উপমহাদেশের বুক চিরে ধাপে ধাপে রাজনৈতিকভাবে এগিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় আল্লাহর একটি রহমত। এতে আমাদের মরহুম নেতাদের সঠিক কৌশল ও প্রত্যুৎপন্নমতির নিদর্শন রয়েছে। এভাবে না এগোলে উপমহাদেশের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় কখনোই ভারত-মাতার অঙ্গ বিচ্ছিন্ন হতে দিত না। আমাদের নেতাদের মতো রাজনৈতিক কৌশলে অগ্রসর হননি বলে, ইচ্ছা থাকা সত্তে¡ও কাশ্মীর, নাগাল্যাল্ড, তামিলনাডু, হায়দ্রাবাদ ইত্যাদি জনপদ স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি। অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল গফুর চমৎকারভাবে মন্তব্য করেছিলেন যে, বাংলার শেখ যা করতে পারেন, কাশ্মীরের শেখ তা পারেনি। আজাদী আন্দোলনের এই জটিল ও কৌশলী ইতিহাস জানতে অবশ্যই পাঠ করতে হবে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং সেই সঙ্গে আরো কিছু ঐতিহাসিক বই। যেমন মাওলানা আবুল কালাম আজাদের ‘ইন্ডিয়া উইলস ফ্রিডম’-এর সর্বশেষ সংস্করণ, জয়া চ্যাটার্জির ‘বাংলা ভাগ হলো’ ইত্যাদি।
যদিও মোগল ও ব্রিটিশ আমলে সমগ্র উপমহাদেশকে একত্র করা গিয়েছিল, বাকি সময়ে কিন্তু উপমহাদেশে ছিল অসংখ্য রাষ্ট্র, অসংখ্য রাজা-বাদশাহ-সুলতান-নবাব। বাংলা মুলুকেরও একটা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল সেই প্রাচীনকালের গঙ্গারিডি রাষ্ট্রের নামে হোক, অথবা রাজা শশাঙ্ক, পালরাজা, সুলতানী ও নবাবী আমলে হোক। পলাশীর নাটকের পূর্বেও যদি আমাদের তদানীন্তন শাসকবৃন্দ ও জনগণ সঠিক দায়িত্ব পালন করতেন, তা হলে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা নামের স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব কেউ আটকাতে পারত না। শাসকদের ভুলে ও জনগণের নির্লিপ্ততায় পলাশীর দশ বছরের ভেতর শুধু স্বাধীনতাই ইংরেজদের হাতে গেল না, ইংরেজদের জুলুমে দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। এটা তো ছিল অন্য প্রকারের একটা মহা গণহত্যা- জেনোসাইড। অথচ না দেশি না বিদেশি ইতিহাসবিদরা এই গণহত্যা নিয়ে লেখালেখি করেন।
সমগ্র উপমহাদেশ যেমনভাবে বহু জনপদে বিভক্ত ছিল, বাংলার প্রাচীন এলাকাও তেমনিভাবে নানা জনপদে বিচ্ছিন্ন ছিল। যেমন গৌড়, বরেন্দ্র, সমতট, রাঢ় ইত্যাদি। ইসলামের আবির্ভাবে বাংলা একটা ইউনিটে পরিণত হয়। চর্যাপদে যদিও ‘বঙ্গালী’ শব্দটা প্রথম পরিলক্ষিত হয়, তবে তা তুচ্ছার্থে।
‘আজি ভুসুকু বাঙালী ভইলী
নিজ ঘরিলী চন্ডালে লেলী।
ভুসুক আজ বাঙালী হলো (যা ভুসুকু, আজ বাঙালিনী জন্মাল)- নিজের গৃহিণীকে নিয়ে গেল চন্ডালে।’
(সূত্র : ড. আনিসুজ্জমান, ‘চর্যাগীতির সমাজচিত্র’ পৃ. ৫)।
অধ্যাপক এবাদত হোসেন অবশ্য ওপরের গীতির দ্বিতীয় লাইনের এই অর্থসহ অন্য একটি অর্থও যোগ করেছেন এভাবে- ‘মতান্তরে- চন্ডালীকে নিজ গৃহিণী করে নিলো।’
(‘চর্যা-পরিচিত’, পৃ. ১৬৬)। গীতিকার এই দুই লাইনের ওপরের একটি লাইন হলো-
‘অদঅ বংগাল দেশ লুড়িউ।
অর্থ অদ্বয়রূপ বঙ্গাল দেশ লুট করলাম।
সৈয়দ আলী আহসান বলেন, ‘মূল পান্ডুলিপিতে দঙ্গালে দ্রেশ ছিল। তিব্বতী অনুবাদে আছে ‘বামআল’ (ইঅগএঅখ) (চর্যাগীতিকা, পৃ. ১০০)।
যাই হোক, ইসলামই বাঙালিকে মর্যাদার স্থানে বসিয়েছে। মুসলমানই নিজেদের গৌড়ীয়, বরেন্দ্রীয় ইত্যাদি না বলে বাঙালি বলেছে। লালবাগের কেল্লায় প্রাচীন কবরের সামনে নামফলকে মরহুমদের নামের অংশে ‘বাঙালী’ শব্দ দেখতে পাবেন। বাঙলার সুলতানরা নিজেদের সুলতান ‘বাঙলা’ ‘শাহ-ই-বাঙলা’ বলতে গর্ববোধ করতেন। কাঠমন্ডুতে সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ অভিযান করলে পরবর্তী কাঠমন্ডুবাসী স্বয়ম্ভু পাহাড়ে পাথরে খোদিত করে রাখে যে, ‘বাঙালী ফৌজ’ অত সালে এখানে অভিযান চালায়।
কথা হলো বাঙালির স্বকীয়তা, স্বাতন্ত্র্য ইসলামের আগমনে সম্পূর্ণতা পেয়েছে। আর এটা তো সত্যি কথা যে, এ অঞ্চলের লোকজন মুসলমান না হলে বাংলাদেশের জন্মই হতো না। বঙ্গবন্ধু এসব জানতেন। তাই তিনি বারবার ঘোষণা দেন যে, বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ। তিনি অনেককে ভেটো দিয়ে ওআইসিতে গেলেন। তিনি বললেন যে, ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মহীনতা নয়। ইদানীং এই ভাবধারা তার কন্যার ভেতরও দেখছি, যা একটা আশার বাণী। বঙ্গবন্ধু ইসলামের গুরুত্ব অনুধাবন করলেও সব ধর্মের মানুষের অধিকার ও নিরপত্তা নিশ্চিত করেছেন। আর এই নীতি আজ পর্যন্ত সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে। প্রতিবেশীদের চেয়ে এই রেকর্ড আমাদের অনেক ভালো। আর ইসলাম সমস্ত ধর্ম সম্প্রদায় তথা উপজাতির প্রতি ইনসাফ করে। কয়েকটি প্রমাণ : স্পেন-পর্তুগালে আরব শাসন, পূর্ব ইউরোপে তুর্কি শাসনে ও উপমহাদেশে সুলতানী-মোগল শাসনে। ইউরোপে যখন ইহুদিদের হত্যা করা হচ্ছিল, তখন তুর্কিরা ইহুদিদের আশ্রয় দেয়।
ভারসাম্য ও ইনসাফের ওপর ভিত্তি করে বঙ্গবন্ধু ও শহীদ জিয়ার পররাষ্ট্রনীতি ছিল। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তা ঠিকই ছিল। আমি তো জিয়ার পররাষ্ট্রনীতিকে বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির ‘এক্সটেনশন’ মনে করি। বঙ্গবন্ধু সাত দফা নাকচ করলেন ও ওআইসিতে গেলেন। জিয়া মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ় করলেন। আর তার পররাষ্ট্রনীতির ‘মাস্টার স্ট্রোক-ওস্তাদি কার্যক্রম হলো সার্ক’ প্রতিষ্ঠা। উপমহাদেশের সবাইকে নিয়ে বসে শান্তির পথ অন্বেষণ ছিল এটা। এটা ছিল বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে একটা ‘ফাইন টিউনিং’। সঠিক ভারসাম্য আনয়নের প্রচেষ্টা ছিল এটা। যত আঞ্চলিক ফোরামই করা হোক, সার্ক এখন পর্যন্ত ‘বেস্ট অপশন’। আমরা উপমহাদেশে সেই সব নেতার আগমনের অপেক্ষা করছি, যারা সার্ককে পুনর্জীবন প্রদান করবেন এবং উপমহাদেশে শান্তির হাওয়া আনবেন।
ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে হিন্দুত্বের মতাদর্শ জেঁকে বসায় এর প্রভাব বাংলাদেশে এসে পড়ছে। আসামে বিজেপি সরকার বলছে, চল্লিশ লাখ বাংলাভাষী মুসলমান বাংলাদেশি। আর বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন যে, সমগ্র ভারতে নাকি দুই কোটি বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী। শ্রীংলা যদিও বলছেন যে, এসব ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার কিন্তু কোনো বড় নেতা তো তা বলছেন না। শ্রীংলা তো শুধু একজন আমলা। বিজেপির বড় নেতারা তো বাংলাদেশের এলাকা দখলসহ আরো কড়া কথা বলছেন। আসলে বিজেপি সরকারের পর যদি পশ্চিম বাংলাতেও বিজেপি সরকার আসে, তাহলে সমূহ বিপদ আসবে আমাদের ওপর। ভাগ্য ভালো যে এতদিন রয়েছে সেখানে, হয় সিপি (এম) বা তৃণমূল। তবে এটা ভুললে চলবে না- বিজেপি, হিন্দু মহাসভা, আরএসএসের সূতিকাগার হলো পশ্চিমবঙ্গ। বঙ্কিম, বিবেকানন্দ, আশুতোষ মুখার্জি, শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি প্রমুখ নেতৃবৃন্দই হিন্দুত্ববাদের আদি গুরু।
আমাদের দেশের কেউ কেউ আবার আবেগের চোটে বলে ফেলে যে, এপারে-ওপারে একই সংস্কৃতি। এভাবে বললে তো আমাদের স্বাধীনতাই পানসে হয়ে যেতে পারে। আমরা নানাভাবে পৃথক বলেই তো আলাদা দেশ ও পতাকার দাবিদার। রাশিয়া সংস্কৃতি ও ভাষার অজুহাতে ইউক্রেনের ভূমি দখল করে চলেছে।
এপার বাংলা, ওপার বাংলা এ ধরনের কথাও বলা ঠিক নয়। অথচ আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ, তারা নয়। তারা অন্য নক্ষত্রের বলয়ে। আর আমরা ছোট হলেও পৃথক নক্ষত্র। আমরা কেন ব্ল্যাকহোলের ফাঁদে ঢুকব? ইউরোপেও বহু দেশ আছে, যেখানে এক দেশে প্রতিবেশীর ভাষাও চলে। ফরাসি, জার্মান, মেসিডোনিয়ান ইত্যাদি ভাষার মানুষ বিভিন্ন দেশে পড়েছে। তারা কিন্তু এপার ফরাসি-ওপার ফরাসি, এপার জার্মান-ওপার জার্মান বলে না। আফ্রিকা এক ভাষার লোক বিভিন্ন রাষ্ট্রের নাগরিক। নীরদ চৌধুরী একবার কটাক্ষ করে আমাদের বলেন, ‘সো-কলড বাংলাদেশ’ তারা যে ৪০ ভাগ। বাংলাদেশের জন্য বর্তমানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক। বারবার তারা রোহিঙ্গা মুসলমানদের তাড়াচ্ছে বাংলাদেশে। গণহত্যা ও পাইকারি ধর্ষণের মাধ্যমে দশ লাখ রোহিঙ্গাকে সম্প্রতি বাংলাদেশে তাড়িয়েছে তারা। রোহিঙ্গাদের ভাষা, চেহারা, গায়ের রঙ, ধর্ম সংস্কৃতি ইত্যাদি সেখানকার মতো নয়। আর কিছুটা বাংলাদেশের মতো, এই ছুতায় একটা সম্পূর্ণ নৃগোষ্ঠী তথা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে উৎখাত করলে তো পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে ‘এথনিক ক্লিনজিং’ হয়ে শরণার্থীর ঢেউ নামবে। বাংলাদেশেও তো নানা রঙের, ভাষার, ধর্মের মানুষ রয়েছে। খোদ মিয়ানমার থেকে আগত মানুষও আছে।
শুধু মুসলমানদের তাড়িয়ে দেয়া নয়, হেলিকপ্টার অনুপ্রবেশ করে যুদ্ধের উসকানি দেয় মিয়ানমার। বাংলাদেশ ধৈর্য ধরেছে, ভালোই করেছে। তবে কথা হলো সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা যায়, প্রতিবেশী যেমনি উপকারে আসে, তারাই আবার আক্রমণকারী হয়। তারা যদি আমাদের এলাকায় ঢুকেই পড়ে আরাকানের ইতিহাসের দোহাই দিয়ে, তা হলে তারা তো আমাদের হত্যা করবে, নারী ধর্ষণ করবে, মসজিদ ধ্বংস করবে। আমাদের প্রতিরক্ষাকে শক্তিশালী করতে হবে। আমাদের যদি খুদকুঁড়া খেয়ে অর্থ বাঁচিয়ে প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করতে হয়, তাই করতে হবে। ইউরোপের ইতিহাসে আমরা দেখি, প্রতিবেশী দেশগুলো প্রতিবেশীকে দখল করে ভাগ করে নেয়। পোল্যান্ডের ওপর এটা রাশিয়াও করে, জার্মানিও করে।
আরাকানের দোহাই দিচ্ছে তারা। অথচ অতীতে আরাকান একটা সহনশীল রাষ্ট্র ছিল, যেখানে সব ধর্মের মানুষ শান্তির সঙ্গে বাস করত। প্রাচীন আরাকান এখন মিয়ানমার ও বাংলাদেশের ভেতর পড়েছে। রোহিঙ্গা মুসলমানরা পুরাতন আরকানি।
সীমান্তের ওপারে যা-ই হোক, বাংলাদেশ চায় প্রতিবেশীদের সঙ্গে স্বাভাবিক, ন্যায়সঙ্গত সম্পর্ক। আমরা খামাখা ঝামেলায় জড়াতে চাই না। রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রুত সমাধান কাম্য।
লেখক : ইতিহাসবিদ ও প্রবন্ধকার
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন