অলস দুপুর। খানিকটা ভুতুড়ে-অদ্ভুতুড়ে। মানুষ ও পক্ষীর আনাগোনা খুব একটা চোখে পড়ার মতো নয়। দিনের অন্যসময়ের তুলনায় এই সময়ে প্রকৃতিও স্বাভাবিকভাবে কিছুটা বিষন্ন ও ফাঁকা থাকে। ঝিমিয়ে পড়া প্রকৃতি দেখে চন্দনা বরাবরি অভ্যস্ত। কিন্তু তবুও আজ কোথাও যেন একটু অস্বস্তি-অস্বস্তি লাগছে। একজোড়া লোলুপ দৃষ্টি তাকে ফলো করছে যেন। ধারেকাছে কারো টিকিটির চিহ্ন নেই, তবুও মনে হচ্ছে কোথাও কেউ ঘাপটি মেরে ওঁৎ পেতে রয়েছে। তাকে গোগ্রাসে গিলে খাওয়ার চেষ্টা করছে। চন্দনা একরাশ চাপা অস্বস্তি নিয়ে এগোয়। হাতে একখানা সাবান কেস নিয়ে সামনে পা বাড়ায়। একটু এগিয়ে কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। এদিক ওদিক সতর্ক চোখে পুনঃ পরখ করে নেয়। না, কেউ নেই। কানকাটা জগলুটাকে একদম বিশ্বাস নেই। হেন কোনো আকাম নেই পারেনা। কু-কর্মের সিদ্ধহস্ত পাষন্ড পাজি একটা। সে পাড়ার পাটোয়ারি বেপারির উচ্ছনে যাওয়া বখাটে লম্পট ছেলে। যেমন বাপ তেমনি তার ছেলে। নারী শরীরের গন্ধ পেলেই হুঁশ থাকে না। শুকে শুকে জোকের মতো ঠিকই হঠাৎ কোত্থেকে এসে হাজির হবে। আজকাল চন্দনার শরীরের প্রতি মজেছে সে। কেমন জানি ড্যাবড্যাব চোখে চেয়ে থাকে। বেলা পড়ে যাচ্ছে। চন্দনা বাড়ির পার্শ্বে বয়ে চলা সর্পিলাকৃতি নোয়াগাঙের স্বচ্ছ পানিতে টুপ করে নেমে পড়ে। কোনো প্রকার রাখঢাকের বালাই নেই। অজান্তেই চন্দনার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। চারপাশটা আরো একবার দেখে নিয়ে নিজের ক্লান্তশ্রান্ত গতরখানা সঁপে দেয় গাঙের জলে। ভাসিয়ে দেয় নিজেকে। কিছুক্ষণ রাজহংসীর ন্যায় জলতরঙ্গে জলকেলি করে। ঘঁষামাজায় নিজেকে সাফসুতরো করে। এদিকে দেশের পরিস্থিতিও আজকাল খুুুব একটা ভালো যাচ্ছে না। যুদ্ধবিগ্রহ প্রায় বাঁধল বলে। চতুর্দিকে ডামাডোল ক্রমশ বেজে উঠেছে। চন্দনা বাবার মুুখে প্রতিদিনই সব শুনে আসছে। পাড়ার মা-চাচিদের মুখেও নানান কথা শোনা যায়। হাটেবাজারে ও দোকানপাটে প্রতিদিন মানুষের জটলা বাঁধছে। নানা জনে নানান কথা বলেকয়ে বেড়াচ্ছে। সকাল-সন্ধ্যে রেডিও টেলিভিশনের খবরে মানুষজন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। সেদিন রাত্রে পাড়ার জলিল কাকুর সঙ্গে বাবার আলাপচারিতার সবটুকুই চন্দনা আড়াল থেকে শুনেছে। অজানা আশঙ্কায় মুহুর্মুহু কেঁপে ওঠেছে মন। যুুুদ্ধে বহু ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে। আজকাল নিজেকে নিয়েও যত উটকো দুঃশ্চিন্তা তার। একজোড়া শ্যেনদৃষ্টি সুযোগ পেলে দেহটাকে গোগ্রাসে গিলতে চায়। চন্দনা তাড়াহুড়ো করে ডুব দেয়। দূূরে কোথাও কোনো এক রাখালের বিবাগী বাঁশির সূর কানে ভেসে আসছে। তেপান্তরের মাঠ পেরোনো সেই বিমূর্ত সূূর ছাপিয়ে চন্দনার কেন যেন আজ কু ডাক গাইছে মনে। তড়িঘড়ি করে ভেজা কাপড়ে কোনোমতে দ্রুত ফিরে আসে।
নোয়াগাঙ। মানচিত্র থেকে মুছে যাওয়া একসময়ের প্রবহমান প্রমত্তা খিরি নদীর একটি শাখা আজো ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে কুলুকুলু নাদে বয়ে যাচ্ছে। গাঙের পাড় ঘেষা ছবির মতো সুন্দর একটি গ্রাম হৃদয়পুর। এই গাঁয়েরই মেয়ে চন্দনা। গাঙের স্বচ্ছ নয়া পানিতে প্রতিদিনকার মতো দ্রুত দুপুরের গা-গোসল সেরে নেয়। বৃদ্ধ বাবাকে জলদি খাবার খাওয়াতে হবে। চন্দনা পড়িমরি করে দৌড়ে বাড়ি এসে ঢুকে। ঘরে ঢুকতেই দেখে বাবা বারান্দার জলচৌকিতে বসে অপরিচিত এক সুদর্শন ছেলের সঙ্গে কথা বলছে। আকস্মিকতায় নিজেকে আড়াল করার ফুরসত পায়না চন্দনা। তার ভেজা কাপড়ে লেপ্টে থাকা শরীরে ছেলেটির দৃষ্টিতে পড়ে যায়। তবুও কোনোমতে সংবরণ করে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করে। বাইরে তাদের আলাপচারিতা কী নিয়ে, সেটা শোনার বৃথা চেষ্টা করে। কিন্তু বাবার দু-একটি কথা শোনা গেলেও ছেলেটির কথাবার্তার মাথামুন্ডু তেমন কিছুই বুঝা গেল না। চলে যাওয়ার আগ মুহূর্তে ছেলেটি মাথা ঝুঁকে বাবাকে সালাম করে নেয়। এদিক-ওদিক কাউকে খোঁজার মতো কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলে, ‘তো চাচা আজকের জন্য তবে আসি, ইনশাআল্লাহ খুব শিগগির আবারো দেখা হবে, আসসালামু আলাইকুম।’ বাবা হাত তুলে বিদায় জানান, ‘জ্বি বাবা, আজকে তবে এসো’। চন্দনা বেড়ার ফাঁক গলিয়ে স্পষ্ট দেখতে পায় তার ষাটোর্ধ পিতা ছেলেটির গমন পথের দিকে পরম তৃপ্তিতে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে। মুখে কিছুটা সন্তুষ্টির রেখাচিত্র এঁকে দু’হাত তোলে আরশের মালিক ওপরঅলার দিকে। মুহূর্তে কান্না ও রোনাজারিতে বিড়বিড় করে বুক ভাসিয়ে যায়। চন্দনা স্পষ্ট শুনতে পায় পিতার অশ্রুত আর্তনাদ ধ্বনি। অলক্ষ্যে সেও হাত তোলে শামিল হয় অশীতিপর বৃদ্ধ বাবার সঙ্গে, ‘হে দয়াময় খোদা! আজ দেশের অবস্থা খুব দুর্দিন, পরিস্থিতি ভালো যাচ্ছে না, যে কোনো মুহূর্তে যুদ্ধবিগ্রহ বেঁধে যাওয়ার উপক্রম। আমার শরীরটাও আজকাল ভালো যাচ্ছে না, কখন কী ঘটে জানি না। মা-মরা আমার চন্দনা পাখিটির দিকে তুমি চেয়ে দেখো। ওকে ভালো একটি ছেলের হাতে সঁপে দিতে না পারলে, মরেও যে আমি শান্তি পাবো না।’ চন্দনার হৃদয় হু হু করে কেঁদে ওঠে বাবার আবেগময় কথাগুলো শুনে। ওড়নার আচলে নিজের চোখ মুছে। মুনাজাত শেষে বাবা জোরে হেঁকে ওঠে, ‘কইরে আমার চন্দনা মা, কোথায় গেলি?’ চন্দনা তড়িঘড়ি করে দরজা খুলে, ‘এই তো বাবা, আমি এখানেই আছি। জলদি ভাত খাবে এসো। আমি এক্ষুণি তোমাকে খাবার বেড়ে দিচ্ছি। তুমি হাতমুখ ধুয়ে এসো।’ অল্প কয়েক মিনিটের মধ্যে বৃদ্ধ আফজাল মিয়া খাবার খেতে বসে। চন্দনা একে একে সবকিছু বাবার সম্মুখে এগিয়ে দেয়, যত্ম করে বাবাকে খাওয়ায়। একবার ভেবেছে আগন্তুক ছেলেটি সম্পর্কে কিছু জানতে চাইবে, কিন্তু পরক্ষণে ফের নিজেকে লজ্জাবতীর ন্যায় গুটিয়ে নিয়েছে। খাবার খেতে খেতে আফজাল মিয়া মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘বুঝলিরে মা, কায়সার ছেলেটি খুব ভালো। অনেক ভদ্র, নম্র ও শিক্ষিত। এমন আদবকেতা আজকের যুগের ছেলেদের মধ্যে খুব একটা দেখা যায় না। পাশের গাঁয়ে থাকে। আমার একসময়কার প্রিয় বন্ধুর ছেলে। বাবা নেই। ঘরে শুধু ওর বৃদ্ধা মা আছে, রোগে শয্যাশায়ী। দূর সম্পর্কিত এক চাচি দেখাশোনা করে। দেখবি ছেলেটির সঙ্গে তোকে দারুণ মানাবে। দেশের যা পরিস্থিতি যে কোনো মুহূর্তে যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। ভালোয় ভালো ছেলেটার সঙ্গে তোর বিয়েটা দিতে পারলেই আমি বাঁচি। মরেও আমি শান্তি পাবোরে মা।’ খাবার খেতে খেতে একনাগাড়ে কথাগুলো মেয়েকে বলে যায় বাবা। হঠাৎ চোখ তুলে মেয়ের দিকে তাকিয়ে কিছুটা অবাক হন তিনি, ‘কিরে মামণি, খাবি না?’ চন্দনা একমনে বাবার কথাগুলো শুনছিল। ‘তুমি খাও বাবা, আমি একটু পরেই খাচ্ছি।’ মেয়ের কথা শুনে পিতার উৎকণ্ঠা কমেনা, বেড়ে যায়। ‘কস কিরে মা, তোর শরীর-টরির খারাপ করেনি তো!’ চন্দনা পিতাকে আশ্বস্ত করে বলে, ‹না বাবা, আমার কিছুই হয়নি, আমি বরং বিলকুল ঠিক আছি। তুমি শুধু শুধু দুঃশ্চিন্তা করোনা।’ মেয়ের কথা শুনে আফজাল মিয়া আর কথা বাড়ায় না। একমনে অবশিষ্ট খাওয়াটুকু শেষ করে। হঠাৎ ছেলেটার সাথে বাবার আলাপচারিতা ও মুনাজাতের পর চন্দনা বেশ আঁচ করতে পেরেছে, কী হতে যাচ্ছে সামনের দিনগুলোতে। তাই লজ্জা, আড়ষ্টতা ভেঙে এই মুহূর্তে মুখে কিছু তুলতে ইচ্ছে করছে না তার। এসব ক্ষেত্রে বাঙালি মেয়েরা বরাবরই মা-বোনদের সাহচর্য বা আনুক‚ল্য পেয়ে থাকে, নিজেদেরকে তাদের আঁচলের তলায় লুকোতে চেষ্টা করে। কিন্তু সেদিক থেকে বলতে গেলে চন্দনার দুর্ভাগা কপাল। জন্মের দু’বৎসরের মাথায় মাকে হারিয়েছে সে।
অল্প কয়েকদিনে মধ্যে কায়সারের প্রতি চন্দনার মুগ্ধতা ক্রমশ বেড়ে যায়। এরই মধ্যে দু’জনার বেশ কয়েকবার কথাবার্তা হয়। ভাব-ভালোবাসা ও পারস্পরিক শ্বাস-প্রশ্বাসের অণুগুলো আদান-প্রদান হয়। কায়সারের শিক্ষা, সংস্কার ও পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিত্বের আভাটুকু মুহূর্মুহূ প্রকাশ পেতে থাকে চন্দনার নিকট। স্বপ্নের জাল বুনতে থাকে দু’জন। একটি দুটি করে স্বপ্নেরা ডালপালা মেলতে থাকে চতুর্দিকে। কায়সার স্বভাবতই স্বল্পভাষী। অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা ও অপ্রাসঙ্গিকতা বরাবরি এড়িয়ে চলে। উভয়পক্ষের জনাকয়েক ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে বিয়ের দিনক্ষণ, তারিখও নির্দিষ্ট হয়। ২০ মার্চ ১৯৭১। হাতে সময় একদম বেশি নেই। এদিকে চতুর্দিকের ঘটনাপ্রবাহ বলছে যুদ্ধটা প্রায় নাকের ডগায়। উভয়পক্ষ মুখোমুখি অবস্থানে। এরই মধ্যে ৭ মার্চের রমনা রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকণ্ঠে বিভোর পুরো জাতি। তিনি ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বঙ্গবন্ধুর এই জ্বালাময়ী ভাষণ শোনার পর কোনো বাঙালির মনেই আর দ্বিধা রইল না। আফজাল মিয়া হাঁট থেকে অনেকটা দৌড়ে এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে, ‘মারে যুদ্ধ তো লেগে গেল রে মা।’ এদিকে সারাদেশের মুক্তিপাগল মানুষ দলে দলে প্রস্তুতি নিতে থাকে স্বাধীনতার জন্য। বঙ্গবন্ধুর ডাকে ইতোমধ্যে অসহযোগ আন্দোলনে সাড়া দিয়েছে দেশের আপামর ছাত্র-জনতা। পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত সরকারি অফিস-আদালত, ব্যাংক-বীমা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবকিছুই চলতে থাকে তাঁর অঙ্গুলি নির্দেশে। অন্যদিকে সর্বত্র চলতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ও ডঙ্কা। চারদিকে সাজ সাজ রব। সবাই প্রস্তুত মরণপণ মুক্তিযুদ্ধের জন্য। শত্রুপক্ষও বসে নেই। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানি সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং তার দোসর জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নাম করে একদিকে কালক্ষেপণ করছিল এবং অন্য দিকে বাঙালি জাতির ওপর ভয়ঙ্কর হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ১৭ মার্চের রাতের আঁধারে কায়সার কালো একখান কাপড়ে মুখ ঢেকে চন্দনার সঙ্গে দেখা করতে আসে। সে এশার নামাজ আদায় করে সবেমাত্র মসজিদ ফেরত বাবার অপেক্ষায় রয়েছে। কায়সারকে আজ হঠাৎ এভাবে আসতে দেখে চন্দনাও একটু অবাক হয়, ‘কায়সার তুমি! সেকি! তোমার এই অবস্থা কেন?’ কায়সার চন্দনার দু’ঠোটের মাঝখানে নিজের শাহাদাত আঙ্গুলটাকে আড়াআড়িভাবে রেখে বলে, ‘চুপ, আস্তে কথা বলো, কেউ শুনতে পাবে। বাইরে রাস্তার মোড়ে জগলুকে দেখলাম সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে মদ্যপ অবস্থায় আড্ডা দিচ্ছে। আমি কোনোভাবে ওদের চোখে ধুলো দিয়ে চলে এসেছি। শোনো, হাতে আমার একদম সময় নেই। আমি আজি মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছি। দেশের এই শত্রুবেষ্টিত দুর্দিনে আমি চুপ করে থাকতে পারি না। আমার মতো দেশের হাজারো যুবক আজ দলে দলে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে শপথ নিচ্ছে। এমতাবস্থায় একজন সচেতন যুবক হিসেবে নির্বিকার ঘরে বসে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। তোমাকে পাবো বলেই সবার আগে দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করতে হবে। একটি স্বাধীন দেশে তোমাকে নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতে চাই। যেখানে একদিন আমাদের সন্তানেরাও বিশুদ্ধ নির্মল বাতাসে হেসে খেলে বড় হবে। প্রিয়তমা চন্দনা, দেয়ালে পীঠ ঠেকে গেছে আমাদের। তাই অত্যন্ত যৌক্তিক কারণে বিয়েটা পিছিয়ে দিতে হচ্ছে। প্লিজ লক্ষীটি রাগ করো না, আমাকে ভুল বুঝো না। নিজেকে সতর্ক ও সাবধানে রেখো। বাবার দিকেও খেয়াল রেখো। কথা বলতে বলতে চন্দনার হাত দু’টি অজান্তেই কায়সার নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নেয়। অশ্রুসজল চোখে কায়সারের সবগুলো কথা একনাগাড়ে শুনে যায় চন্দনা। ভালোবাসার মানুষটিকে একসমুদ্র উদ্বেলিত আবেগে ভালোবাসায় ও শ্রদ্ধায় এই প্রথমবারের মতো উষ্ণ বুকে শক্তহাতে জড়িয়ে ধরে। অস্ফুটস্বরে বিড়বিড় করে বলে, ‘কায়সার আমি তোমারি আছি, তোমারই থাকব। কেউ আমাকে তোমার এই সিঞ্চিত জমিন থেকে আলাদা করতে পারবে না। নিশ্চয় তোমার অপেক্ষায় প্রতীক্ষার প্রহর গুনব আমি। অতীব ভাগ্যগুণে তোমার মতো এমন হীরের টুকরো ছেলেকে আমি পেয়েছি। জানি না এই সুখ আমার কপালে সইবে কি-না। তুমিও সাবধানে থেকো বন্ধু। সুযোগ পেলে অবশ্যই যোগাযোগ রেখো।’ অব্যক্ত বেদনায় ও ভালোবাসায় সিক্ত হয় দু’জন।
২৫ মার্চ ১৯৭১। গোটা পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালির জীবনে দুঃস্বপ্নের কালো রাত নেমে আসে। রাতের আঁধারে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী শুরু করে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের বাঙালি নিধনযজ্ঞ। মুক্তিপাগল জাতি এই নারকীয় বীভৎস হামলায় ভীতসন্ত্রস্ত না হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে গড়ে তুলে মানববুহ্য প্রতিরোধ। ২৫ মার্চ একদিকে যেমন কালোরাত, তেমনি প্রতিরোধেরও বটে। পাটোয়ারি বেপারি ও জগলুরা ইতোমধ্যে পাকি শত্রুদের সাথে হাত মিলিয়েছে। পাক হানাদার বাহিনী দেশব্যাপী ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড ও হীন উদ্দেশ্যকে চরিতার্থ করার জন্য কিছু দেশবিরোধী এ দেশীয় দোসরদের নিয়ে নৃশংস বিভৎসতায় মেতে উঠে। বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে চন্দনা ভীতি জাগানিয়া এক বিপদসঙ্কুল পরিবেশে দিন কাটাতে লাগল। জগলু এখন আগের চেয়েও অনেক বেশি বেপরোয়া। বাড়ির আশেপাশে সারাক্ষণ ঘুর ঘুর করে বেড়ায়। চন্দনাকে উদ্দেশ্য করে অশ্লীলতার বিষবাষ্প ছড়ায় বাতাসে। রোগে শোকে শয্যাশায়ী বৃদ্ধ আফজাল মিয়া। মাঝেমধ্যে প্রতিবাদী হতে গিয়েও মেয়ের বারণ শুনে চুপসে যায়। যুদ্ধের প্রথম কয়েকমাস কায়সারের সঙ্গে চন্দনার বেশ নিয়মিতই যোগাযোগ ছিল। রাতের আঁধারে কখনো কখনো হুট করে এসে দেখা করে আবারো চলে যেত। অথচ মাসদুয়েক হলো ছেলেটির কোনো খোঁজখবর নেই। টেনশন ও চাপা আর্তনাদে চন্দনার দু’চোখের ঘুমনিদ্রা উবে গেছে। এখানে রাত নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুপুরীর বিভীষিকা নেমে আসে। সন্ধের পরপরই অদ্ভুতভাবে শ্মশানের ভয়ঙ্কর নিরবতা ভর করে গোটা জনপদে। গুলি আর বোমার প্রকম্পিত বিকট আঘাতে কেঁপে ওঠে মুহূর্মুহূ চারদিক। কুপির সলতে’তে নিভু নিভু করা সামান্য আলোটুকু দেখেও গা ছমছম করে। কখনো কখনো খসে পড়া পাতার শব্দেও অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায়। আষাঢ় মাস। বাহিরে একটু একটু বৃষ্টি ঝরছিল। রাত প্রায় শেষ প্রহরের দিকে। এমনি সময়ে খাকি পোশাকের চারজন পাক সৈন্যের সঙ্গে জগলু সাঙ্গপাঙ্গসহ চন্দনার গৃহের বেড়া ভেঙে অতর্কিত প্রবেশ করে। অসুস্থ ঘুমন্ত আফজাল মিয়াকে দু’জনে টেনেহিঁচড়ে জোরপূর্বক বাহিরে নিয়ে যায়। উঠোনের পশ্চিম কোণে পুরাতন সজনে গাছের সঙ্গে তাকে শক্তভাবে বাঁধে। কানকাটা জগলু চন্দনাকে পাঁজাকোলা করে বারান্দায় জলচৌকিতে নিয়ে আসে। চার-পাঁচজনের কড়া বেষ্টনীতে জগলু ঝাঁপিয়ে পড়ে চন্দনার যৌবনবতী দেহটার ওপর। পাশবিকতার আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত করে তার সমস্ত অঙ্গ। মুহূর্তে একরত্তি দেহটাকে দুমড়েমুচড়ে একাকার করে দেয় পাষন্ডগুলো। পালাক্রমে চলতে থাকে ধর্ষণের মহোৎসব। শেষ চেষ্টা হিসেবে চন্দনা গায়ের সর্বশক্তি এককরে জগলুর গোপনাঙ্গ বরাবর সজোরে মারে লাথি। ‘শুয়োরের বাচ্চারা’ বলে মুহূর্মুহূ খিস্তি ও অভিসম্পাত করে। মুহূর্তে জগলুর কেয়ামত ঘটিয়ে চিৎকার মেরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ দাপাদাপি করে চন্দনার লাথি খেয়ে অঘোরে প্রাণ হারায় পিশাচরূপী জানোয়ারটা। আকস্মিক প্রাণভয়ে সাঙ্গপাঙ্গরা চুট মারে চতুর্দিকে। গলাকাটা মুরগির মতো চন্দনা মুখে ফেনা তুলে গোঙাতে থাকে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে মেয়েটি। বর্ষণমুখর ভারি প্রকৃতিকে ভেদ করে বৃদ্ধ বাবার আর্তনাদধ্বনি বেশি দূর এগোতে দেয়নি বর্বর পাকি শত্রুরা। বুলেটের আঘাতে ছিন্নভিন্ন করে দেয় তার শীর্ণকায় শরীরটাকে। মাত্র এক প্রহরে বিপন্ন হয়ে যায় সমস্ত কিছু। সুবহে সাদিকের আঁধার কাটতে না কাটতে কায়সার ফিরে আসে। দীর্ঘপথ ও রক্তসাগর ফেরিয়ে প্রিয়তমা চন্দনার জন্য নিয়ে আসে মুঠোফুরে কাক্সিক্ষত স্বপ্নের স্বাধীনতা। সে জানে না কী অপেক্ষা করছে তার জন্য! কিছুক্ষণ আগেই সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। সারা উঠোনময় রক্তের স্রোত, ছোপ ছোপ দাগ, বৃদ্ধ চাচার ক্ষতবিক্ষত দেহ ও প্রেয়সীর ধর্ষিত লাশ দেখে মুহূর্তে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কায়সার।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন