নরসিংদীর ৫টি সংসদীয় আসনের জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের কমবেশি ৮০ জন প্রার্থীর মনোনয়ন যুদ্ধ শেষ হয়েছে। এখন চলছে মাঠ পর্যায়ে ভোট যুদ্ধের প্রস্তুতি। আওয়ামী লীগ লড়াই করবে তাদের ১০ বছরের অবস্থানকে অটুট রাখার জন্য। পক্ষান্তরে বিএনপি তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থীরা লড়বে তাদের দীর্ঘদিনের ঘাঁটি এলাকা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে। নরসিংদীর পাঁচটি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়নে নতুন কোনো নেতাকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। গত নবম ও দশম সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীরাই এবছর মনোনয়ন পেয়েছেন। এদের মধ্যে নরসিংদী সদর আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী ও নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি লে. কর্নেল (অব.) মোঃ নজরুল ইসলাম হিরু, নরসিংদী -২ (পলাশ) আসনে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক এমপি ডাক্তার আনোয়ারুল আশরাফ খান দিলীপ, নরসিংদী-৩ (শিবপুর) আসনে সাবেক এমপি জহিরুল হক মোহন ও বর্তমান এমপি সিরাজুল ইসলাম মোল্লা, নরসিংদী -৪ (মনোহরদি -বেলাবো) আসনে বর্তমান এমপি এডভোকেট নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন এবং নরসিংদী-৫ (রায়পুরা) আসনে বর্তমান এমপি ও সাবেক মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু। পক্ষান্তরে কয়েকটি আসনে বিএনপি’র প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে নরসিংদী -১ সদর আসনে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও জেলা বিএনপি›র সভাপতি খায়রুল কবির খোকন, নরসিংদী-২ (পলাশ) আসনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ড আব্দুল মঈন খান, নরসিংদী-৩ (শিবপুর) আসনে খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া ও নরসিংদী সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মনজুর এলাহী, নরসিংদী-৪ (মনোহরদী-বেলাব) আসনে সাবেক এমপি সরদার সাখাওয়াত হোসেন বকুল এবং নরসিংদী-৫ (রায়পুরা) আসনে জামাল চৌধুরী, অ্যাডভোকেট নেসার আহমেদ এবং ইঞ্জিনিয়ার আশরাফ উদ্দিন বকুলের নাম শোনা যাচ্ছে। মনোনয়ন চূড়ান্ত না হলেও এসব প্রার্থীদের ভিত্তিতেই হবে এবারের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটযুদ্ধ। রাজধানী ঢাকা থেকে ৫৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত নরসিংদী জেলাকে বলা হয় বিএনপি ঘাঁটি এলাকা। স্বাধীনতার পূর্বাপর সময়ে নরসিংদী-১ সদর আসনের ১০টি নির্বাচনে ৫ বার বিজয়ী হয়েছে বিএনপি, তিনবার আওয়ামী লীগ এবং দুইবার জাতীয় পার্টি। তবে জাতীয় পার্টির আমলে ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি।
এই আসনে যতগুলো হয়েছেন, এর মধ্য ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ও সাবেক মন্ত্রী আব্দুল মোমেন খান ৫৪ হাজার ১১২ভোটের ব্যবধানে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোসলে উদ্দিন ভূইয়া কে পরাজিত করেছিলেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী সামসুদ্দিন আহমেদ এসাক আওয়ামী লীগ প্রার্থী মুসলিম উদ্দিন ভূইয়া কে ৩৮১৬৬ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেছিলেন। যদিও ২০০৮ সালের নির্বাচনে এই আসনে বিএনপির প্রার্থী খায়রুল কবির খোকন আওয়ামী লীগ প্রার্থী লে: কর্নেল অবসরপ্রাপ্ত মোঃ নজরুল ইসলাম হিরুর নিকট ১৬ ৬৫১ ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন। তবে এই নির্বাচনে মইনুদ্দিন -ফখরুদ্দিনের সময় সিল মারামারির অভিযোগ রয়েছে আওয়ামী লীগ ভোট কর্মীদের বিরুদ্ধে। নরসিংদী-২ পলাশ আসনে চারবার নির্বাচিত হয়েছেন বিএনপির প্রার্থী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডঃ আবদুল মঈন খান। ২০০৮ সালের নির্বাচনে একবারই নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী ডাক্তার আনোয়ারুল আশরাফ খান দিলীপ। একবার নির্বাচিত হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী। নরসিংদী-৩ শিবপুর আসনে চার বার নির্বাচিত হয়েছেন বিএনপির প্রার্থী ও বিএনপির সাবেক মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া। দুই বার নির্বাচিত হয়েছে আওয়ামীলীগ প্রার্থী এবং দুইবার নির্বাচিত হয়েছে দুজন স্বতন্ত্র প্রার্থী। নরসিদী-৪ মনোহরদী-বেলাব আসনে চারবার নির্বাচিত হয়েছে বিএনপির প্রার্থী, চারবার আওয়ামী লীগ এবং একবার স্বতন্ত্র প্রার্থী। এই স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন একসময়ের মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি পরে বিএনপিতে যোগদান করেছিলেন। নরসিংদী-৫ রায়পুরা আসনে ৪ বার বিএনপি, ৫ বার আওয়ামীলীগ ও একবার আওয়ামী লীগ মিজান প্রার্থী বিজয় হয়েছিলেন। এই আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ভোটকর্মীরা নির্বাচনের পূর্ব রাতেই তাদের বিজয় নিশ্চিত করে ফেলেছিল। নরসিংদীর মেয়র লোকমান হত্যাকান্ডের পর রায়পুরার এই সিল মারামারির ঘটনা আওয়ামী লীগ কর্মীরা প্রকাশ্য মিছিলে ফাঁস করে দেয়।
বিএনপি নেতাকর্মীদের দাবি, এবার নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারলে ৫ আসনেই বিএনপি মনোনীত প্রার্থীরা বিপুল ভোটে বিজয়ী হবেন। তাদের মতে, যে নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী নরসিংদীর আসনগুলো থেকে নির্বাচিত হয়েছেন প্রায় প্রতিটি নির্বাচনে সিল মারামারি করে বিজয়ী হয়েছেন। আওয়ামী লীগ শুধু ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়নি, বিএনপি প্রার্থীদের নিশ্চিত বিজয়ও কেড়ে নিয়েছে। আওয়ামী লীগের পাতানো নির্বাচনগুলোতেও তাদের ভোটকর্মীদের স্লোগান ছিল ‘আঙুলে কালি লাগিয়ে চলে যাও, ব্যালট পেপার দিয়ে যাও’। আওয়ামী লীগের একদলীয় নির্বাচনেও তাদেরকে সিল মেরে বিজয়ী হতে হয়েছে। বিএনপি নেতাকর্মীরা জানান, এ বছর তারা যেকোনো মূল্যে ভোট ছিনতাই বন্ধ করবে। তারা এলাকা এবং ভোটকেন্দ্র পাহারা দেবে। কেউ শক্তি প্রয়োগ করার চেষ্টা করলে তারা সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করবে। যত বাধাই আসুক বিএনপির নির্বাচনী এজেন্ট এবং ভোটকর্মীরা কোন ক্রমেই ভোট কেন্দ্র ত্যাগ করবে না। আওয়ামী লীগ কর্মীরা কোন এলাকায় গিয়ে ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বাধা দিলে সেখানেও তারা প্রতিরোধ গড়ে তুলবে এবং ভোটারদেরকে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে উৎসাহিত করবে। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও ভোটকর্মীরা বলছে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে এবং এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী বিজয়ী হবে। তারা বলেন, জনগণ বিএনপিকে আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলেই দেশের আনাচে-কানাচে সন্ত্রাস বেড়ে যায় বেড়ে যায় চাঁদাবাজি রাহাজানি চুরি-ডাকাতি ইত্যাদি। ক্ষমতায় থাকলে দেশের উন্নয়ন হয়। গত দশ বছরে নরসিংদীর আসনগুলোতে যত উন্নয়ন হয়েছে তা বিএনপি দীর্ঘ ক্ষমতায় থাকাকালে হয়নি। পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মোঃ নজরুল ইসলাম হিরু নরসিংদী সদরে ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেছেন। তার উল্লেখযোগ্য সাফল্য হচ্ছে নরসিংদীর মেঘনা ব্রিজ। ব্রিজ নির্মাণ করে তিনি নরসিংদীর অবহেলিত চরাঞ্চলকে নরসিংদীর মূল ভূখন্ডের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। চরাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ দিনের আকাক্সক্ষা তিনি পূরণ করেছেন। একইভাবে রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু রায়পুরায় প্রভূত উন্নতি সাধন করেছেন। রায়পুরার অবহেলিত চরাঞ্চলকে নরসিংদীর মূল ভূখন্ডের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। ছোট-বড় অনেক রাস্তাঘাট নির্মাণ করেছেন। আগে পায়ে হেঁটে চরাঞ্চলে যেতে একদিন সময় লেগে যেত। এখন মাত্র ১ ঘন্টায় চরাঞ্চলের যে কোন ইউনিয়নে আসা যাওয়া করা যায়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন