এসএম আলী আহসান পান্না, কুষ্টিয়া থেকে
কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে আসন্ন ইউপি নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা বেশ জমে উঠেছে। চা দোকান থেকে শুরু করে সবখানে এখন নির্বাচনী আলাপ-আলোচনার ঝড় বইছে। ভোটার এবং সাধারণ মানুষ চুলচেরা বিশ্লেষণ করে প্রার্থীর পক্ষে-বিপক্ষে মতামত ব্যক্ত করছেন। এদিকে সরকার দলীয় বেশ কয়েকজন মনোনয়ন না পাওয়া যোগ্য প্রার্থীসহ আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের নিয়ে স্থানীয় নেতারা চরম বেকায়দায় পড়েছেন। এসব বিদ্রোহী প্রার্থীকে সামাল দিতে নেতারা হিমশিম খাচ্ছেন। বর্তমানে দলীয় গ্রুপিং উঠেছে তুঙ্গে। উপজেলা আওয়ামী লীগ বিদ্রোহী প্রার্থীসহ ১৮ জন নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করায় দলীয় গ্রুপিং নতুন মোড় নিয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই মারামারি ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটছে। সরকারি দলের মধ্যে এমপি আব্দুর রউফ, উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান খান ও জেলা পরিষদের প্রশাসক জাহিদ হোসেন জাফর গ্রুপের মধ্যে ইউপি নির্বাচন কেন্দ্র করে দলীয় গ্রুপিং প্রতিনিয়ত চমক দিচ্ছে। কোন কোন ইউপিতে এই গ্রুপিংয়ের কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। দিনদিন বাড়ছে ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা। কুমারখালী উপজেলার ১১টি ইউপিতে আগামী ৭ মে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কুমারখালী উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আবু আনছার আলী জানান, ৫১ জন চেয়ারম্যান, ৪শ’ ৯৩ জন মেম্বার ও সংরক্ষিত আসনের মহিলা মেম্বার দলীয় ও স্বতন্ত্রভাবে নিজ নিজ প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। প্রার্থীরা সবাই মূলত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী। প্রধান দুইদল আওয়ামী লীগ বিএনপি ছাড়াও জাসদ, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন, তরীকত ফেডারেশন ও মনোনয়ন না পাওয়া স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেন। উপজেলার ১নং কয়া ইউপিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন কয়ার সাবেক শক্তিমান চেয়ারম্যান জামিল হোসেন বাচ্চুর স্ত্রী সাদিয়া জামিল কতা। এখানে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যান ও কুষ্টিয়া জেলা যুবলীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক জিয়াউল ইসলাম স্বপন। এছাড়াও বিএনপির শরিফুল ইসলাম মালিথা, বিএনএফ এর হেলাল উদ্দিন মেম্বার, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের আলী, জাসদের মুফাজ্জেল হোসেনসহ জুলফিকার আলী জিলুø মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। পদ্মা পাড়ের ১১নং চরসাদীপুর ইউপিতে জামায়াতে ইসলামীর বারবার নির্বাচিত চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম বয়েন বিএনপির প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। অন্যদিকে এই ইউপিতে আওয়ামী লীগের রয়েছে একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী। নৌকার মাঝি হয়েছেন তোফাজ্জেল হোসেন। এখানে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা হলেন- হাসিম আলী, ইকবাল হোসেন ও মেসের আলী। এছাড়াও জাসদের ইউপি সাধারণ সম্পাদক আবু বকর ও ইসলামী শাসনতন্ত্রের মহসিন আলী প্রার্থী হয়েছেন। উপজেলার শহরতলীর ৪নং সদকী ইউপিতে বিএনপি থেকে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যান লুৎফর রহমান। নৌকা প্রতীক পেয়েছেন মিজানুর রহমান জুয়েল। এখানেও রয়েছে আওয়ামী লীগের ২ জন বিদ্রোহী প্রার্থী। তারা হচ্ছেন- দুই সহোদর আবদুল মজিদ ও রবিউল আউয়াল। এছাড়াও জাসদের কামরুজ্জামান মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। সদকী ইউপিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়নে সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছে বলে দলীয় অধিকাংশ কর্মী মতামত দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগের কর্মীরা জানান, সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল করিমের ছেলে উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি, ইউপি আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি আব্দুল মজিদকে মনোনয়ন দেয়া সঠিক ছিল। কিন্তু আব্দুল মজিদ আব্দুর রউফ গ্রুপের সমর্থক হওয়ায় তিনি মনোনয়ন পাননি বলে কর্মীরা মনে করছেন। তবে বিদ্রোহী হলেও আব্দুল মজিদ গত নির্বাচনের ফলাফলের মতো এবারও লুৎফরের সাথে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। ৫নং নন্দলালপুর ইউপিতে নৌকার কা-ারি হয়েছেন নওশের আলী। এখানে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী দানবীর আলাউদ্দিন আহমেদের ভাতিজা বর্তমান চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান খোকন মশাল প্রতীক নিয়ে শক্ত অবস্থানে আছেন। আওয়ামী লীগের এই দুই প্রার্থীর বিরুদ্ধে ধানের শীষ নিয়ে লড়ছেন বিএনপি নেতা আবুল কালাম আজাদ। এছাড়াও জামায়াতে ইসলামীর সাবেক শক্তিমান বারবার নির্বাচিত চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম (স্বতন্ত্র) প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে লড়ছেন বেশ ফুরফুরে মেজাজে। এখানে জিয়াউর রহমান খোকন ও নজরুল ইসলামের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ৩নং জগন্নাথপুর ইউপিতে দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর অবশেষে ধানের শীষ প্রতীক পেয়েছেন ইউনিয়নের পরীক্ষিত নেতা বলে পরিচিত এসএম কামরুজ্জামান (কামরুল খাঁ)। এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন ইউপি আওয়ামী লীগের সভাপতি ফারুক আহমেদ খান। বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছে আব্দুল্লাহ-আল বাকী বিল্লাহ বাদশাহ। এছাড়াও মেহেদী হাসান ও তোতা মিয়া চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন। ৮নং পান্টি ইউপিতে বিএনপির বারবার নির্বাচিত জনপ্রিয় চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমানের সাথে নৌকার প্রতীক নিয়ে নির্বাচনী লড়াই করছেন জেলা পরিষদের প্রশাসক জাহিদ হোসেন জাফরের জামাতা সামিউল মিয়া সুমন। এছাড়াও আমির হোসেন জুয়েল, আবু হুরায়রা, মাসুদ হোসেন মন্জু ও জেবুন নাহার বেগম স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। উপজেলার ৯নং বাগুলাট ইউপিতে নৌকার মাঝি হয়েছেন আলী হোসেন। বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন আলাউদ্দিন। এখানে ধানের শীষের কা-ারি হয়েছেন ইব্রাহিম শামিম। এছাড়াও স্বতন্ত্রপ্রার্থী হয়েছেন জামায়াত সমর্থিত ইউপির বারবার নির্বাচিত জনপ্রিয় শক্তিমান চেয়ারম্যান মাওলানা শামসুদ্দিন আহমাদ। ধারণা করা হচ্ছে, মাওলানা শামসুদ্দিন আহমাদের সাথেই অন্য প্রার্থীরা তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হবেন। ১০নং চাঁদপুর ইউপিতে ধানের শীষের পক্ষে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন মীর একলাসুর রহমান। নৌকা নিয়েছেন নজরুল ইসলাম। এখানে বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছে রাশেদুজ্জামান ও কামরুজ্জমান। এছাড়াও কাজী মমিনুল ইসলাম, সাজেদুর রহমান, ইলিয়াস খান চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন। উপজেলা অবহেলিত ৬নং যদুবয়রা ইউনিয়নে বিএনপির তেমন শক্তিশালী প্রার্থী নেই। তবুও ধানের শীষের মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন নুরুল ইসলাম আসাদ। নৌকার প্রার্থী হয়েছেন সাবেক চেয়ারম্যান শরিফুল আলম। যদুবয়রা ইউপিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছে কামরুজ্জামান সাবু। এছাড়াও গোলাম মোস্তফা, কাজী আমিনুল চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন। ৭নং চাপড়া ইউপিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী করা হয়েছে মনির হাসান রিন্টুকে। এখানেও বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছে সরকার দলীয় বর্তমান চেয়ারম্যান এনামুল হক মন্জু। চাপড়াতে ধানের শীষের কা-ারি হয়েছেন সাইদুর রহমান মিন্টু। এছাড়াও ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের ছানাউল্লাহ, তরীকত ফেডারেশনের সাজেদুল ইসলাম মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে। এই ইউনিয়নেও আওয়ামী লীগের দলীয় গ্রুপিং চরম পর্যায়ে বিরাজ করছে। এদিকে রবীন্দ্র তীর্থভূমি ২নং শিলাইদহ ইউনিয়নে বর্তমান চেয়ারম্যান ছাড়া অন্য কেউ চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেননি। সেজন্য উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শক্তিমান নেতা সালাহ্ উদ্দিন আহমেদ খান তারেক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৩য় বারের মতো নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। কুমারখালী উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের নির্বাচনী মাঠ-ময়দান এখন বেশ সরগরম। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীরা অনেকটাই ধরে নিয়েছেন তারা যে কোনো মূল্যেই বিজয়ী হবেন। ফলে দলীয় গ্রুপিং চরম আকার ধারণ করেছে। উত্তপ্ত হয়ে উঠছে সার্বিক পরিস্থিতি। অন্যদিকে অন্যান্য রাজনৈাতিক দলের প্রার্থী, বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্রপ্রার্থীরা সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন। তবে ৫১ জন চেয়ারম্যান, ৪৯৩ জন মেম্বার ও সংরক্ষিত মহিলা মেম্বার প্রার্থীর মধ্যে কে কে শেষ বিজয়ের হাসি হাসবেন, পরবেন বিজয়ের মালা সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আগামী ৭ মে পর্যন্ত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন