সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ৩০ বৈশাখ ১৪৩১, ০৪ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

পরিস্থিতি যেন নো ইলেকশনের দিকে না যায়

| প্রকাশের সময় : ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:১১ এএম

বিএনপি, ২০ দল ও জাতীয় ঐক্যফ্রণ্টের প্রার্থীসহ বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণায় বাধাদান, হামলা, ভাংচুর ইত্যাদি অব্যাহত আছে। সরকারদলীয় নেতাকর্মী-সমর্থকদের এই দৌরাত্ম্য ও হিংসাত্মক কার্যকলাপ, নির্বাচনের দিন যত এগিয়ে আসছে ততই বাড়ছে। পাশাপাশি পুলিশের মামলা ও গ্রেফতারও বাড়ছে। পুলিশের ধরপাকড় থেকে এমনকি প্রার্থীরাও রেহাই পাচ্ছেন না। ইতোমধ্যে একাধিক প্রার্থীসহ বিরোধীদলীয় শত শত নেতাকর্মী ও সমর্থককে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এই দ্বিমুখী চন্ডনীতি ও পদক্ষেপের কারণে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সম্ভাবনা ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছে। নির্বাচনের অভয় পরিবেশ ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বলতে কিছু নেই। এই যে হামলা-মামলা-গ্রেফতার এবং ভয়ের রাজত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা, তার বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন কোনো পদক্ষেপ ও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। অভিযোগের পাহাড় জমলেও নির্বাচন কমিশন ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ হয়ে আছে। এহেন বাস্তবতায় নির্বাচন যথার্থ অংশগ্রহণভিত্তিক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে কিনা, ভোটাররা তাদের ভোটোধিকার প্রয়োগে নির্বাধ সুযোগ পাবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। শুধু তাই নয়, নির্বাচন আদৌ হবে কিনা, সে আশংকাও অনেকের মধ্যে ছায়া ফেলেছে। বিশিষ্ট নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ ‘সেই অনেকের’ মধ্যে একজন, যিনি বলেছেন, নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণার সময়ই সংঘাত ও হামলার ঘটনা দেখে মনে হচ্ছে, পরিস্থিতি নো ইলেকশনের দিকে যাচ্ছে। জাতীয় ঐক্যফ্রণ্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন স্বয়ং এমন আশংকা তৈরি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। বলেছেন, ক্ষমতাসীনরা জনমত বুঝে গেছে। এ জন্য তারা অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে চায় না। নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ না হয় ক্ষমতাসীনরা সে চেষ্টাই করছে। এমন অবস্থায় এই নির্বাচন হবে কি কিনা, তা নিয়ে আশংকা তৈরি হয়েছে।
একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণভিত্তিক নির্বাচন জাতির একান্ত ও অনিবার্য প্রত্যাশা। আন্তর্জাতিক মহলও এমন নির্বাচনই কামনা করছে। সংশয় ছিল, নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ করবে কিনা। সে সংশয় ইতোমধ্যেই তিরোহিত হয়েছে। সব দল নির্বাচনে অংশ নিতে এগিয়ে এসেছে। এটা একটি ইতিবাচক দিক। তবে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা এবং বিশেষ করে প্রচার-প্রচারণা শুরু হওয়ার পর হামলা-মামলা ও গ্রেফতারের যে তান্ডব শুরু হয়েছে, তাতে বিরোধীদল মাঠেই নামতে পারছে না। এ অবস্থায় নির্বাচন কতটা অংশগ্রহণমূলক হবে সেটাই প্রশ্ন। এখানে উল্লেখ করা দরকার, সব দলের অংশগ্রহণই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের একমাত্র বৈশিষ্ট্য নয়। দলমত নির্বিশেষে সকল ভোটারের ভোটে অংশগ্রহণও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। উদ্ভূত বাস্তবতা তো এমন যে, বিরোধীদলের প্রার্থীরা ভোটারদের কাছেই যেতে পারছে না। তাদের কর্মী-সমর্থকরা প্রচÐ ভয়ভীতি ও আতংকের মধ্যে আছে। এহেন পরিস্থিতিতে সকল ভোটারের ভোটদানে স্বত:স্ফূর্ত অংশ কিভাবে আশা করা যায়? এই নির্বাচনও যদি একতরফা হয়, প্রশ্নবিদ্ধ হয় কিংবা নির্বাচনটি যদি আদৌ না হয় তবে দেশজাতি শোচনীয় বিপর্যয়ের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হবে। এ ব্যাপারে দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষকদের মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই। একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন বা নো ইলেকশনের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবিলার সামর্থ দেশজাতির নেই। পর্যবেক্ষকদের সকলেই একমত, ২০১৪ সালের বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের ফলে দেশে একটি কর্তৃত্ববাদী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যার জনগণের কাছে কোনো দায়বদ্ধতা নেই। জনগণের কাছে জবাবদিহিতার বাধ্যবাধকতামুক্ত সরকার কর্তৃত্ববাদী হতে বাধ্য। এই সরকারের আমলে দমন-পীড়ন, নিরাপত্তাহীনতা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, বিচারহীনতা এবং সুশাসনের অভাব অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। তথাকথিত উন্নয়নের ইট-কাঠ-পাথরের নিচে গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মৌলিক মানবিক ও সংবিধানিক অধিকার চাপা পড়ে গেছে। দেশের মানুষ এ অবস্থার পরিবর্তন চায়। নির্বাচনই সেই পরিবর্তনের একমাত্র উপায়। অতএব নির্বাচনটি হতেই হবে এবং হতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ, যাতে তাতে জনমতের সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটে।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে, জনগণের সকল ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে, উন্নয়নের ধারা সচল রাখতে এবং অর্থনৈতিক বিকাশ তরান্বিত করতে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অপরিহার্য। প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন বা নো ইলেকশন এর বিকল্প হতে পারে না। দেশ জুড়ে উন্নয়নের ফানুস উড়লেও দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা মোটেই ভালো নয়। আমদানি, রফতানি, রেমিটেন্স, রাজস্ব আদায় ইত্যাদির মত অর্থনিিতর গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলো নিম্নগামী। বিনিয়োগ নেই। উৎপাদনে চলছে নানা বিভ্রাট। এরূপ সংকটকালে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হলে, গণতান্ত্রিক ধারা ব্যহত হলে পরিস্থিতি কি দাঁড়াবে তা ব্যাখ্যার অবকাশ রাখেনা। সরকার ক্ষমতায় থাকতে চায়, নির্বাচনে সরকারী দলের বিজয় চায়। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এই চাওয়ার পাশাপাশি একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা ও সরকারের দায়িত্ব। সরকারের উচিৎ, নির্বাচন কমিশনকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়া। নির্বাচন কমিশনেরও মেরুদন্ড সোজা করা দরকার। কারো তল্পী বহন নির্বাচন কমিশনের কাজ নয়। তার কাজ নির্মোহভাবে, নিরপেক্ষতার সঙ্গে সাংবিধানের নির্দেশ প্রতিপালন করা। দেশজাতির বৃহত্তর স্বার্থেই আমরা আশা করি, নির্বাচন কমিশন তার সংবিধাননির্দেশিত দায়িত্ব পালনে ব্রতী হবে, সচেষ্ট হবে, কঠোর হবে এবং এর মাধ্যমে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ ও লেভেল প্লেয়িং নিশ্চিত করবে। নির্বাচন কমিশনকে তার দায়িত্ব পালনে পূর্ণ সহযোগিতা দিতে সরকার এগিয়ে আসবে, আমরা এটাও প্রত্যাশা করি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন