পাঁচ বছরের ব্যবধানে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের দিনটি ঘনিয়ে আসছে। আর বাকি চার সপ্তাহ। মাত্র ৮দিন পরই প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীদের মাঝে প্রতীক বরাদ্দ করা হবে। তখনই চারিদিকে উঠবে প্রচার-প্রচারণার জোরালো আওয়াজ- ‘৩০ তারিখ শুভ দিন- ‘অমুক’ মার্কায় ভোট দিন। কিন্তু তার আগে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে ভোটের লড়াইয়ে অবতীর্ণ প্রার্থী, নেতা-কর্মী, তাদের সমর্থক এবং নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় ভোটারদের মাঝে টেনশন আর গুঞ্জন চারিদিকে তুঙ্গে উঠেছে।
এর কারণ হলো- মহানগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও তিন পার্বত্য জেলা মিলিয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলের ১৯টি নির্বাচনী আসনপ্রতি গড়ে প্রার্থীর সংখ্যা ১০ ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে আছেন মনোনয়ন-বঞ্চিত বিদ্রোহী প্রার্থী, বিকল্প ও ‘কৌশলী’ প্রার্থী, ডামি প্রার্থীরা। আরও রয়েছেন ছোট দল কিংবা আঞ্চলিক সংগঠনের ‘প্রেসার গ্রæপের প্রার্থী’, মওসুমী ‘অতিথি পাখি প্রার্থী’ এবং নিজেকে পরিচিত করানোর টার্গেটের প্রার্থী। সৃষ্টি হয়েছে প্রার্থীজট। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দল ও মহাজোট এবং বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের একক প্রার্থী অর্থাৎ সিরিয়াস ‘আসল’ প্রার্থীর জন্যই নিজ নিজ এলাকায় এখন অপেক্ষা মাত্র। যেন আর যে দেরি সয়না!
যেসব আসনে দল-জোটের একাধিক প্রার্থী রয়েছেন সেখানকার স্থানীয় সর্বস্তরের মানুষের মাঝে তীব্র কৌত‚হল ও প্রশ্ন, শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে থাকবেন কে কে? প্রধান দুই দল ও জোট-মহাজোটের মধ্যে ‘ডাইরেক্ট ফাইট’ হবে কার কার মধ্যে? শীতের সকাল-বিকাল সন্ধ্যায়-রাতে চা-পানের আলাপ আড্ডায় সরব আলোচনা জমে উঠেছে। একে অন্যের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান করে মনের কোণের জিঞ্জাসাগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন ভোটাররা। শহর-বন্দর, গ্রাম-জনপদের সবখানে জমেছে প্রাণবন্ত বিতর্ক। অবশ্য সব প্রশ্নের জবাব মিলবে আগামী ৯ ডিসেম্বর মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিনটিতেই।
গত বুধবার মনোনয়নপত্র দাখিল শেষে প্রার্থী ও দল-জোটের নেতারা নিজেদের নির্বাচনী এলাকায় ছুটে গেছেন। গত বৃহস্পতি, শুক্রবার ও শনিবার তিন দিনে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের সাথে ঘন ঘন মিটিং, এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ, সর্দার-মাতবর, আলেম-ওলামাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ শলা-পরামর্শ ইত্যাদি কর্মকান্ডে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করেছেন। আবার একই দল বা জোট থেকে একাধিক মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার কারণে বিড়ম্বনায় থাকা প্রার্থীরা ছুটছেন ঢাকা ও চট্টগ্রামে শীর্ষ নেতাদের দুয়ারে। নিশ্চিত করতে চাইছেন নিজের একক প্রার্থিতা।
অবশ্য চট্টগ্রামের কয়েকটি আসনে নতুন মুখ আর পুরনো মিলিয়ে ভিআইপি, ঘাগু নেতারা হয়েছেন একক প্রার্থী। তারা প্রার্থীজটের ঝামেলা থেকে মুক্ত। এলাকাবাসীও সুনির্দিষ্ট প্রার্থী পেয়ে ভোটের হিসাব-নিকাশ মেলাতে ব্যস্ত। ইতোমধ্যে প্রধান দুই জোটের মতিগতি অনুযায়ী চট্টগ্রামে বিকল্প ও ডামি একাধিক প্রার্থীর জটিলতা সামাল দিতে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮, ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের একক প্রার্থী হিসেবে চ‚ড়ান্ত করা হবে বেশিরভাগ আসনেই। সেভাবেই ৯ ডিসেম্বরের মধ্যে বাদবাকি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করানো হবে। পুরনোদের ওপর আস্থা রেখে এগুচ্ছে উভয় জোট। তবে দুই প্রধান জোটের বিভিন্ন আসনে একক প্রার্থীরাও মনোনয়ন-বঞ্চিতদের ক্ষোভ-অসন্তোষ, মান-অভিমান ভাঙানোর উপায় খুঁজছেন। তারাও আছেন বেকায়দায়।
বন্দরনগরীর তিনটি আসনসহ চট্টগ্রামের ১৬টি আসনে নির্বাচন কমিশনের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন ২৫৮ জন সম্ভাব্য প্রার্থী। আর গত ২৮ নভেম্বর বুধবার শেষদিন পর্যন্ত মনোনয়নপত্র দাখিল হয় ১৮০টি। অথচ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রামে মনোনয়নপত্র জমা হয় ৬৮ জনের। চূড়ান্ত প্রতিদ্ব›দ্বী ছিলেন মাত্র ৩৩ জন।
এবারের প্রার্থী তালিকা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, চট্টগ্রামের ৪টি আসনে বিএনপি জোটের একক প্রার্থী এবং অপর ১২ আসনে বিকল্প, কৌশলী ও ডামি প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দেন। মামলা-মোকদ্দমা, কারাবন্দী থাকা, ঋণখেলাপীর খড়গ, হুলিয়াসহ বিভিন্ন কঠিন বাস্তব পরিস্থিতির কারণে এত বেশিসংখ্যক আসনে বিএনপি জোটকে ‘ধানের শীষে’ একাধিক প্রার্থী দিতে হয়েছে বলে জানান শীর্ষ নেতৃবৃন্দ।
বিএনপি নেতারা বলছেন, কৌশলগত কারণেই চট্টগ্রামের ১২টি আসনে বিকল্প প্রার্থীসহ মূল প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। মামলাসহ সম্ভাব্য কোনো কারণে কারো মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ার বিষয়টি মাথায় রেখে বিকল্প রাখা হয়েছে। এরজন্য দলে সমস্যা হবে না। প্রত্যাহারের শেষ দিন পর্যন্ত মনোনয়ন পরিবর্তনের সুযোগ রাখা হয়েছে। তবে কয়েকটি আসনে ডামি প্রার্থীও আছেন। একাধিক প্রার্থী থাকায় দল ও জোটের কর্মীদের মাঝে টেনশন বৃদ্ধি পেয়েছে। স্থানীয় জনসাধারণের মাঝেও আছে কমবেশী প্রার্থী-বিভ্রাট।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটের একক প্রার্থী আছেন ৬টি আসনে। অপর ১০টি আসনে বিদ্রোহী প্রার্থী, একাধিক প্রার্থী, ডামি প্রার্থী রয়েছেন। এরফলে মহাজোটে সৃষ্টি হয়েছে প্রার্থীজট।
বিকল্প কৌশলী একাধিক প্রার্থী সমাচার
চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসনে ‘নৌকা’ প্রতীকে মহাজোটের প্রার্থী তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী। সেখানে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থী এটিএম পেয়ারুল ইসলাম। একইভাবে চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুন্ড-পাহাড়তলী) আসনে ‘নৌকা’র প্রার্থী বর্তমান এমপি মো. দিদারুল আলমের বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল্লাহ আল বাকের ভূঁইয়া।
চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই) আসনে আওয়ামী লীগের ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন একক প্রার্থী। বিএনপি জোটের আছেন বিকল্প ও কৌশলী প্রার্থীরা। চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসনে বিএনপি জোটের বিকল্প ও ডামি প্রার্থী আছেন একাধিক। চট্টগ্রাম-৩ (স›দ্বীপ) মহাজোটের একাধিক এবং বিএনপি জোটের আছেন বিকল্প প্রার্থীরা। চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) মহাজোটের একক প্রার্থী আওয়ামী লীগের এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী। বিএনপি জোটের সামির কাদের চৌধুরীর সঙ্গে আছেন বিকল্প প্রার্থীও।
চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া-বোয়ালখালী) মহাজোটের একক প্রার্থী আওয়ামী লীগের ড. হাছান মাহমুদ। বিএনপি জোটে গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর সাথে বিকল্প প্রার্থীও রাখা হয়েছে। চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) মহাজোটের প্রার্থী একক আওয়ামী লীগের সামশুল হক চৌধুরী। বিএনপি জোটের বিকল্প ও ডামি প্রার্থীরাও আছেন। চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা-কর্ণফুলী) আসনে মহাজোটের একক প্রার্থী আওয়ামী লীগের সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। বিএনপি জোটের দু’জন বিকল্প প্রার্থী আছেন।
চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ) বিএনপি জোটের একক প্রার্থী এলডিপি চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদ বীরবিক্রম। মহাজোটের প্রার্থী আওয়ামী লীগের নজরুল ইসলাম চৌধুরী। চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) মহাজোটের একক প্রার্থী আওয়ামী লীগের আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভীর বিপরীতে বিএনপি জোটের তরফে জামায়াতে ইসলামীর বিকল্প প্রার্থী দুই জন। আবার বিএনপির প্রার্থীও আছেন সেখানে। চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) বিএনপি জোটের একক প্রার্থী জাফরুল ইসলাম চৌধুরী। মহাজোটের আছেন একাধিক প্রার্থী।
মহানগরীর চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালী-বাকলিয়া) মহাজোটের একক প্রার্থী আওয়ামী লীগের ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। সেখানে মহাজোটের ডামি প্রার্থী আছেন। বিএনপি জোটের মূল প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন ছাড়াও একাধিক বিকল্প প্রার্থী রয়েছেন। চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং-খুলশী-হালিশহর) বিএনপি জোটের মূল প্রার্থী আবদুল্লাহ আল নোমান। জোটের বিকল্প প্রার্থী এবং জামায়াতের স্বতন্ত্র প্রার্থীও আছেন। মহাজোটের একক প্রার্থী আওয়ামী লীগের ডা. আফছারুল আমীন। চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনে বিএনপি জোটের একক প্রার্থীর আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। বিপরীতে আছেন মহাজোটের একক প্রার্থী আওয়ামী লীগের এম আবদুল লতিফ। চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুন্ড) আসনে মহাজোটের প্রার্থী ছাড়াও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। বিএনপি জোটের মূল প্রার্থী মোহাম্মদ আসলাম চৌধুরী এবং বিকল্প প্রার্থীও রাখা হয়েছে। চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী) মহাজোটের একক প্রার্থী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। বিএনপি জোটের চার জন বিকল্প ও কৌশলী প্রার্থী রয়েছেন। চট্টগ্রাম-৮ (চান্দগাঁও-বায়েজিদ-বোয়ালখালী) মহাজোটের একক প্রার্থী জাসদ একাংশের মঈনুদ্দীন খান বাদল। বিএনপি জোটের মূল প্রার্থী এম মোরশেদ খান। তবে বিকল্প প্রার্থী আছেন মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান।
অন্যদিকে তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির তিনটি নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগ একক প্রার্থিতা দিয়েছে। তবে সেখানে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টও (ইউপিডিএফ) ভোটের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছে। তিনটি আসনে বিএনপি জোটের মূল প্রার্থীরা ছাড়াও বিকল্প প্রার্থী রয়েছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন