মুহাম্মদ আলতাফ হোসেন খান
শিক্ষা আইন ২০১৬ প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০১১ সালে শিক্ষা আইন প্রণয়নের কাজ শুরু হলেও এখনো শিক্ষা আইন আলোর মুখ দেখেনি। ৩ এপ্রিল শিক্ষা আইনের খসড়াটি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়। এই খসড়ার ওপর শিক্ষাবিদ ও সমাজের সব স্তরের জনগণের এবং দেশের সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কোনো মতামত বা পরামর্শ থাকলে ১০ এপ্রিল ২০১৬ তারিখের মধ্যে নির্ধারিত ই-মেইলে পাঠানোর অনুরোধ করা হয়। খসড়া এই শিক্ষা আইনে অনেক ইতিবাচক দিক থাকলেও বড় বড় অপরাধের জন্য লঘু শাস্তির বিধান যুক্ত হওয়ায় বিষয়টি পুনরায় চিন্তার সুযোগ তৈরি করেছে। শিক্ষা আইনের এই খসড়া নিয়ে আবারও আলোচনা-সমালোচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে।
এত দিন শিক্ষা আইন না থাকায় কাগজে-কলমে থেকে যাওয়া জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের জারিকৃত নির্দেশনা বা নীতিমালা অনুযায়ী শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। দেশে শিক্ষায় অনিয়ম, দুর্নীতি, কোচিং বাণিজ্য, প্রশ্নপত্র ফাঁস ও জালিয়াতি, শিক্ষানীতি অবজ্ঞাসহ নানা ধরনের অপরাধপ্রবণতা ব্যাপক হারে বেড়েছে। আর এ সবকিছু যেন স্বাভাবিকে পরিণত হয়েছে। উল্লিখিত অপরাধ রোধকল্পে দেশের প্রচলিত আইনে তেমন কার্যকর বিধান নেই কিংবা যেগুলো আছে সেগুলো যথাযথভাবে প্রতিপালিত হয় না বললেই চলে। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে নানা ধরনের অপরাধ করেও অপরাধীরা অনেকে রক্ষা পেয়ে যাচ্ছে সহজেই। ইতিপূর্বে নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেও কোচিং বাণিজ্য ও প্রশ্নপত্র ফাঁস পুরোপুরি ঠেকানো সম্ভব হয়নি। প্রশ্নপত্র ফাঁসে নানাবিধ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও অপরাধীরা নতুন নতুন কৌশল বের করে এই অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। কিন্তু অপরাধীদের যথাযথ শাস্তির আওতায় আনতেও দেখা যায়নি। এ ছাড়া কোচিং ও নোট কিংবা গাইড বইয়ের ব্যবসা রীতিমতো রমরমা। ব্যবসার ধরন ও সাইনবোর্ড দেখে মনে হয়, সরকারি লাইসেন্স নিয়েই তারা ব্যবসা পরিচালনা করছে। যদিও প্রকারান্তরে তেমনটিই চলছে বললে ভুল হবে না। প্রস্তাবিত নতুন শিক্ষা আইনের খসড়ায় কোনো ধরনের নোট বা গাইড বই প্রকাশ করলে অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদ-ে অথবা ছয় মাসের কারাদ- অথবা উভয় দ-ে দ-িত হইবেন। যা অত্যন্ত লঘু হয়েছে বলে মনে হয়। পাবলিক পরীক্ষাসমূহ (অপরাধ) আইন, ১৯৮০ এবং সংশোধনী ১৯৯২-এ প্রশ্ন ফাঁসের অপরাধের জন্য ন্যূনতম তিন বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদ-সহ অর্থদ-ের বিধান থাকলেও শিক্ষা আইনের খসড়ায় সুনির্দিষ্ট কোনো বিধান নেই।
প্রস্তাবনা অনুসারে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বেতন ও অন্যান্য ফি সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে। এই বিধান লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা অর্থদ-, এক বছরের কারাদ-ের প্রস্তাব রয়েছে। এ ছাড়া উচ্চশিক্ষা স্তরের সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বেতন ও অন্যান্য ফিও সরকার বা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। আর এই দাবি নিয়ে আমি বহুবার লিখেছি, যা এখন বাস্তবায়নের অপেক্ষা বলে মনে করছি। শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন, পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োজনীয় পরামর্শের জন্য একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন করার কথাও খসড়ায় রয়েছে। আবার ‘শিক্ষানীতি ২০১০’ অনুযায়ী শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল চালুর কোনো সুনির্দিষ্ট বিধান রাখা হয়নি। কিন্তু শিক্ষকদের বেতন কাঠামোর সঙ্গে শিক্ষার মান ও মর্যাদা বহুলাংশে নির্ভরশীল। কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কোনো বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শাখা ক্যাম্পাস, স্টাডি সেন্টার বা টিউটরিয়াল কেন্দ্র স্থাপন করলে অনূর্ধ্ব পাঁচ বছর কারাদ- অথবা ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদ- অথবা উভয় দ-ে দ-িত হওয়ার বিধান রাখা হয়েছে যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। অন্যদিকে বাংলা ও ইংরেজি উভয় মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলাদেশ স্টাডিজ পাঠের বিষয়ে বাধ্যতামূলক বিধান থাকলেও তা অমান্য করলে শাস্তি সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট বিধানের উল্লেখ নেই।
নানাবিধ সুবিধা-অসুবিধার সমন্বয়ে শিক্ষা আইনের খসড়াটি ওয়েবসাইটে প্রকাশ পেলেও আমরা আশা করি, সবার গঠনমূলক মতামত সাপেক্ষে বিদ্যমান অসংগতি দূরীভূত হয়ে যথাযথ আইন সংসদে পাস হবে। এমন ইতিবাচক প্রত্যাশা সত্ত্বেও একটি প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে যে শিক্ষা আইন পাস হলেই কি আইনে বর্ণিত বিধিবিধান যথাযথভাবে প্রয়োগ হবে? শিক্ষার উন্নয়ন ঘটবে? কেননা এর আগে কোচিং বাণিজ্য বন্ধে সরকারের উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ থাকা সত্ত্বেও তা বন্ধ হয়নি। বরং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোচিং কার্যক্রম পরিচালনায় এক ধরনের বৈধতা পেয়েছে সংশ্লিষ্টরা। প্রাক-প্রাথমিক থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থাকে আইনি কাঠামোতে আনা এবং সবার জন্য বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক ও মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর আলোকে ‘শিক্ষা আইন’ প্রণয়নের উদ্যোগ বারবার নিলেও কেন তা বাস্তবায়ন হয়নি তা নিয়ে সবার মনে একটি ধোঁয়াশা রয়েই গেছে। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে শিক্ষা আইন প্রণয়নের প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় এবং এ বিষয়ে শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির কয়েকজন সদস্যকে শিক্ষা আইনের খসড়া তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই কমিটি ২০১২ সালে শিক্ষা আইনের খসড়া তৈরি করে।
পরে ২০১৩ সালের ৫ আগস্ট জনমত যাচাইয়ের জন্য শিক্ষা আইনের খসড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। খসড়া আইনের ওপর নানাবিধ মতামত এলেও পরবর্তী সময়ে আইন পাস হয়নি। এরপর ২০১৪ সালে আবারও আইন প্রণয়নে উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও তা এখনো উদ্যোগ হিসেবেই থেকে গেছে। আবার ২০১৫ সালের ২০ অক্টোবর মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে শিক্ষা আইনের খসড়া প্রকাশ করা হলে খসড়াটি ব্যাপক সমালোচনায় পড়লে পরবর্তী সময়ে তা আর সামনে আসেনি। এরপর চলতি মাসের ৩ তারিখে আবারও মতামত চেয়ে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। মতামত পাওয়ার পর আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া অংশ হিসেবে ক্যাবিনেট হয়ে সংসদে এটি পাস হওয়ার কথা। বারবার উদ্যোগ সত্ত্বেও গত পাঁচ বছরে যেটি করা সম্ভব হয়নি, এবার কি তা করা সম্ভব হবে?
ষ লেখক : কলামিস্ট, সমাজকর্মী
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন