বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, বিএনপি নেতা আফজাল এইচ খান ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আলী আজগর। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলায় বিএনপি’র রাজনীতির ‘নিয়ন্ত্রক’ বলতে তারাই। দলের মনোনয়ন প্রশ্নে তাদের কেউ কাউকে ‘ছোট’ করে দেখেন না।
বছরের পর বছর দলটির রাজনীতিতে মনোনয়ন লড়াই বলতে এই তিনজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। দলের দুর্দিনে কখনো একসঙ্গে আবার কখনো আলাদাভাবে হলেও কাজ করেছেন। নেতা-কর্মীদের চাঙ্গা রেখেছেন। কিন্তু এবার তাদের তিনজনের পাশাপাশি সবাইকে অবাক করে দিয়ে মনোনয়ন নিয়েছেন সালমান ওমর নামে একজন।
দলীয় রাজনীতিতে কী রকমের ত্যাগ-পরীক্ষার দৌলতে শক্তিমান তিন রাজনীতিকের সঙ্গে তিনিও মনোনয়ন নামের ‘সোনার হরিণ’-এর চিঠি পেলেন এই প্রশ্নটিই এখন বড় হয়ে ঠেকছে দলটির নেতা-কর্মীদের মাঝে। একই আসনে চার প্রার্থীর মনোনয়নে কে আসল এবং কে বিকল্প প্রার্থী এই নিয়ে কৌতূহলের অন্ত নেই সাধারণ ভোটারদের মাঝেও। কারণ, ফেসবুকে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে বড় এই দলটির মনোনয়ন যেন এককভাবে তিনিই পেয়েছেন। অর্থাৎ, তার প্রচারণার স্পষ্ট হচ্ছে ৩০ ডিসেম্বরের ভোটে ধানের শীষ তার। মাঠে-ময়দানে দাবড়ে বেড়ানো শক্তিশালী তিন প্রার্থীই আউট!
একই রকম সমস্যা চলছে ময়মনসিংহের ১০টি আসনেই। তবে এসব আসনের কোনটিতেই চার প্রার্থীকে মনোনয়নের চিঠি দেওয়া হয়নি। শুধুমাত্র ময়মনসিংহ-১১ (ভালুকা) আসনে উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি ফখরউদ্দিন বাচ্চু একক প্রার্থী হিসেবে দলীয় টিকিট পেয়েছেন। কোন্দল না থাকায় আসনটিতে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন বাচ্চু।
ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর) আসনে দলটির মনোনয়নের চিঠি নিয়ে রীতিমতো অস্থিরতা তৈরি হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে এই আসনে দল থেকে মনোনয়ন পাওয়া দলটির নির্বাহী কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার ইকবাল হোসেনকে বাদ দিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান আহাম্মদ তায়েবুর রহমান হিরণ ও স্থানীয় বিএনপি’র রাজনীতিতে নতুন মুখ ড্যাব নেতা ডা. সেলিম মনোনয়নের চিঠি পান।
ট্রান্সকম গ্রুপের ‘কর্ণধার’ লতিফুর রহমানের আত্মীয় ইঞ্জিনিয়ার ইকবালের চিঠি না পাওয়া নিয়ে বিশাল আলোচনা-সমালোচনার পর শেষ দিন রাতে চিঠি পান তিনি। শুরুতেই ইঞ্জিনিয়ার ইকবাল চিঠি না পাওয়ায় স্থানীয় বিএনপি’র রাজনীতিতে এক রকম সমীকরণ ছিলো। কিন্তু চিঠি পাওয়ার পর অপর দুই প্রার্থীর কপালেই চিন্তার ভাঁজ পড়ারই কথা! এমনকি, চিঠি পাওয়ার পর পরই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন আলোচিত-সমালোচিত নেতা আহাম্মদ তায়েবুর রহমান হিরণ।
তিনি ধরে নিয়েছেন এবারের ধানের শীষ তাঁর হাতেই ওঠবে। তবে ইকবাল সমর্থকরা বলছেন, দলীয় মনোনয়ন শেষ পর্যন্ত ইকবালের ভাগ্যেই জুটবে। একটি চক্রের রোষানলে পড়ায় তাকে মনোনয়ন দৌড় থেকে ‘কিক আউট’ করা হয়েছিল। কিন্তু ‘মানির মান পাহাড় সমান’ এই থিউরিতে বিলম্বে হলেও মনোনয়নের চিঠি পেয়েছেন তিনি।
ভয়ঙ্কর এক অবস্থার তৈরি হয়েছে ময়মনসিংহ-৪ (সদর) আসন নিয়ে। মর্যাদাপূর্ণ এই আসনে প্রথমে দলীয় মনোনয়নের চিঠি পেয়েছেন বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান, ড্যাব মহাসচিব ডা. এ.জেড.এম.জাহিদ হোসেন ও ময়মনসিংহ দক্ষিণ জেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক আবু ওয়াহাব আকন্দ ওয়াহিদ। কিন্তু মনোনয়ন চিঠি বিলির একেবারে শেষ ধাপে চিঠি পান কোতোয়ালী বিএনপি’র সভাপতি কামরুল ইসলাম মোহাম্মদ ওয়ালিদ ও দলটির সংস্কারপন্থী সাবেক এমপি দেলোয়ার হোসেন খান দুলু। দলীয় মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় প্রথম তিন নেতাকে নিয়ে কোনো প্রশ্ন না থাকলেও গোল বেধেছে দুলুকে নিয়ে। ওয়ান ইলেভেনে ময়মনসিংহের ১১টি সংসদীয় আসনে সংস্কারপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ করতে নেতৃত্ব দেন তিনি। দলটির তৎকালীন মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভূঁইয়ার ‘গুণধর’ শিষ্য হিসেবে তিনি ছিলেন আলোচিত। ফলে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি দলীয় মনোনয়ন হারান।
এরপর থেকে প্রায় এক যুগ দলের কোনো কর্মসূচিতেই তার উপস্থিতি নেই। দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গেও তার কোন যোগাযোগ নেই। কারাগারে দলটির কারাবন্দী চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনেও একদিনের জন্যও বুক চিতিয়ে মাঠের নেতাদের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি তাকে। অথচ দলটির সিনিয়র প্রতিটি নেতাই মামলা-হামলার শিকার হয়েছেন। এমন একজন নেতাকে দলীয় মনোনয়নের চিঠি দেওয়ায় ক্ষোভের অনলে পুড়ছেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা।
ময়মনসিংহ কোতয়ালী বিএনপির সভাপতি ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম মো. ওয়ালিদ ইনকিলাবকে বলেন, দুঃসময়ে মামলা-হামলা, জেল-জুলুম মাথায় নিয়ে যারা দলের কাজ করেছে তাদের মধ্যে যে কাউকে ধানের শীষ দিলে এ আসনে বিজয় সুনিশ্চিত।
ময়মনসিংহ দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাধারন সম্পাদক অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী আবু ওয়াহাব আকন্দ ইনকিলাবকে বলেন, ওয়ান-ইলেভেনে দুলু ময়মনসিংহ অঞ্চলে দল ভাঙ্গার দায়িত্ব নিয়ে ব্যর্থ হয়ে নিজেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। কোন বেঈমানকে দলের নির্যাতিত নেতা-কর্মীরা মানতে পারে না। তাই এ আসনটি বিএনপির ঘরে তোলতে হলে দুঃসময়ের জেল-জুলুমে নির্যাতিত যে কোনো নেতাকে মনোনয়ন দেয়া হোক।
একই ধরনের মন্তব্য করে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, বিগত দশ বছর আন্দোলন-সংগ্রামে যারা নির্যাতিত হয়ে মাঠে ছিল। তাদের মধ্যে যে কাউকে মনোনয়ন দিলে পরীক্ষিত নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে ধানের শীষের বিজয় অর্জনে সক্ষম হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
ময়মনসিংহ-৮ (ঈশ্বরগঞ্জ) আসনে বিএনপি’র দুই প্রার্থী উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি প্রকৌশলী লুৎফুল্লাহেল মাজেদ বাবু ও দলীয় সাবেক এমপি শাহ নুরুল কবির শাহীনের মধ্যে বিরোধ চরমে পৌঁছেছে। আবার এই দু’জনকেই দলীয় মনোনয়নের চিঠি দেওয়া হয়েছে। রেকর্ড শোডাউন করে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন স্থানীয় বিএনপি’র রাজনীতির ‘প্রাণভোমরা’ হিসেবে পরিচিত মাজেদ বাবু। শেষ পর্যন্ত এই দুইজনের কে দলের ‘ইয়েস কার্ড’ পাবেন এই নিয়েও আগ্রহ রয়েছে সবার। তবে আসনটিতে দলীয় ‘উইনেবল’ ক্যান্ডিডেট হিসেবে বরাবরই ধরা হচ্ছে মাজেদ বাবুকে। সব জরিপেও তিনি ছিলেন এগিয়ে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন