আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বড় ধরনের নাশকতা ও হামলার পরিকল্পনা করছে সন্ত্রাসীরা। দেশে অবস্থানকারী সন্ত্রাসীদের পাশপাশি বিদেশে থাকা সন্ত্রাসীরাও মাঠ দখলের ছক কষছে। অনেকে দেশ ও দেশের বাইরে থেকে পছন্দের প্রার্থীদের সাথে যোগাযোগ শুরু করেছে। কেউবা প্রতিপক্ষের নেতাকর্মীদের হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। এসব সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি নিষিদ্ধ ঘোষিত বিভিন্ন গোষ্ঠীও নাশকতার উদ্দেশ্যে ঢাকা ও আশপাশে ঘাঁটি গাড়ছে। ইতোমধ্যে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে এসব গোষ্ঠীর অনেকে নিহত ও আটক হয়েছে।
নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, যে কোন ধরনের নাশকতা দমন ও প্রতিরোধে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সন্ত্রাসীরা যে দল-মতেরই হোক না কেন তাদেরকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না। অপরাধীদের কঠোরভাবে দমন করা হবে। এদিকে জঙ্গি তৎপরতার বিষয়ে বেশ কিছুদিন আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছিল।
এবারের নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের অনেকে অভিযোগ করেছেন, দেশে থাকা সন্ত্রাসীদের মতো বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও নির্বাচনের মাঠ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। তাদের অনেকে মোবাইল ফোনে পছন্দের প্রার্থীদের সাথে যোগাযোগ ও চুক্তির কাজ শুরু করেছে। কেউবা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারসহ পোস্টারিং-প্রাচারণা চালাচ্ছে। এসব সন্ত্রাসী পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে মাঠ দখলে রাখতে অনুজদের নির্দেশনা দিচ্ছে। একইভাবে দীর্ঘদিন ধরে আত্মগোপনে থাকা চিহ্নিত সন্ত্রাসীরাও বিভিন্ন মিছিল-মিটিং ও সভা-সমাবেশে নিজেদের আনাগোনা বাড়িয়েছে।
র্যাব-পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, নির্বাচন ঘিরে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং যে কোন ধরনের নাশকতা প্রতিরোধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। সন্ত্রাসী, জঙ্গি, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসায়ীসহ চিহ্নিত অপরাধীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যেই পুলিশ ও র্যাবের পৃথক অভিযানে অনেক সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রতিনিয়ত এ অভিযান চলছে। এছাড়া ইতঃপূর্বে বিভিন্ন নাশকতা ও বোমা হামলায় জড়িতদের সম্পর্কে তথ্য অনুসন্ধ্যানসহ নজরদারি বাড়িয়েছে গোয়েন্দারা।
এদিকে, পুলিশের অর্ধবার্ষিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায়ও অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বৈঠক সূত্রে আরও জানা গেছে, চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে কেউ যেন ভুয়া তথ্য প্রচার বা গুজব ছড়াতে না পারে সে জন্য পুলিশ সতর্ক রয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন পত্রিকা ও অনলাইন নিউজ পোর্টালের ভুয়া নকল সাইট তৈরি করে মিথ্যা প্রচারণার অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানায়, ইতঃপূর্বে বিভিন্ন সময়ে নাশকতা, অগ্নিসংযোগ ও বোমাবাজির মামলায় গ্রেফতার হওয়াদের সম্পর্কে খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে। এসব মামলায় গ্রেফতার হওয়াদের কতজন কারাগারে এবং কতজন জামিনে রয়েছে সেটিও অনুসন্ধান করা হচ্ছে।
নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, দেশে-বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নির্দেশ ও কলকাঠিতে দেশীয় সহযোগী ও শিষ্যরা এলাকায় নিয়ন্ত্রণ ও খুন-খারাবি চালিয়ে যাচ্ছে। এসব অপরাধীদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যাচ্ছে। অনেকে আটক হয়ে কারাগারে আছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও এলাকাবাসীর সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর শাজাহানপুর, খিলগাঁও, সবুজবাগ ও মতিঝিল এলাকার বিভিন্ন দেয়ালে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও ল্যাংড়া খালেদের ছবিযুক্ত পোস্টার টানানো হয়েছে। যদিও কিছু কিছু এলাকায় পুলিশ এসব পোস্টার ছিঁড়ে ফেলেছে। অভিযোগ আছে, ২০০২ সালে মালিবাগে সানরাইজ হোটেলে ডিবি পুলিশের দুই কর্মকর্তাকে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান হত্যা করে। এছাড়া কাউসার হত্যা, পলাশ হত্যা, মগবাজারে রানা হত্যা, তমাল হত্যা ও খিলগাঁওয়ে বাবার সামনে ছেলেকে হত্যার অভিযোগ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বাড্ডা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে মেহেদী বাহিনী। এক যুগের বেশি সময় ধরে আমেরিকায় অবস্থানকারী শীর্ষ সন্ত্রাসী মেহেদী গুলশান, মহাখালী, বাড্ডা ও ভাটারা এলাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ বছরে মেহেদী গ্রুপের হাতে এ এলাকায় ১৪টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। মেহেদী গ্রুপের সঙ্গে মালয়েশিয়ায় অবস্থানকারী ডালিম-রবিন গ্রুপের সখ্য রয়েছে। এই ডালিম-রবিন গ্রুপের সঙ্গে বনানী ও মহাখালী এলাকার আত্মগোপনকারী শীর্ষ সন্ত্রাসী সুন্দরী সোহেল গ্রুপের ক্যাডার বাহিনীর আনাগোনা রয়েছে। সুন্দরী সোহেল গ্যাং মহাখালীর যুবলীগ কর্মী রাশেদকে হত্যার পরে পুরো দলসহ বিদেশে পলাতক রয়েছে। সোহেল মহাখলীসহ অন্যান্য এলাকায় নিজের ছবিসহ পোস্টার লাগিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছে।
বাড্ডার আরেক ত্রাস শীর্ষ সন্ত্রাসী মেহেদী। পুলিশের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায় সে এক নম্বরে। তার সহযোগীদের মধ্যে উত্তর বাড্ডার আরিফ, গোপীপাড়ার রমজান ও সাগর, পোস্ট অফিস গলির পুলক, সবজি গলির মান্নান, ছাত্রলীগের ইনসান ও যুবলীগের মহারাজের নাম উল্লেখ রয়েছে। জানা গেছে, মেহেদীর স্থানীয় শিষ্যরা এলাকায় নতুন করে দাপট শুরু করেছে।
মোহাম্মদপুর এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে কারাবন্দী শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলাল। নির্বাচন ঘিরে এলাকায় তার ক্যাডার বাহিনীর আনাগোনা অনেক বেড়ে গেছে। এ নিয়ে চরম আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে স্থানীয়রা। মিরপুর এলাকা নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ শাহাদত বাহিনীর বিরুদ্ধে। স্থানীয়রা জানায়, দীর্ঘদিন দুবাই ছিল শাহাদত। বর্তমানে সে মিরপুর এলাকায় তার ক্যাডার বাহিনী পরিচালনা করছে। পল্লবী ও কাফরুল এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে কারাবন্দী কিলার আব্বাস ও ভারতে আত্মগোপনকারী সন্ত্রাসী মোক্তার। স্থানীয়দের অভিযোগ, নির্বাচনের কথা বলে এই বাহিনীর ক্যাডাররা ইতোমধ্যে স্থানীয় কয়েকজন বাড়ির মালিক ও ব্যবসায়ীকে কল করে প্রত্যেকের কাছে ১০ লাখ টাকা করে চাঁদা দাবি করেছে। রাজধানীর আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী নবী হোসেন বিদেশে বসেই ঢাকার খোঁজ খবর নিচ্ছে। সম্ভাব্য প্রার্থীদের সাথে যোগাযোগ করছে এবং দেশে ফিরে আসার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে।
নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২৫ নভেম্বর গেন্ডারিয়ায় পুলিশের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ সন্ত্রাসী সুমন ওরফে শুটার ইমু নিহত হয়। এছাড়া ১৬ নভেম্বর মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরে মোহাম্মদ তাজেল, ৯ নভেম্বর রাজবাড়ীতে মোহাম্মদ আলী, ১৮ অক্টোবর যশোরে বিল্লু পারভেজ, ৩০ সেপ্টেম্বর মহেশখালীতে করিম ওরফে মাত করিম, ৫ সেপ্টেম্বর বগুড়ায় আপন ওরফে সিজার পুলিশের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়। এর আগে গত ১৪ আগস্ট মাজহারুল ইসলাম স্বপন ওরফে ঘাতক স্বপন নামে এক শীর্ষ সন্ত্রাসী ‘বন্দুকযুদ্ধে’ খিলগাঁওয়ে নিহত হয়।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকাবাসীর অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে পুরনো সন্ত্রাসীদের অনেকে কারাগারে বা দেশের বাইরে পালিয়ে থাকার সুযোগে উঠতি কিশোর-তরুণরা নতুন আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে। তারাই এখন নির্বাচনী প্রচারণার নামে পাড়া-মহল্লা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এসব উঠতি কিশোর-তরুণ পুরনো সন্ত্রাসীদের নাম ভাঙিয়ে এলাকায় ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্ম করছে। গোয়েন্দারা এসব উঠতি মাস্তানদের তালিকাও তৈরি করছে বলে জানা গেছে।
এদিকে, নির্বাচন কমিশনের সাথে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এক বৈঠকে সারাদেশে সন্ত্রাসীদের তালিকা তৈরি ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারসহ ১৬টি বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ওই বৈঠকে সন্ত্রাসীরা যে দলেরই হোক না কেন তাদেরকে বিন্দুমাত্র ছাড় না দিতে নির্দেশ দিয়েছেন ইসি সচিব হেলাল উদ্দিন আহমদ।
এ বিষয়ে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে চিহ্নিত ও তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চলছে। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে র্যাবের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে।
পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা বলেন, সন্ত্রাসী-জঙ্গিসহ চিহ্নিত অপরাধীদের বিরুদ্ধে সারা দেশেই পুলিশ নিয়মিত অভিযান চালায়। এটা চলমান বা নিয়মিত অভিযানেরই অংশ। তারপরও বর্তমানে এসব বিষয়ে আরও বেশি গুরুত্ব দিয়ে অভিযান চালানো হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন