শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

নির্বাচনে তরুণ ভোটাররা রাখতে পারে নিয়ামক ভূমিকা

নাজমুল হোসেন | প্রকাশের সময় : ৩০ নভেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনে তরুণরাই হবে মূলশক্তি। তারা একটা মোটা অংকের ভোট ব্যাংক। চলতি বছরের ৩০ অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারির মধ্যেই একাদশ সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও নির্বাচন কমিশন আগামী ৩০ ডিসেম্বরই এর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভোটার হাল নাগাদ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, নবম জাতীয় নির্বাচন থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশে মোট ভোটার সংখ্যা (সম্ভাব্য) ১০ কোটি ৪৬ লাখের বেশি। সে হিসাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের দুই আমলে নতুন ভোটার হচ্ছে ২ কোটি ৩৫ লাখ ১২ হাজার ৯৯৭ জন। এর মধ্যে ২৭ বছর বয়সী ভোটার রয়েছে ১ কোটি ৮ লাখ ৮৪ হাজার ১৪৬ জন। আর ২১ থেকে ২২ বছর বয়সী ভোটার রয়েছে ৮০ লাখ ২৮ হাজার ৮৩৩ জন। অন্যদিকে একেবারে নতুন অর্থাৎ ১৮ বছর বয়সী ভোটার হচ্ছে প্রায় ৪৬ লাখের মত। নির্বাচন কমিশন হতে প্রাপ্ত এসব সম্ভাব্য হিসাব হলেও চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারিতে চূড়ান্ত হিসাব জানা যায়। ২০১৬ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত মোট ভোটার সংখ্যা ছিল মোট ১০,১৪,৪০,৬০১ জন। এর সাথে নতুন করে যুক্ত ভোটার ৩৩,৩২,৫৯৩ জন। নতুন পুরুষ ভোটার সংখ্যা ১৬,৩২,৯৭১ আর নারী ভোটার ১৬,৯৯,৬২২ জন। অন্যদিকে মৃত ভোটার ১৭,৪৮,৯৩৪ জনকে বাদ দেয়া হয়েছে। সবশেষে বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী দেশে মোট ভোটার রয়েছে ১০,৪১,৪২,৩৮১ জন। সংখ্যার দিক দিয়ে ভোটারদের মধ্যে তরুণরাই এগিয়ে রয়েছে। আগামী নির্বাচনে নতুন নেতৃত্ব ও বাংলাদেশকে কেমন দেখতে চান সেই অনুযায়ী তারা নির্বাচনে ভোট দেবে। তাদের উপরেই নির্বাচনের ফলাফলের ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাবের দুটো দিকের সিংহভাগই নির্ভর করবে বলে ধারণা করছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরাও। অর্থাৎ তরুণরা যেমন একদিকে যে কোনো নতুন সরকার গঠনে ব্যাপক পজিটিভ ভূমিকা রাখবে তেমনি অন্যদিকে সরকারের ভরাডুবিতেও নেগেটিভ ভূমিকা পালন করবে। তাহলে এই তরুণরা নিশ্চয়ই কোনো দলের ক্ষেত্রে নতুন সরকার গঠনে বাধা হয়েও দাঁড়াতে পারে! তারা নিশ্চয়ই চাইবে তাদেরও কিছু চাওয়া-পাওয়া বা দাবি-দাওয়া সরকার কর্তৃক পূরণ হোক। তেমনি সারাদেশের এই সব তরুণ ভোটার ও উচ্চ শিক্ষিত বেকারদেরও সরকার বরাবর দাবি, কোটার সঠিক সংস্কার করা ও চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমার বর্তমান পুরাতন শৃঙ্খল ভেঙ্গে সেটা ন্যূনতম ৩৫ বা তার বেশিতে বর্ধিত করা। বেকারত্ব দূরীকরণে বা বিভিন্ন আনুষঙ্গিক ও আভ্যন্তরীণ কারণের দরুণ তাদের এই সব চাওয়া নিশ্চয়ই অযৌক্তিক বা অনিয়মতান্ত্রিক নয়, যা ইতোমধ্যে বিভিন্ন গবেষক, বিশ্লেষক, সচেতন মহল ও দেশের নামি দামি কলামিস্টরা জানান দিয়েছেন তাদের লেখনীর মাধ্যমে। তাই স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে, এই তরুণ-তরুণীদেরকে যারা বাগে নিতে পারবেন তারাই আগামী একাদশ নির্বাচনে একধাপ নয়, বরং কয়েক ধাপ এগিয়ে থাকবেন, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু তারাই নয় তাদের সাথে থাকবে তাদের নিকট আত্মীয়, পরিবার-পরিজনও। এ ক্ষেত্রে এই সুবিধাকে কাজে লাগানোর সবচেয়ে বড় সুযোগ রয়েছে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের। তবে আওয়ামীলীগ এখনো তরুণদের এই দাবিকে সামান্যতমও আমলে নেয়নি। চাইলে তারাই ছোট্ট এই দাবি দু’টি মেনে নিয়ে তার বাস্তবায়নের মাধ্যমে তরুণদেরকে বাগে নিতে পারতো। গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকবার বিভিন্ন মিডিয়া ও সরকারসংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী ব্যক্তি মারফত জানা গিয়েছিল, সরকার চাকরির বয়স ৩৫ করা নিয়ে রীতিমত দ্বিধাদ্ব›েদ্ব ছিল। ক্ষমতাসীন দল কৌশলগতভাবেই বিষয়টাকে নির্বাচনী ইশতেহারে যুক্ত করে আগামীতে ক্ষমতায় এসে সেটা বাস্তবায়নের কথা ভাবছিল। কারণ দেশের ১০ কোটি ৪১ লাখ ৪২ হাজার ৩৮১ জন ভোটারের মধ্যে অনূর্ধ্ব ৩৫ বছর বয়সী ২ কোটি ৩০ লাখ তরুণ ভোটার রয়েছে। আর এসব তাদের দীর্ঘদিনের দাবি। ফলে এমন প্রতিশ্রুতিতে তরুণ ভোটাররা উদ্বুদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে বলে ভাবছিল সরকার। যদিও অতীতে এমন পরিকল্পনার কথা বললেও এখন পর্যন্ত সেটার বাস্তবায়ন করা হয়নি। শীর্ষ মহলের কেউ কেউ বলছেন, নির্বাচনের আগে তরুণদের এই দাবি মেনে নিলে ভোটের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। আবার কেউ কেউ রয়েছেন এর বিপরিতমুখী অবস্থানে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এমন, এই সব তরুণ নির্বাচনের আগেই এর বাস্তবায়ন চায়। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে দেখা যায়, অনেকেই বিভিন্ন পোস্ট বা মন্তব্যের মাধ্যমে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তাদের দাবি মেনে নিলে তারা নিজেরাসহ পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজন নিয়ে আওয়ামী লীগকেই বিপুল পরিমাণে ভোট দেবে। এ ক্ষেত্রে তরুণদের যে ভোট ব্যাংক রয়েছে সেটা স্বাভাবিকভাবেই ২ কোটি ৩০ লাখ থেকে বেড়ে অনেক বড় হয়ে যাবে। তাই এমন লোভনীয় সুযোগটা দাবি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন সরকারই কাজে লাগাবে বলে সবাই আশা করে।
সমস্ত জল্পনা-কল্পনা শেষে শোনা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন সরকার তার নির্বাচনী ইশতেহারে তরুণদের জন্য চমকপ্রদ কিছু পরিকল্পনার মধ্যে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩২ বছর রাখতে চাচ্ছে যদিও বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত হয়নি, যা শুনে তরুণ সমাজ রীতিমত হতভম্ব! অথচ গত নির্বাচনের ইশতেহারে অনুরূপ প্রতিশ্রুতির কথা বললেও ক্ষমতাকালীন ৫ বছরে এ নিয়ে তুমুল নাটকীয়তার জন্ম দেয়া ছাড়া আর কিছুই করেনি। তাহলে তাঁদের উপরে তরুণদের আস্থা কীভাবে থাকবে?
অন্যদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ইতোমধ্যে তরুণদের সেই দাবিকে আমলেই নিয়ে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ন্যূনতম ৩৫ বছর করার মত বিষয়টিকে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে যুক্ত করে। ক্ষমতায় গেলে এই বয়সসীমা অভিন্ন বা ৩৫ এর বেশিও করে দিতে পারে বলে জানা যায়। অতীতেও বিএনপি সরকার ১৯৯১ সালে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বিদ্যমান ২৭ বছর থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছর করেছিল। তাই যৌক্তিকতার বিচারে তরুণদের শতভাগ আস্থা তাঁদের উপরে থাকতেই পারে।
২০১৫ সালে জাতিসংঘ যে এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছিল, তার ১৭টি অভীষ্টের মধ্যে অন্তত ১০টির সঙ্গে যুবশক্তি সরাসরি জড়িত। কিন্তু তিন বছর পার হলেও যুবক বা তরুণদের ভাগ্যোন্নয়নে বাংলাদেশ বড় ধরণের সাফল্য অর্জন করেছে, সে কথা বলা যাবে না। এখনও আমাদের যুবকদের একাংশ দারিদ্র্যের নিগড়ে বন্দি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবাসহ মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত। আবার নানা বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে যেসব তরুণ উচ্চ শিক্ষা নিয়েছে, তাঁরাও চাকরি পাচ্ছে না। অথচ তাঁদের পেছনে রাষ্ট্র ও পরিবার বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে। সরকারের নীতি নির্ধারকেরা দাবি করেন, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এক কোটির বেশি যুবকের চাকরির পরিকল্পনা আছে। কিন্তু এই পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মধ্যে যে বিরাট দূরত্ব রয়েছে যুবকদের দুঃসহ বেকারত্ব সেটাই চোখে আঙ্গুল দেখিয়ে দেয়।
নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর একটি মোর্চা ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের (ইডব্লিউজি) পরিচালক আব্দুল হালিম বলেন, নবম সংসদ নির্বাচনের পর যারা ভোটার হয়েছে, তাদের তরুণ ভোটার হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছে। এ তরুণ ভোটাররা শিক্ষা ও প্রগতিশীল চিন্তা ধারণ করে। অনেক চিন্তা ভাবনা করেই ভোটকেন্দ্রে যাবে তারা। বলা যায়, আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে এ তরুণ ভোটাররাই একটি বড় নিয়ামক হবে। তাই এই বিশাল জনগোষ্ঠিকে উন্নয়নের ধারার বাইরে রেখে দেশে কখনওই টেকসই উন্নয়ন হতে পারে না। তবে এ-ও মনে রাখতে হবে, নির্বাচনী ইশতেহারে তরুণদের কথা থাকাটাই যথেষ্ট নয় বরং নির্বাচনের পর তাঁরা সেই ইশতেহার অনুযায়ী কাজ করেন কিনা সেটাও যাচাই করতে হবে। অতীতে দেখা গেছে, রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী ইশতেহারে তরুণদের উন্নয়নে অনেক কিছু করার কথা বললেও পরে ভুলে যায়। ভবিষ্যতে যেন কোনো দল ওয়াদা ভঙ্গ করতে না পারে সে জন্য তরুণদের সজাগ থাকতে হবে।
লেখক: প্রকৌশলী ও প্রাবন্ধিক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন