ে দৈনিক বাংলার দিকে আসা যানবাহনগুলোকে সোজা উত্তরে পাঠিয়ে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের মাঝখানের রাস্তা দিয়ে শান্তিনগরের দিকে পাঠিয়ে দিতে পারতো। যেমনটি করা হয়েছিল আওয়ামী লীগের ফরম বিতরণের সময়। তখন জিগাতলা, ধানমন্ডি ১৫ নম্বর, শংকর হয়ে মোহাম্মদপুরগামী বাসসহ যানবাহনগুলোকে কলাবাগান- আসাদগেটের দিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। একই ব্যবস্থা কি বিএনপির সময় নেওয়া যেত না? প্রশ্নটি উঠেছে এজন্যই। এক দলের বেলায় নির্বাচন কমিশন ও পুলিশ নির্বিকার থাকলো, আরেক দলের সময় তাদের আচরণ বিধি ও আইন প্রয়োগের চেতনা জেগে উঠলো কেন, এ হিসাব কেউই মিলাতে পারছেন না।
তো, হিসাব মিলুক আর না মিলুক, নয়াপল্টনের ঘটনার পর অনেকেই চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন নির্বাচন নিয়ে। কেউ কেউ বলছেন যে, দেশে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন হোক কোনো মহল হয়তো তা চায় না। তারা দূর থেকে কলকাঠি নেড়ে নির্বাচন ভুন্ডুল করে দিতে তৎপর কি না এ প্রশ্নও তুলেছেন কেউ কেউ। আবার কেউ কেউ মনে করছেন, সরকার চায় না বিএনপি নির্বাচনে আসুক। তাই নির্বাচন বয়কটে বিএনপিকে প্ররোচিত করতে এ ঘটনা ঘটানো হয়ে থাকতে পারে। আবার ভিন্নমতও রয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ইতোমধ্যে বলেছেন, বিএনপি ২০১৪ সালের মতো নির্বাচন বানচালের জন্য চেষ্টা করছে। এসব বক্তব্য পাল্টা বক্তব্য রাজনৈতিক ব্লেমগেমের অংশ। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সত্যিকার অর্থে এসব অভিযোগের যেমন কোনো সারবত্তা নেই, তেমনি নেই গুরুত্ব। নির্বাচন বানচাল হলে কোনো পক্ষেরই লাভ হয় না। অতীত ইতিহাস তাই বলে। ফলে প্রতিদ্ব›দ্বী কোনো দল নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র করছে- এমন অভিযোগ ধোপে টেকে না।
দেশবাসী কিন্তু ঘরপোড়া গরু। তারা পশ্চিম আকাশে সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পায়। একটি ছোট্ট স্ফুলিঙ্গ যেমন একটি নগর-জনপদের ভস্মীভ‚ত হওয়ার কারণ হতে পারে, তেমনি একটি ছোট সংঘর্ষও সূত্রপাত করতে পারে বড় ধরনের রাজনৈতিক বিপর্যয়ের। সাধারণ মানুষ লক্ষ করছে, আসন্ন নির্বাচনের প্রধান দুই প্রতিদ্ব›দ্বী পক্ষ নিজেদের ওপর ভীষণ আস্থাশীল। তারা জোর গলায়ই বলছেন যে, জনগণ ভোট দিয়ে তাদেরকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসাতে একেবার এক পায়ে খাড়া। জনগণের ওপর তাদের যেহেতু প্রবল আস্থা, তাহলে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে কী লাভ? ভোটারদের হাতের ওপর আস্থা রেখে নিজেদের হাতকে সংযত রাখলেইতো অনেক অঘটন এড়ানো যায়।
নির্বাচন নিয়ে দেশের বিশিষ্টজনরা তাদের অভিমত ব্যক্ত করে চলেছেন বিভিন্ন মাধ্যমে। পত্র-পত্রিকার সংবাদ, নিবন্ধ এবং টিভি টক শো’তে তারা তাদের দৃষ্টভঙ্গীপ্রসূত বক্তব্য দিচ্ছেন। তাদের বক্তব্যে ভিন্নতা হয়তো আছে। তবে, একটি বিষয়ে তারা একমত যে, নির্বাচনকে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে রেফারির ভূমিকা পালন করতে হবে। নির্বাচন কমিশন যদি সে ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়, তাহলে যে নির্বাচনের জন্য সবাই চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে, তা হয়তো সোনার হরিণ হয়েই থাকবে।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (3)
Maruf Uddin Nirub ১৭ নভেম্বর, ২০১৮, ৯:৫৮ এএম says : 0
এইদেশে খুনের ছেয়ে গাড়ি পোড়ানো অপরাধের শাস্তি বেশী।
Total Reply(0)
Rafiqul Islam ১৭ নভেম্বর, ২০১৮, ৯:৫৮ এএম says : 0
Whole Nations knows that Helmet used by .......................
Total Reply(0)
Mari ২৬ নভেম্বর, ২০১৮, ১১:৩৪ পিএম says : 0
It is the best time to make some plans for the future and it is time to be happy.
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন