শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংসদ নির্বাচন

দক্ষিণাঞ্চলে মনোনয়ন-দুই প্রধান জোটে সংশয়-সন্দেহ

বিশেষ সংবাদদাতা, বরিশাল | প্রকাশের সময় : ২৯ নভেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

প্রধান দুটি দলের খসড়া প্রার্থীতা ঘোষনার পর দক্ষিণাঞ্চলের রাজনীতিতে কিছুটা নির্বাচনী আবহ শুরু হলেও এখনো আমজনতার মূল প্রশ্ন একটি।আর সেটি হচ্ছে ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে।’ দুই প্রধান দলেরই বেশীরভাগ পুরনো প্রার্থী আসন্ন নির্বাচনে ফিরে আসছেন। এমনকি সেনা সমর্থিত কথিত তত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের সংস্কারবাদীরাও মূল শ্রোতে ফিরলেও মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের কাছে তাদের গ্রহনযোগ্যতা নিয়ে এখনো সংশয় রয়ে গেছে। ভোটের ফলাফল কোন দিকে যাবে তা নিয়ে এখনো কোন আগ্রহ ও আলোচনা নেই দক্ষিনাঞ্চলের সাধারন মানুষের মধ্যে। সবার মুখেই প্রশ্ন, কোন জোট কাকে চুড়ান্ত মনোনয়ন দিচ্ছে এবং একটি সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ সহ অবাধ ও নিরপেক্ষ ভোট হবে কিনা।

গত রোবরাব ও সোমবার আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি আংশিক মনোনয়ন ঘোষনার পরও এখনো অনেক ধোয়াশা রয়ে গেছে সাধারন মানুষের মধ্যে। দুই দলেরই মনোনয়ন তালিকায় বিভিন্ন আসনে একাধিক প্রার্থীর নাম রয়েছে। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপির তালিকা ভারি। দক্ষিনাঞ্চলের ২১টি সংসদীয় আসনের ২০টিতেই বিএনপি দুই থেকে তিনজন করে প্রার্থীর নাম ঘোষনা করেছে। কৌশলগত কারনেই এটা করা হয়েছে বলে দলের দায়িত্বশীল সূত্রে বলা হয়েছে। অনেক প্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলা সহ নানা জটিলতার কারনেই দলের পক্ষ থেকে প্রতিটি আসনেই বিকল্প প্রার্থী ঠিক রাখার কথা বলা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
অপরদিকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও একাধিক আসনে বিকল্প প্রার্থী রাখা হয়েছে। এমনকি বেশ কয়েকজন বিতর্কিত প্রার্থীও এলাকায় নেতা-কর্মী ও সাধারন মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। বরিশাল-৪ আসনে পঙ্কজ দেবনাথ, পটুয়াখালী-২ আসনে আ স ম ফিরোজ, বরগুনা-১ ও ২ আসনে যথাক্রমে ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু ও শওকত হাচানুর রহমান রিমন রয়েছেন। তবে পিরোজপুর-১ আসনে আবদুল আউয়ালকে মনোনয়ন না দিয়ে দলীয় নেতৃবৃন্দ যে যথেষ্ঠ বিচক্ষনতার পরিচয় দিয়েছন, সে বিষয়ে সকলেই একমত।
এর পরেও বরগুনায় ’৭১-এর পীস কমিটির চেয়ারম্যানের ছেলে এবং পটুয়াখালীতে ’৭৫-এর ১৫আগষ্ট বরিশাল আওয়ামী লীগ অফিস থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি নামিয়ে রাস্তায় ফেলে উল্লাসকারীকে আবারো মনোনয়ন দেয়ায় হতাশ ও ক্ষুদ্ধ মূক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সাধারন মানুষসহ বেশীলভাগ নেতা-কর্মী।
এদিকে বরিশাল বিভাগীয় সদর আসনে চারবার বিজয়ী মুজিবুর রহমান সারোয়ারের মনোনয়ন প্রতীক্ষিত থাকলেও বরিশাল-২ আসনে মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ও বরিশাল-৩ আসনে সেলিমা রহমান-এর মনোনয়ন নিয়ে বিএনপি এখনো দোটানায়। মনোনয়ন নিয়ে সঠিক রাস্তায় না হাটলে অবারো হোচট খেতে হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল। একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হলে এসব আসনে ভোটের লড়াই জমবে বলেও মনে করছে মহলটি।
সোমবার সারোয়ারের মনোনয়ন ঘোষণার পরে উল্লাসিত বরিশাল মহানগরীর বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। সন্ধার পরে দলীয় কার্যালয়ে শোকরানা মিলাদও অনুষ্ঠিত হয়েছে। অপরদিকে আওয়ামী লীগসহ মহাজোটের পক্ষ থেকে বরিশাল বিভাগীয় সদর আসনে সাবেক সেনা কর্মকর্তা জাহিদ ফারুখ শামিম মনোনয়ন পেলেও বিষয়টি নিয়ে খুব একটা খুশি হতে পারছেনা দলীয় নেতা-কর্মীরা। গত কয়েকদিন ফারুখের মনোনয়ন নিয়ে বরিশাল মহানগরীতে সর্বমহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা লক্ষ্য করা গেছে। দলীয় নেতা-কর্মীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই বিষয়টি খুব ভালভাবে মেনে নিতে পারছে না। অনেক কর্মী তাকে ভালমত চেনেনা বলেও মন্তব্য করেছেন।
২০০৮-এর সেনা সমর্থিত সরকারের সময়ের নির্বাচনে লীগের মনোনয়নীত তবে পরাজিত কর্ণেল (অবঃ) শামিমের গত প্রায় দশ বছর বরিশালের মাটি ও মানুষের সাথে তেমন কোন যোগাযোগ ছিলনা। অপরদিকে মুজিবুর রহমান সারোয়ার ১৯৯১-এর ডিসেম্বরে বরিশাল সদর অসনের উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শক্ত প্রতিদ্ব›দ্বীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে প্রথমবারের মত জাতীয় সংসদে পা রাখেন। স্পীকার আবদুর রহমান বিশ্বাস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় বরিশাল সদর আসনটি শূণ্য হয়। ১৯৯৬-এর ১২ জুনের নির্বাচনে এ আসনে সরোয়ারের পরিবর্তে প্রেসিডেন্ট বিশ্বাসের পুত্র ডাঃ নাসিম বিশ্বাসকে মনোনয়ন দেয়া হয়। ১৯৯৮-এর মধ্যভাগে নাসিম বিশ্বাসের অকাল মৃত্যুতে সদর আসনটি শূণ্য হয়। ঐ বছরই আগষ্টে উপ-নির্বাচনে চরম প্রতিক‚লতার মধ্যেও সরোয়ার আবার এমপি নির্বাচিত হন। ২০০১-এর নির্বাচনে তিনি ১ লাখ ৮ হাজার ৪১২ ভোট পেয়ে প্রায় ৫৬ হাজারের ব্যবধানে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে পরাজিত করেন। ২০০২-এর মার্চে বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনেও তিনি আওয়ামী লীগ সহ সম্মিলিত বিরোধী জোটের প্রার্থীকে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচিত হন। ২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বর-এর জাতীয় নির্বাচনের কিছুদিন আগে কারামুক্তি পেয়ে ভোটের লড়াইয়ে সরোয়ার আওয়ামী লীগ প্রার্থী কর্ণেল শামিমকে পরাজিত করেন।
যুবদল সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ২০০১-এর নির্বাচনে উজিরপুর-বাবুগঞ্জ নিয়ে গঠিত বরিশাল-২ আসনে রাশেদ খান মেনন ও আবুল হাসানাত আবদুল্লাহকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন। তবে ২০০৮-এ দলীয় সিদ্ধান্তনুযায়ী তিনি ঢাকা মহানগরীতে জাহাঙ্গীর কবির নানকের বিরুদ্ধে নির্বাচন করে পরাজিত হন। এবার তিনি পুনরায় বরিশালে আদি নিবাসে ফিরলেও তার আসনটি ইতোমধ্যে দ্বি-খন্ডিত হয়েছে। বরিশাল-২ আসনটি থেকে বাবুগঞ্জ বাদ পড়ে মুলাদীর সাথে যুক্ত হয়ে ৩ নম্বর আসন হয়েছে। অপরদিকে উজিরপুরের সাথে বানরীপাড়া যুক্ত হয়ে বরিশাল-২ আসন হয়েছে। ফলে আলাল আগের অবস্থানে ফিরলেও নতুন একটি উপজেলা নিয়ে কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে পারেন। ২০০৮-এর নির্বাচনে বিএনপিতে সদ্য যোগদানকারী সরদার শরফুদ্দিন সান্টু প্রায় ৮৮ হাজার ভোট পেলেও জাতীয় পার্টি থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনিরুল ইসলামের কাছে ১২ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। বানরীপাড়ার সাবেক এমপি শহিদুল হক জামাল সেনা সমর্থিত সরকারের সময় সংস্কারবাদী হয়ে বহিস্কার হলেও আবার দলে ফিরে মনোনয়েনের লড়াই-এ রয়েছেন। ২০০৮-এর নির্বাচনে বরিশাল ও পিরোজপুরে তিনি দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে দুটি আসনে প্রতিদন্ধীতা করে জামানত হারান।
অপরদিকে রাশেদ খান মেননের সাবেক নির্বাচনী এলাকা ও পৈত্রিক ভূমি বরিশাল-৩ আসনে বিএনপি প্রার্থী হিসেবে সেলিমা রহমানের নাম থাকলেও এখানে সুপ্রীম কোর্ট বারের সভাপতি এ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিনের নামও রয়েছে। ২০০৮-এর নির্বাচনে ৬০ হাজারেরও বেশী ভোট লাভের পরেও ৬ হাজারের ব্যবধানে জাপা প্রার্থী গোলাম কিবরিয়া টিপুর কাছে পরাজিত হন সেলিমা রহমান। ঐ নির্বাচনে দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থী জয়নুল আবেদিন ২০ হাজার ভোট লাভ করেন। তবে এবারো বরিশাল-৩ আসনটি মহাজোট শরিক ওয়ার্কার্স পার্টিকে ছেড়ে দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। আর এই আসনে দলীয় সভাপতি মেননের আপন বোন সেলিমা রহমানের সাথেই ওয়ার্কার্স পাটির মনোনীত প্রার্থীর প্রতিদ্ব›িদ্বতা হতে পারে বলে মনে হচ্ছে। তবে মনোনয়ন তালিকায় জয়নুল আবেদিনের নামও রয়েচে। জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকেও আসনটির জন্য জোর দাবী রয়েছে আওয়ামী লীগের কাছে। সে ধরনের ছাড় না মিললেও জাপার সাবেক এমপি গোলাম কিবরিয়া টিপু ঐ আসনে প্রার্থী হবার আশা ছারবেন না বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল। ফলে দুই টিপুর সাথে সেলিমা রহমান বা জয়নুলের লড়াই যথেষ্ঠ জমজমাট হতে পারে বরিশাল-৩ আসনে। সেক্ষেত্রে জাপার টিপুই মূল প্রতিদন্ধী হতে পারেন বিএনপি প্রার্থীর। তবে শেষ পর্যন্ত প্রার্থী সেলিমা না জয়নুল তার ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করবে।
বরিশাল-১ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেব আবুল হাসনাত আবদুল্লাহর নাম ঘোষনা করা হলেও বিএনপি প্রার্থী হিসেবে আছে দজুনের নাম। এরমধ্যে সাবেক এমপি জহিরুদ্দিন স্বপন প্রায় এক যুগ পরে দলে ফিরে মনোনয়ন লাভের তালিকায় এক নম্বরে আছেন। দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন ইঞ্জিনিয়ার সেবহান। তিনি ২০০৮-এর নির্বাচনে অনেক প্রতিকুলতায় নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কাছে ১৭ হাজার ভোটে পরাজিত হন। অপরদিকে ২০০১-এর নির্বচনে জহিরুদ্দিন স্বপন আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবুল হাসনাত আবদুল্লাহকে ১৪হাজার ভোটে পরাজিত করেন। ২০০৭-এ সেনা সমর্থিত ১/১১সরকার গঠনের পরে স্বপন সংস্কারবাদীদের দলে অন্তর্ভূক্ত হন। এমনকি সেসময় তাকে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার জন্য চেয়ারপার্সন নির্দেশ দিলেও তিনি তা পালন করেন নি। সম্প্রতি তিনি দলে ফিরে মনোনয়ন লাভের প্রথমস্থানে রয়েছেন। তবে দীর্ঘদিন ধরেই বরিশাল-১ আসনের গৌরনদী-আগৈলঝাড়াতে বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা দূর্বল।
ফলে স্বপন বা সোবহান যেই শেষ পর্যন্ত প্রার্থী হন না কেন তাদেরকে চরম প্রতিকুলতায় পড়তে হচ্ছে। প্রায় একই অবস্থা দক্ষিনাঞ্চলের অধিকাংশ আসনেই। বিশেষকরে ভোলার ৪টি আসনেই বিএনপি সহ ঐক্য ফ্রন্টের প্রার্থীদের লক্ষে পৌছতে মেঘনার উত্তাল তরঙ্গ পাড়ী দিতে হতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল।
তবে পটুয়াখালী-২, ৩ ও বরগুনার দুটি আসন ছাড়াও পিরোজপুর-১ ও ৩নম্বর আসনেও আওয়ামী লীগ সহ মহাজোট প্রার্থীদেরও দল এবং জোটের কোন্দলে বিরুপ পরস্থিতির আশংকার কথা জানিয়েছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল। এমনকি অনেক আসনেই মহাজোটের প্রার্থীদের বিরোধিতা করলেও তাদের পক্ষে কাজ নাও করতে পারেন মূল শরিকদের নেতা-কর্মীরা। এমনকি পটুয়াখালী-৩ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সিইসি’র ভাগ্নের পক্ষে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি খ ম জাহাঙ্গীরের অনুসারীসহ একটি বড় অংশই যে থাকছে না, তা ইতোমধ্যোই পরিস্কার হয়ে গেছে। ঐ আসনে বিএনপি প্রার্থী হচ্ছেন আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি গোলাম মাওলা রনি। এলাকায় তার একটি সমর্থক গোষ্ঠী ২০১৪-এর পরে সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। পিরোজপুর-২ আসনেও মহাজোট শরিক জেপি’র আনোয়ার হোসেন মঞ্জুও মূল শরিক দলের নেতা-কর্মীদের কতটা কাছে পাবেন তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
তবে এসব কিছুই একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনী পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী পরিবেশ এখনো দক্ষিণাঞ্চলে খুব দৃশ্যমান না হলেও পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে তা আগামী কয়েক দিনে স্পষ্ট হতে শুরু করবে বলে মনে করছেন মহলটির।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন