শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংসদ নির্বাচন

বিএনপিতে দ্বিধাবিভক্তি

ফয়সাল আমীন ও মিসবাহ উদ্দীন আহমদ | প্রকাশের সময় : ২ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

দেশের সংসদীয় আসনগুলোর মধ্যে মর্যাদাপূর্ণ সিলেট-১ আসনে দুই প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি। দলের ভাইস চেয়ারম্যান ইনাম আহমদ চৌধুরী ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির মর্যাদাপূর্ণ এ আসনে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। দুইজনকে মনোনয়ন দেওয়ায় দ্বন্দ্বে পড়েছে সিলেট বিএনপি। নেতাকর্মীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে বিভক্তি। এ অবস্থায় শীর্ষ নেতাদের অনেকে রয়েছেন মৌন। কোনো প্রার্থীর সাথেই এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি তাদের।

আবার এক প্রার্থীর সমর্থকদের অপর প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিষোদগার করতেও দেখা গেছে। এই বিভক্তি আর বিষোদগার আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে আরও সঙ্কটে ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেন দলটির একাধিক নেতা। দ্রুতই একক প্রার্থী বেছে নেওয়ার জন্য কেন্দ্রের প্রতি আহ্বান তাদের। বিএনপির দুই প্রার্থীই গত বুধবার সিলেটের রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে নিজেদের মনোনয়নপত্র জমা দেন। সিলেট-১ আসনের সাবেক এমপি আব্দুল মালিক চৌধুরীর ছেলে খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির দুপুরে এবং প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ইনাম আহমদ চৌধুরী বিকেলে মনোনয়নপত্র জমা দেন।
মুক্তাদির মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় বিএনপির শীর্ষ নেতাদের মধ্যে কেবল মহানগর শাখার ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আজমল বখত সাদেক ও ইনাম আহমদের সাথে কেবল কেন্দ্রীয় সহ-ক্ষুদ্র ঋণ বিষয়ক সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক উপস্থিত ছিলেন। আর কোনো শীর্ষ নেতাদেরই তাদের সাথে দেখা যায়নি। গত বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনসহ বেশ কয়েকটি কর্মসূচিতে অংশ নেন ইনাম আহমদ চৌধুরী। তবে এসব কর্মসূচিতেও প্রবীণ এই নেতার সাথে সিলেট বিএনপির শীর্ষ নেতাদের দেখা যায়নি। বরং সকালে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের বাসভবনে সৌজন্য সাক্ষাতে যাওয়ার কারণে দলের ভেতরেই সমালোচনায় পড়তে হয় তাকে।
এই দুই জনকে মনোনয়ন দেওয়ার পরপরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা গেছে দুই নেতার অনুসারীরা নিজেদের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন। এক পক্ষ অপর পক্ষের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগও তুলছেন। আর সিলেট জেলা ও মহানগর বিএনপির শীর্ষ নেতারা এখন পর্যন্ত নীরব রয়েছেন। আজমল বখত সাদেক ছাড়া অন্য নেতাদের কোনো প্রার্থীর সাথেই দেখা যায়নি।
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ইনাম আহমদ চৌধুরীর সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন মহানগর বিএনপির সহ-সভাপতি সালেহ আহমদ খসরু। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রার্থী চূড়ান্ত না হওয়ায় নেতাদের অনেকেই দ্বিধায় আছেন। একক প্রার্থী চূড়ান্ত হলে এই দ্বিধা কেটে যাবে। সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামবেন। তবে অবশ্যই আমাদের সকলকে সম্মানিত লোকের সম্মান রক্ষা করে কথা বলতে হবে। যোগ্য মানুষকে মূল্যায়ন করতে হবে।
মনোনয়নপত্র জমাদানকালে খন্দকার মুক্তাদিরের সাথে থাকা জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আজমল বখত সাদেক বলেন, বিএনপিতে কোনো বিভক্তি নেই। সাময়িক বিভ্রান্তি তৈরি হলেও তা কেটে যাবে। আমরা চাই, যিনি মাঠে সক্রিয় রয়েছেন, সবসময় নেতাকর্মীদের পাশে আছেন এমন ব্যক্তিকেই যেনো দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়।
মর্যাদার আসনখ্যাত সিলেট-১ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ১১ প্রার্থী। সিলেট জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা কাজী এমদাদুল ইসলামের কাছে তারা মনোনয়নপত্র জমা দেন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রার্থী ড.এ কে আবদুল মোমেন পরিবারের সদস্য ও দলের নেতাদের নিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিতে আসেন। এ সময় তার বড় ভাই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও তার সাথে ছিলেন।
সিলেট-১ আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান ও বেসরকারীকরণ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ইনাম আহমদ চৌধুরী এবং দলের চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা খন্দকার আবদুল মুক্তাদির, বাসদের উজ্জল রায়, জাপার মাহবুবুর রহমান চৌধুরী, ইসলামী আন্দোলনের রেদওয়ানুল হক, ইসলামী ঐক্যজোটের ফয়জুল হক, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল বাসদের প্রণব জ্যোতি পাল, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ইউসুফ আহমদ, স্বতন্ত্র প্রার্থী আনোয়ার উদ্দিন ও মাওলানা নাসির উদ্দিন।
সিলেট সদর উপজেলা এবং সিটি কর্পোরেশন এলাকা নিয়ে গঠিত সিলেট-১ আসন। এ আসনটি মর্যাদাপূর্ণ আসন হিসেবে সব রাজনৈতিক দলের কাছে বিবেচিত। এ আসনে যে দলের প্রার্থী বিজয়ী হন; সেই দল সরকার গঠন করে। স্বাধীনতা পরবর্তী সবকটি নির্বাচনেই এর প্রতিফলনও ঘটেছে। সর্বশেষ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১ আসন থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
জামান-সেলিম সমানে সমান
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র ১ মাস বাকি। নির্বাচনকে ঘিরে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তুমুল ব্যস্ততা। ইতোমধ্যে দেশের রাজনীতিতে ক্ষমতার মসনদে থাকা আওয়ামী নেতৃত্বাধীন মহাজোট ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিজেদের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে। তবে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে বিভিন্ন আসনে চূড়ান্ত প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেনি দু’টি জোটই। এদিকে বিএনপি প্রায় প্রতিটি আসনেই একাধিক প্রার্থীকে দলীয় মনোনয়ন দিয়েছে। একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে চূড়ান্ত প্রার্থীর নাম ঘোষণা করবে দলটি। বিভাগীয় জেলা সিলেটের ৬টি আসনেও একই অবস্থা।
সিলেটের সীমান্তবর্তী দুই উপজেলা জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাট উপজেলা নিয়ে গঠিত সিলেট ৪ আসন। এই আসনে আওয়ামী লীগ নিজেদের প্রার্থী বদল করেনি। টানা দুইবারের সংসদ সদস্য ইমরান আহমদকে তৃতীয়বারের মতো নৌকার টিকিট দিয়েছে দলের মনোনয়ন বোর্ড। এ আসনে মহাজোটে থাকা জাতীয় পার্টি থেকেও দুই প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনে। আর এই আসনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক দিলদার হোসেন সেলিম ও বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সামসুজ্জামান জামানকে।
সবমিলিয়ে এই আসনে শেষ পর্যন্ত মহাজোট থেকে ইমরান আহমদই একক প্রার্থী থাকবেন বলে জানা গেছে বিভিন্ন সূত্রে। এর বিপরীতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে কে চূড়ান্ত মনোনয়ন পাচ্ছেন সেটি এখনও নিশ্চিত করেনি বিএনপিবিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বাক্ষরিত মনোনয়নপত্র পাওয়া দিলদার হোসেন সেলিম ও সামসুজ্জামান জামান দু’জনেরই বেশ শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে নির্বাচনী এলাকাতে। সেলিম সাবেক সংসদ সদস্য থাকলেও সামসুজ্জামানও জৈন্তা-গোয়াইনঘাটে গড়ে তুলেছেন নিজের ভাল অবস্থান। দীর্ঘদিন ধরে তিনি কাজ করছেন তিন উপজেলাতে। চালাচ্ছেন প্রচার-প্রচারণা। কারোর চেয়ে কেউই কম নয়।
অ্যাডভোকেট সামসুজ্জামান জামান সিলেট-৪ (জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ) আসনের তৃণমূলের মাঝে গড়ে নিয়েছেন শক্ত অবস্থান। সিলেট ছাত্রদলের এক সময়কার রাজপথ কাঁপানো নেতা তিনি। সিলেটে বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের রাজনীতিতে জামানের রয়েছে জনপ্রিয়তা।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে মামলার বোঝা নিয়ে দেশের বাইরে ছিলেন জামান। সিলেটে ফিরে সরকার বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে উঠেন। তৎকালীন সময়ে দেশব্যাপী আন্দোলনে তিনি একাই তার বলয়ের নেতাকর্মীদের নিয়ে জোরালো ভূমিকা রাখেন। নির্বাচনের পর অর্ধশতাধিক মামলায় আসামি হয়ে সিলেট ছাড়তে হয় জামানকে। বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার আগে যখন সিলেট সফর করেন তখন আবারও দেখা মেলে জামানের। এরপর থেকে তিনি সক্রিয় আছেন রাজনীতিতে।
অন্যদিকে, সিলেট-৪ আসনে বিএনপির প্রার্থী দলের কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক দিলদার হোসেন সেলিম। সেলিম দলের প্রবীণ নেতা। তিনি একাধিকবার ওই আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকলেও সেলিম এবারো এই আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন। তিনিও সিলেট-৪ আসনের মানুষের মনে ভালো অবস্থান গড়ে নিয়েছেন। একাধিকবারের এই সাবেক এমপি পরিচ্ছন্ন রাজনীতির অধিকারী। দীর্ঘদিন ধরে সিলেট বিএনপিকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। যে কারণে তার কদর কোন অংশে কম নয়। জামান-সেলিম দু’জনেই সমানে সমান।
সামসুজ্জামান জামান জানিয়েছেন, সিলেট-৪ আসন হচ্ছে বিএনপির শক্ত ঘাঁটি। মানুষ বিএনপিকে ভোট দিতে ইচ্ছুক। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এ আসনে ধানের শীষের বিজয় সুনিশ্চিত। প্রার্থীতার ব্যাপারে তার মন্তব্য, এ আসনে দলের সঠিক সিদ্ধান্তই কেবল পরিবর্তন ঘটাতে পারে। অপর প্রার্থী দিলদার হোসেন সেলিমের মন্তব্যও অনুরুপ। একাধিকবার সংসদ সদস্য থাকার কারণে সংসদীয় রাজনীতিতে অভিজ্ঞ এই নেতা চূড়ান্ত প্রার্থী হিসেবে নিজেকে যোগ্য মনে করেন।
এখন দেখার বিষয় রানিং সংসদ সদস্য ইমরান আহমদকে টেক্কা দিতে দিলদার হোসেন সেলিম ও অ্যাডভোকেট সামসুজ্জামান জামান দু’জনের কাউকেই কম যোগ্য মনে করছেন না এলাকার ভোটাররা। তাদের মতে এখানকার মানুষ বিএনপিকে ভালবাসে। যে কেউ প্রার্থী হলেই বিজয়ের আশা করাই যায়। মনোনয়নপত্র জমার শেষ দিন সিলেট জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা জেলা প্রশাসক কাজী এমদাদুল ইসলামের কাছে মনোনয়নপত্র জমা দেন আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য ইমরান আহমদ, বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য দিলদার হোসেন সেলিম, সামসুজ্জামান জামান, জাতীয় পার্টির এটিইউ তাজ রহমান ও এম ইসমাইল আলী আশিক, জমিয়তের মাওলানা আতাউর রহমান এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী মনোজ কুমার সেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন