আহমেদ নূর : কিছু দিন আগে শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা এবং অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা দুটি নাকি কোনো পাবলিক পরীক্ষা নয়, এগুলো শ্রেণি-উত্তীর্ণের পরীক্ষা মাত্র। অথচ দেখা যায় সম্পূর্ণরূপে অন্যান্য পাবলিক পরীক্ষার আদলে পরীক্ষা দুটি গ্রহণ করা হয়। যেমন- অন্যান্য পাবলিক পরীক্ষার মতো পরীক্ষা দুটির জন্য পরীক্ষার্থীরা সরকারিখাতে নির্দিষ্ট ফি প্রদান করতে হয়, নিজ বিদ্যালয়ে নয়, অন্য একটি বিদ্যালয়ে গিয়ে পরীক্ষা দিতে হয়, প্রশ্ন তৈরি করা হয় জাতীয় পর্যায়ে, পরীক্ষা চলাকালীন সরকারি কর্মকর্তা কর্তৃক সার্বক্ষণিক পরীক্ষা পরিদর্শন করা হয়, উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হয় সরকারিভাবে, সংবাদমাধ্যমে ঘোষণা করে ঢাকঢোল পিটিয়ে নির্দিষ্ট তারিখে ফলাফল প্রকাশ করা হয়, ফলাফল গ্রেডিং পদ্ধতিতে প্রকাশ করা হয়, এমনকি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের সরকারি সার্টিফিকেটও প্রদান করা হয়। অন্যান্য পাবলিক পরীক্ষার সাথে এতো সব মিল থাকা সত্ত্বেও কেন এ পরীক্ষা দুটিকে পাবলিক পরীক্ষা বলা যাবে না, তা বোধগম্য নয়।
আমরা জানি, যেভাবে মাত্র এসএসসি পরীক্ষার সার্টিফিকেট দিয়েই অনেক চাকরি পাওয়া যায়, তেমনি অষ্টম শ্রেণির সার্টিফিকেট দিয়েও বিভিন্ন সরকারি অফিসে চাকরি নেয়া যায়। তবে পঞ্চম শ্রেণির সার্টিফিকেট এখনও কর্মক্ষেত্রে কোনো কাজে আসে না। এজন্য অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষার সাথে অন্যান্য পাবলিক পরীক্ষার উল্লেখযোগ্য কোনো বৈসাদৃশ্য আর থাকে না। শুধু পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষার সাথে মাত্র এ একটি পার্থক্য থাকে। মাত্র একটি পার্থক্য দিয়ে পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষাকে অন্য পাবলিক পরীক্ষাগুলো থেকে আলাদা করা যায় কিভাবে, যখন সেগুলোর সাথে পরীক্ষাটির তাৎপর্যপূর্ণ অনেক মিল রয়েছে?
পরীক্ষা দুটিকে শ্রেণি-উত্তীর্ণের পরীক্ষা বলারও কী অর্থ থাকতে পারে, যখন শ্রেণি-উত্তীর্ণের অন্য পরীক্ষাগুলো থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে এ পরীক্ষা নেয়া হয়? শ্রেণি-উত্তীর্ণের পরীক্ষা বলতে হলে পরীক্ষাগুলো আগের মতো তৃতীয়, চতুর্থ বা ষষ্ঠ, সপ্তম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার মতোই নিতে হবে। যতোদিন এগুলো আগের মতো নেয়া না হবে, ততোদিন এগুলোকে ‘পাবলিক পরীক্ষা’ হিসেবেই মানুষ গুরুত্ব দেবে।
২০১৫ সালের পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায় আমাদের বিদ্যালয়ের চারজন খুব মেধাবী শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পায়নি মাত্র ইংরেজিতে ‘এ’ গ্রেড পাবার কারণে। অথচ অন্যান্য পাবলিক পরীক্ষায় একজন শিক্ষার্থী সবগুলো বিষয়ে ‘এ প্লাস’ না পেলেও জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষাও এক্ষেত্রে অন্যান্য পাবলিক পরীক্ষার মতোই। শুধু প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা ব্যতিক্রম। পঞ্চম শ্রেণীতে যখন মাত্র এক বিষয়ে ‘এ’ গ্রেড পেলেই তার ‘এ প্লাস’ মিস হয়ে যায়, তখন অষ্টম, এসএসসি, এইচএসসি এসব পরীক্ষায় তিন-চার বিষয়ে ‘এ’ গ্রেড পেলেও গড় ফলাফলে ‘এ প্লাস’ কিন্তু মিস হয় না! এদিক থেকে বলা যায় পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষাটা অন্যান্য পাবলিক পরীক্ষার চেয়েও উচ্চস্তরের পাবলিক পরীক্ষা!
দেখা যায়, পঞ্চম শ্রেণিতে একজন শিক্ষার্থী এক বা একাধিক (সর্বোচ্চ পাঁচ) বিষয়ে ৯০ বা ৯৫-এর উপরে নাম্বার পাবার পরও অন্য একটি বিষয়ে ৮০ থেকে একটু কম নাম্বার পাবার কারণে ‘এ’ গ্রেডে উত্তীর্ণ হয়, অথচ কেউ কেউ সব বিষয়ে মাত্র ৮০ থেকে ৮৫ নাম্বার পেয়েও ‘এ প্লাসে’ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। এটা কি মেধাবী শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের কোনো মাপকাঠি হলো? এসব কারণে এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে অযৌক্তিক কারণে অনাকাক্সিক্ষত ফলাফল করে মেধাবী শিক্ষার্থীরা যেমন হতাশ হয়, তেমনি সংশ্লিষ্ট শিক্ষক এবং অভিভাবকগণও যারপরনাই ব্যথিত ও হতাশ হন। পঞ্চম শ্রেণিতে অতিরিক্ত বিষয় বা গ্রুপিয়াল বিষয় না থাকলেও সমস্যাটির কোনো যৌক্তিক সমাধান কি নেই? উপযুক্ত কোনো সমাধান খুঁজে না পেলে অযৌক্তিক পরীক্ষাটি থেকে শিশু, অভিভাবক ও শিক্ষকদের মুক্তি দেয়াই শ্রেয়।
শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধের জন্য সরকার খুবই আন্তরিক। ঝরে পড়া রোধের জন্য সরকারের নানা উদ্যোগ প্রশংসনীয়। সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক শিক্ষায় পরিণত করেছে, বিনামূল্যে বই দিচ্ছে, উপবৃত্তি প্রদান করছে, অনেক বিদ্যালয়ে মিড-ডে মিলের ব্যবস্থাও করেছে। তবু ঝরে পড়ার কিছু ক্ষেত্র থেকেই যাচ্ছে। চতুর্থ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হওয়া এক শিক্ষার্থীর মা সেদিন আমাদের বিদ্যালয় অফিসে এসে কান্নামাখা কণ্ঠে বললেন, তার ছেলে পঞ্চম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ না হবার কারণে তার স্বামী নাকি তাকে এবং তার ছেলেটিকে প্রহার করেছে। এরকম অপ্রীতিকর ঘটনার কথা আমরা আর কখনো শুনিনি। প্রমোশন না দিলে ছেলেটি পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে বখে যাবে এমন আশঙ্কা তার বাবা-মা উভয়ের। কিন্তু তিন তিনটি বিষয়ে অকৃতকার্য হওয়া ছেলেটিকে পঞ্চম শ্রেণিতে প্রমোশন দিলে সে সমাপনী পরীক্ষায়ও অনুত্তীর্ণ হবার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ সবার মেধা সমান হয় না প্রকৃতিগত কারণেই। আর শত ফিডব্যাকেও কিছু কিছু শিক্ষার্থীকে পাশের যোগ্য করে গড়ে তোলা যায় না। এজন্য সমস্যা উভয়ের- শিক্ষক এবং অভিভাবক। এরকম শিক্ষার্থীদের প্রমোশন না দিলে এরা অনেক সময় ঝরে পড়ে আবার প্রমোশন দিলে সমাপনী পরীক্ষায় এদের পাশ করানো নিয়ে শিক্ষকরা মহাদুশ্চিন্তায় পড়ে যান। অনেক বিদ্যালয়ে এরকম অতি দুর্বল শিক্ষার্থীদের তাই প্রমোশন না দেয়ার ঘটনাও ঘটে। সমাপনী পরীক্ষা না হলে এসব শিক্ষার্থী তাই অন্ততঃ আরেকটা শ্রেণিতে অধ্যয়নের সুযোগ পেতো।
পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা নিয়ে আরো কিছু কথা রয়েছে। অনেক অভিভাবক তাদের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়–য়া বাচ্চার উপর পড়ালেখার জন্য অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে থাকেন যাতে খেলার সময়টুকুতেও বাচ্চাটি স্বচ্ছন্দ্যে খেলতে পারে না, সময়মতো ঘুমোতে যেতে পারে না। বাচ্চা যেনো জিপিএ-৫ পেতে পারে, সেজন্য তাকে একাধিক টিউটরের কাছে পড়তে দিয়ে অভিভাবকগণ একদিকে যেমন নিজেদের পকেট খালি করেন, অপরদিকে বাচ্চার সামান্য অবসর সময়টুকুও ছিনিয়ে নেন। অনেক বিদ্যালয়ে শিক্ষকরা পঞ্চম শ্রেণির জন্য কোচিংয়ের ব্যবস্থা করেন এবং মোটা অংকের কোচিং ফিও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করেন। অনেক বিদ্যালয়ে আবার শিক্ষকরা পঞ্চম শ্রেণিকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিতে গিয়ে অন্যান্য শ্রেণিতে ঠিকমতো পাঠদান করতে পারেন না। অধিক যোগ্য শিক্ষকরা পঞ্চম শ্রেণিকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। সমাপনী পরীক্ষাই শিশুদেরকে সরকার-নির্ধারিত বিনামূল্যে সরবরাহকৃত ছয়টি পাঠ্যবইয়ের বাইরে বিশালাকৃতির দামী গাইডবই কিনতে এবং বহন করতে পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করছে। শুধু গাইড নয়, ‘মডেল টেস্ট’, ‘টেস্ট পের্পাস’ এরকম অনেক অতিরিক্ত বই কিনতেও অনেকটা বাধ্য করছে এ সমাপনী পরীক্ষা। সমাপনী পরীক্ষার জন্য প্রশ্নকাঠামো এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়, শিক্ষার্থীরা শুধু পাঠ্যবই অধ্যয়ন করে সমাপনী পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেয়ার অবকাশ থাকে না। পাঠ্যবইবহির্ভূত প্রশ্নগুলো সম্পর্কে ধারণা লাভের জন্য এবং সেগুলো চর্চা করার জন্য তারা গাইড-মডেল টেস্ট এসবের দ্বারস্থ হতেই হয়।
আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষার কেন্দ্র সাধারণতঃ প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন কোনো উচ্চ বিদ্যালয়ে হয়ে থাকে। দেখা যায় অনেক কেন্দ্রে স্বাগতিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সংশ্লিষ্ট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের (যিনি কেন্দ্র সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন) যোগসাজশে নিজেদের পরীক্ষার্থীদের কক্ষে পরিচিত কক্ষ-পর্যবেক্ষক দিয়ে থাকেন এবং নিজেদের বাচ্চাদের ভালো ফলাফল নিশ্চিত করেন, যা প্রতিযোগিতায় পার্শ্ববর্তী অন্যান্য বিদ্যালয়কে পেছনে ফেলে দেয়। সেক্ষেত্রে পার্শ¦বর্তী বিদ্যালয়গুলোর ফলাফল স্বাগতিক বিদ্যালয়ের অস্বাভাবিক ফলাফলের তুলনায় মøান হয়ে যাওয়ায় সেসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ ব্যথিত এবং হতাশ হন। ২০১৫ সালে একটা কেন্দ্রে এমনও হয়েছে বলে জানা যায়, একজন কক্ষ-পর্যবেক্ষককে পরপর চার দিন একই কক্ষে (স্বাগতিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরীক্ষার্থীদের কক্ষ) দেখে কেন্দ্রের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা চতুর্থদিন তাকে সেখান থেকে সরিয়ে অন্য কক্ষে নিয়ে যান। এছাড়া মফস্বলে বা গ্রামাঞ্চলে অনেক কেন্দ্রে পরীক্ষার্থীরা একজন অন্যজন থেকে দেখে দেখে পরীক্ষা দেয়ার জন্য সুযোগ করে দেয়া হয়, যাতে কেউ অন্ততঃ ফেল না করে। কোথাও কোথাও আবার কক্ষ পর্যবেক্ষকগণ অতি উৎসাহী হয়ে পরীক্ষার্থীদেরকে ‘পাস নাম্বার’ বলে দেয়ার কথাও শোনা যায়। তাছাড়া পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নেও ছাড় এবং শিথিলতার জন্য পরীক্ষকদের জন্য ‘উপর’ থেকে নানারকম লিখিত ও মৌখিক নির্দেশনা দেয়া হয়ে থাকে, যা এমনকি বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার বেলায়ও হয় না। কিছুদিন আগে মিডিয়ায় বেশ সাড়া জাগানো একটা গবেষণায়ও এমন চমকপ্রদ কিছু তথ্য বেরিয়ে আসে। এমন ঢিলেঢালা ‘পাবলিক পরীক্ষা’ চালু রাখার কী প্রয়োজন?
নতুন শিক্ষা আইনে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করা হচ্ছে। অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষাই হবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা। পঞ্চম শ্রেণিতে বর্তমানে প্রচলিত এই সমাপনী পরীক্ষা আর থাকছে না। ২০১৮ সালের মধ্যে প্রাথমিককে অষ্টম শ্রেনিতে উন্নীত করার জন্য সরকার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। অর্থবহ এবং যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে। প্রাথমিককে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সম্প্রসারিত করার প্রক্রিয়া যখন চলছেই তখন পঞ্চম শ্রেণির এই সমাপনী পরীক্ষা চালু রেখে আর কী লাভ? ২০১৬ সাল থেকেই পরীক্ষাটি বন্ধ করে দেয়া হোক। অন্যদিকে অষ্টম শ্রেণির সার্টিফিকেট যেহেতু অনেক সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয়, তাই অষ্টম শ্রেণির পরীক্ষাটি চলমান রাখা যেতে পারে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, দত্তপাড়া, লক্ষ্মীপুর।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন