একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের অনিশ্চয়তার দোলাচলের মধ্যেও বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের ৬টি জেলার ২১টি সংসদীয় আসনে ১৮৩ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করার পরে ভোটের পালে কিছুটা হাওয়া লাগতে শুরু করেছে। তবে এরপরেও ৩০ ডিসেম্বর দক্ষিণাঞ্চলের ৬২ লাখ ২১ হাজার ১১০জন ভোটার তাদের পছন্দের ২১জনকে এমপি নির্বাচিত করার নির্বিঘ্ন সুযোগ পাবেন কিনা তা নিয়ে মাঠ পর্যায়ে সংশয় কাজ করছে। এখনো সারা দেশের মত দক্ষিণাঞ্চলের কোথাও পুলিশ-প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ে কোন বদলি করা হয়নি। নির্বাচনের আগে সে ধরনের আর কোন সম্ভাবনাও নেই। ফলে এতদিন যেসব সরকারি কর্মকর্তা নিজ নিজ এলাকায় সরকারের চেয়ে সরকারি দলের হয়ে অতি উৎসাহী ছিলেন, আগামী নির্বাচনে তাদের ভূমিকা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
দক্ষিণাঞ্চলে দুই প্রধান জোটের পক্ষেই অনেক আসনে একাধিক প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিলে দলের মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মী ছাড়া আমজনতার মধ্যেও অনেক বিভ্রান্তি কাজ করছে। পটুয়াখালী-১ আসনে মহাজোটের মূল শরিক আওয়ামী লীগ প্রার্থী শাহজাহান মিয়ার আসনে মহাজোটের অন্যতম শরিক জাপার মহাসচিব রুহুল আমীন হাওলাদার মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। এ আসনে বিএনপি প্রার্থী সাবেক মন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী ছাড়াও তার স্ত্রী বিকল্প প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন। বরগুনা-১ আসনেও ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর বিরুদ্ধে দলের অপর প্রার্থী জাহাঙ্গীর মনোনয়নপত্র দাখিল করে শক্ত অবস্থানে রয়েছেন।
মনোনয়নপত্র দাখিলের দিন দক্ষিণাঞ্চলের জেলা ও উপজেলা সদরগুলো অনেকটা সরগরম হয়ে ওঠে। এ উপলক্ষে বিরোধী দলের অনেক সম্ভাব্য প্রার্থী দীর্ঘদিন পরে এলাকায় ফেরার সুযোগ পান। এসব নেতৃবন্দের সাথে সেদিন এলাকায় কর্মী সমর্থকসহ সাধারণ মানুষেরও ঢল নামে। সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের নানামুখী অনৈতিক চাপের পাশাপাশি পুলিশ-প্রশাসনের চোখ রাঙানীতে দক্ষিণাঞ্চলের বেশীরভাগ বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীই এতদিন এলাকায় আসতে পারেননি বলে অভিযোগ ছিল। তবে মনোনয়নপত্র দাখিলের দিন তাদের প্রায় সকলেই অবাধে জেলা-উপজেলা প্রশাসনে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। সরকারি দলের কয়েকজন মন্ত্রীও পতাকাবাহী গাড়ীতে করে পূর্ণ প্রটোকল নিয়ে জেলা-উপজেলা প্রশাসনিক দপ্তরে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন।
এবারো দক্ষিণাঞ্চলে সরকারি ও বিরোধী দলের বেশ কয়েকজন হেভিওয়েট প্রার্থীও মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। যাদের মধ্যে আমীর হোসেন আমু, তোফায়েল আহমদ, আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, আসম ফিরোজ ছাড়াও বিরোধী জোটের আলতাফ হোসেন চৌধুরী, সুপ্রীম কোর্ট বারের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, বর্তমান সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিন, সাবেক সম্পাদক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম, সেলিমা রহমান, জহিরুদ্দিন স্বপন, ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর ও বজলুল হক হারুন রয়েছেন।
তবে যুবদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে বরিশাল-২ আসনে মনোনয়ন দেয়া হলেও তিনি তা দাখিল করেন নি। বিষয়টি যুব দলের মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের হতাশ করার পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও কিছুটা হতবাক করেছে। ঘনিষ্ঠজনদের মতে, আলালের প্রথম দাবি ছিল বরিশাল বিভাগীয় সদর আসন। বিষয়টি নিয়ে দলের বিদেশী নীতি নির্ধারক মহলে ইতিবাচক মনোভাব থাকলেও ঢাকার নেতৃবৃন্দ তা মানতে নারাজ ছিল। পরে তাকে পুরনো আসনের অংশ নিয়ে গঠিত বরিশাল-৩ আসনে মনোনয়ন দেয়া হলেও সেখানে আরো দুজন বিকল্প প্রার্থীর নামও ঘোষণা করা হয়। ফলে পরিক্ষিত এ ত্যাগী নেতা নির্বাচন থেকে নিজেকে বিরত রাখেন।
অপরদিকে বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি সংসদীয় আসনেই একাধিক প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করায় দলের মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মী ছাড়াও সাধারণ মানুষের মধ্যেও ইতোমধ্যে এক ধরনের বিভ্রান্তি কাজ করছে। এমনকি কতজন বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থী এখন তা বোঝার উপায় নেই। শুধুমাত্র বিভাগীয় সদর বরিশাল-৫ আসনে কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মুজিবুর রহমান সারোয়ার বিএনপিসহ ঐক্য ফ্রন্টের একক প্রার্থী হয়েছেন। যদিও মনোনয়নপত্র যাচাই বাছাইয়ের পরেই দল ও ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে প্রার্থী চ‚ড়ান্ত করে অবশিষ্টদের প্রত্যাহার করতে বলা হবে বলে জানানো হয়েছে। তবে এরপরেও মাঠ পর্যায়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তার কাজ করছে। মহাজোটেও এধরনের বিভ্রান্তি কাজ করছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের মতে শেষ পর্যন্ত সরকারি ও বিরোধী জোটের অনেকই হয়ত মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার নাও করতে পারেন।
এখন পর্যন্ত বরিশাল জেলার ৬টি আসনে ৫১জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। এছাড়া পটুয়াখালীর ৪টি আসনে ৩৭ জন, ভোলার ৪টি আসনে ২৩ জন, পিরোজপুরের ৩টি আসনে ৩২ জন, বরগুনার ২টি আসনে ১৯ জন ও ঝালকাঠীর দুটি আসনে ২১জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে বেশ কিছু মহিলা প্রার্থীও মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। এদের মধ্যে ভোলা-১ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী তোফায়েল আহমদের বিরুদ্ধে বিজেপি’র মরহুম চেয়ারম্যান নাজিউর রহমান মঞ্জুর স্ত্রী ও আন্দালিব রহমান পার্থের মা রেবা রহমান, ঝালকাঠি-২ আসনে আমীর হোসেন আমুর বিরুদ্ধে সাবেক এমপি ইলেন ভূট্টো ও জেবা আমীন খান এবং পটুয়াখালী-১ আসনে সাবেক মন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরীর স্ত্রী সুরাইয়া অক্তার চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজন মহিলা প্রার্থীও মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন।
২০০১ সালে অনুষ্ঠিত ৮ম সংসদ নির্বাচনে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের ৬টি জেলার ২৩টি আসনের নির্বাচনে বিএনপি ১৮টি, আওয়ামী লীগ ২টি এবং জামাত ইসলামী, আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জেপি ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ১টি করে অসন লাভ করে। ঐ নির্বাচনে বিএনপিসহ ৪দলীয় জোটের প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল প্রায় ৪৫শতাংশ। অপরদিকে আওয়ামী লীগসহ মহাজোটের ভোট ছিল ৪০শতাংশের কিছুটা কম। ঐ নির্বাচনে বরিশাল বিভাগেই সর্বনিম্নতম সংখ্যক ৬৫ দশমিক ৮৩শতাংশ ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করে।
এছাড়া ৯ম সংসদ নির্বাচনে বরিশাল বিভাগে আসন সংখ্যা দুটি হ্রাস করে ২১টিতে নির্ধারণ করে নির্বাচন কমিশন। ভোলা ও ঝালকাঠিবাদে অন্য সবগুলো জেলার সংসদীয় আসন পুন:বিন্যাস করা হয়। যা ছিল নির্বাচন কমিশনেরই নীতিমালার সাথে সাংঘর্ষিক। এ নির্বাচনে দক্ষিণাঞ্চলে আওয়ামী লীগ ১৬টি এবং বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও বিজেপি ২টি করে আসন লাভ করে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল প্রায় ৪৮শতাংশ। আর বিএনপির ৩২শতাংশ। ৯ম সংসদ নির্বাচনে বরিশাল বিভাগে ভোট গ্রহণের হার সারা দেশের সর্বনিম্ন ৮৪ দশমিক ১৭শতাংশ হলেও তা ছিল বিভাগে এ যাবত সর্বোচ্চ। ২০০৮-এর নির্বাচনে দক্ষিণাঞ্চলে মোট ভোটার ছিলেন ৪৬ লাখ ৪৯ হাজার ৫১৬ জন। এ হিসেবে গত ১০ বছর বরিশাল বিভাগে ভোটার বেড়েছে প্রায় ১৪লাখ ৭১হাজার। আওয়ামী লীগসহ মহাজোটের লক্ষ্য নতুন ভোটরদের তাদের পক্ষে টানার। তবে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ ভোট হলে ফলাফল কোনদিকে যাবে তা বলার সময় এখনো আসেনি বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল।
অপরদিকে ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি আসনের মধ্যে ১০টিতে কোন ভোট গ্রহনের প্রয়োজন হয়নি প্রতিদন্ধী প্রার্থী না থাকায়। অন্য ১১টি আসনে মহাজোট এবং তাদের ঘরের বিরোধী দল সমঝোতার প্রতিদ্ব›িদ্বতার মহড়া প্রদর্শন করে একটি ভোটারবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠানে সক্ষম হয়। শুধুমাত্র বরিশাল-৩ আসনে মহাজোট শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির মোঃ টিপু সুলতানের সাথে জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি গোলাম কিবরিয়া টিপু ভোট থেকে সড়ে দাড়াবার ঘোষণা দিয়েও প্রতিদ্ব›িদ্বতা করে হেরে যান। তবে কেন্দ্রগুলোতে প্রকৃত ভোটারের উপস্থিতি ছিল ১০শতাংশ -এরও কম। এছাড়া পিরোজপুর-৩ আসনে বিএনপির সাবেক এমপি ডা. রুস্তম আলী ফরাজী স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে পরাজিত করতে সক্ষম হন। পটুয়াখালী-১ আসনে জাপার মহাসচিব রুহুল আমীন হাওলাদার ও বরিশাল-৬ আসনে তার সহধর্মীনি রত্মা আমীন মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েও পর্দার অন্তরালে থেকে নির্বাচনী মাঠে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পরাজিত করে এমপি হন। এসব আসনেও ভোটারের উপস্থিতি ছিল ৫শতাংশ -এর মত।
এবার দক্ষিণাঞ্চলে প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। দক্ষিণাঞ্চলের ৬১লাখ ২১হাজার ১১০জন ভোটার একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগে উন্মুখ হয়ে আছেন। তবে তা কতটা বাস্তব রূপ লাভ করবে তা বলার মত কোন পরিস্থিতি এখনো সৃষ্টি হয়নি বলেও মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন