চলছে আমন ধান কাটার মওসুম। পুরো দমে চলছে ধান কাটা। এবার একই সাথে শুরু হয়েছে ভোটের মওসুম। ধান কাটা আর ভোট দুই কর্মকান্ড নিয়ে রাজশাহী অঞ্চলের চারিদিক সরগরম। ধানের ফলন, বাজার মূল্য, লাভ না লোকসান ইত্যাদি কথার মাঝে জুড়ে বসেছে ভোটের খুটিনাটি। প্রার্থীর নাম ঘোষণা হয়েছে, কার সাথে কার নির্বাচনী যুদ্ধ হবে। কার পজিশন ভাল। বিগত এমপিদের কর্মকান্ড নিয়েও চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। গত সোমবার বরেন্দ্র অঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে আমন কাটার ধুম। আবহাওয়া খারাপ হবার আগেই সবাই ঘাম ঝরানো ফসল ঘরে নিতে চায়। শীতকালীন শাকসব্জির ক্ষেত নিয়েও ব্যস্ত সময় পার করছে কৃষক। তানোরের চান্দুরিয়ার ক্ষেতে একদল শ্রমিক ধান কাটছিল। পাশেই ছিল জমির মালিক। আবাদ কেমন হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, সেচের পানির কারণে এবার আবাদ কিছুটা নামলা (বিলম্বিত) হলেও আল্লাহ রহমতে ফসল ভাল হয়েছে। ধানকাটা শ্রমিকদের জিজ্ঞেস করি ভোটের খবর কী? পাঁচজনের মধ্যে দু’জন কাটা ধানের গোছা তুলে বলেন, ধানের শীষ। আমরা বাবা এতে ভোট দিয়েঅ্যাসাছি। একজন ফোঁস করে উঠেন। দেখছিস না সাম্বাদিক। পেপারে লিখলে আর আমলীগ (আওয়ামীলীগ) ওয়ালারা জানলে ধানের শীষের বিষ মাইরা দিবেনি। বোঝা গেল ভোট নিয়ে মানুষের মাঝে ভীতি রয়েছে। কালিগঞ্জ বাজারের চা-সিঙাড়ার দোকানে কিছুক্ষণ অবস্থান করে বোঝা গেল সেখানে ভোট নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় না উঠলেও সতর্ক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। সবার প্রশ্ন শেষ পর্যন্ত সুষ্ঠুভাবে ভোট হবেতো। তানোরের গোল্লাপাড়া বাজারে ফের বর্তমান এমপি ফারুক চৌধুরী মনোনয়ন পাওয়া নিয়ে তার সমর্থকদের উল্লাস ছিল।
বরেন্দ্র অঞ্চল ঘুরে ফেরার পথে গোদাগাড়ি-আমনুরা সড়কের মুখের কালাইয়ের রুটির দোকানে বসে ভোটের আবহাওয়া পাওয়া গেল দু’ধরনের। একপক্ষ বর্তমান এমপির পক্ষে অন্যপক্ষ বিপক্ষে। কেউ খুশী, কেউ অখুশী। বেশ ক’মাস ধরে এ আসনটিতে বর্তমান এমপির বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের বেশ কজন হেভিওয়েট প্রার্থী। সাতজন একত্র হয়ে তার বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে আসছিল। এনিয়ে হামলা মামলার মতো ঘটনাও ঘটে। বর্তমান এমপির ফের মনোনয়র পাওয়া না পাওয়া নিয়ে বেশ আলোচনা ছিল। পক্ষ-বিপক্ষের কারণে এখানে বেশ বেগ পেতে হবে। বিপক্ষে থাকছেন বিএনপির সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিনুল হক।
রাজশাহী সদর আসনে লড়াইটা হবে মহাজোটের শরীক ওয়ার্কার্স পাটির সম্পাদক বর্তমান এমপি ফজলে হোসেন বাদশার সাথে বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী সতের বছরের মেয়র ও এমপি মিজানুর রহমান মিনুর সাথে, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। এখানে বাদশা আওয়ামী লীগের কর্মীদের কতটা মাঠে পাবেন তা নিয়ে কিছুটা সংশয় রয়েছে। তারপরেও মিনু-বাদশা দু’জনেই নির্বাচনের মাঠে পুরনো খেলোয়াড়।
রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান এমপি আয়েন উদ্দিন। বিএনপির নগর সম্পাদক অ্যাড. শফিকুল হক মিলনের নাম ঘোষণা করা হয়েছে এখানে। আসনটি জামায়াত প্রত্যাশা করলেও সেটি হয়নি। তবে দলীয় মনোনয়ন না চাইলেও বিএনপির সাবেক মন্ত্রী অ্যাড. কবির হোসেনেরর পক্ষ থেকে রিটার্নিং অফিস হতে মনোনয়নপত্র নেয়ায় বিষয়টা বেশ আলোচিত।
রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনে ফের আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান এমপি ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক। বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন বিশিষ্ট আমলা আবু হেনা। বাদ পড়েছেন সাবেক এমপি আব্দুল গফুর। আমলা আবু হেনা এতদিন দল থেকে দূরে ছিলেন। নির্বাচনের সময় এসে ফের আলোচনায় এসেছেন। আসনটিতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ধনকুবের এনামুলের বিপক্ষে একটা শক্ত অবস্থানে আছেন উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌর মেয়রসহ নেতাকর্মীরা। আলোচনা হচ্ছে ব্যবসায়ী আর আমলার মধ্যকার লড়াই নিয়ে।
রাজশাহী-৫ আসনে কপাল পুড়েছে বহুল আলোচিত-সমালোচিত বর্তমান এমপি আব্দুল ওয়াদুদ দারার। আর অনেকটা আকস্মিকভাবে কপাল খুলেছে স্বাচিপ নেতা ডা. মনসুরের। দারার বিরুদ্ধে এরা জোট বেঁধেছিলেন। সবার ধারণা ছিল এবার সাবেক এমপি প্রবীন নেতা অ্যাড. তাজুল ইসলাম ফারুক মনোনয়ন পাচ্ছেন। কেন্দ্র হতে তেমন সঙ্কেত নাকি পেয়েছিলেন। প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন। সবাইকে চমক দিয়ে ডা. মনসুরের কপাল খুলেছে। এখানে এবারে বিএনপির প্রার্থী হবেন সাবেক এমপি অ্যাড. নাদিম মোস্তফা। তিনি দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। এদিকে মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে মনোনয়নপত্র তুলে স্বতন্ত্র হিসাবে জমা দিয়েছেন সাবেক এমপি তাজুল ইসলাম মো. ফারুক।
রাজশাহী-৬ (চারঘাট-বাঘা) আসনে বহাল রইলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়া আলম। এখানেও তার বিপক্ষে রয়েছে দলের সাবেক এমপি, পৌর মেয়র সাবেক ছাত্র নেতাসহ দলের একটা বিক্ষুব্ধ অংশ। প্রতিকুল অবস্থার মাঝেও তার কর্মকান্ডকে সঙ্গী করে বিজয় দেখছেন শাহরিয়ার। এখানে মনোনয়ন পেয়েছেন চারঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান বিএনপির লড়াকু সৈনিক আবু সাঈদ চাঁদ। তাকে নানা মামলা দিয়ে কারাগারে আটকে রাখা হচ্ছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরও তার কারামুক্তি মিলছে না। কারাগার থেকেই মনোনয়নপত্র নিয়েছেন। মুক্তি না পেলে কারাগার থেকে লড়বেন। একের পর এক মামলা দিয়ে তাকে আটকে রাখার বিষয়টা ভাল চোখে দেখছে না এলাকার মানুষ। এতে করে তার প্রতি সহানুভূতি ও সমর্থন আরো বাড়ছে।
এদিকে দলের মনোনয়নের বাইরে রাজশাহী-৩ থেকে বিএনপির মনোনয়ন নিয়েছেন কামরুল মনির, রাজশাহীর-৫ আসনে আওয়ামী লীগের ওবায়দুর রহমান, রাজশাহী-৪ আসেন বিএনপির ডিএমডি জিয়াউর রহমান, আশফাকুর রহমান, রাজশাহী-৩ আসন থেকে যুক্তফ্রন্ট (এলডিপি)’র মনিরুজ্জামান স্বাধীন।
মনোনয়ন বঞ্চিতরা বলছেন, তাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। তবে শেষ পর্যন্ত তারা দলীয় সিদ্ধান্ত মেনেই চলবেন।
বরেন্দ্র অঞ্চল ঘোরার সময় বিভিন্ন পেশার মানুষের সাথে আলাপ করে বোঝা যায় ভোট নিয়ে তাদের মধ্যে রয়েছে চাপা উচ্ছ্বাস। সুষ্ঠু ভোট হবে নাকি আগের মতো এমন প্রশ্ন সর্বত্র। এখন পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ের যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তা খুবই নিয়ন্ত্রিত। কারো কারো সাহসী সোজা-সাপটা জবাব ছিল কেউ কি সহজে ক্ষমতার স্বাদ হারাতে চায়। যে কোন মূল্যে ধরে রাখার প্রচেষ্টা হলে সংঘাত অনিবার্য। কারো অভিমত বিগত ভোট আর এবারের চিত্র ভিন্ন হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন