এবারের নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন ভোটারপ্রতি খরচ নির্ধারণ করে দিয়েছে সর্বোচ্চ ১০ টাকা। প্রতি নির্বাচনী আসনে প্রতি প্রার্থীর খরচ ২৫ লাখ টাকার বেশি হবে না। কমিশনের এ বিধান কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। বাস্তবে প্রার্থীরা আরও অনেক বেশি টাকা খরচ করছেন। এ নির্বাচনে সব মিলে ২ হাজারের বেশি প্রার্থী অংশ নিচ্ছেন। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের পক্ষে ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে টাকা ব্যয় করা। ভোটারদের কাছে টানতে টাকা, উপহার, প্রলোভন, অনুরোধ ও ভয় থেকে শুরু করে নানারকম চেষ্টা চলছে এলাকাভেদে। এসব প্রার্থী ইতোমধ্যে প্রচার-প্রচারণা, ভোটার সমাগম করে মনোয়নপত্র সংগ্রহ ও জমার মতো কাজে অনেক টাকা ব্যয় করছেন। স্থানীয় ক্লাব, সমিতি বা এলাকাভেদে প্রার্থীরা নানাভাবে প্রতিশ্রæতি পূরণ করতে টাকা খরচ করছেন। প্রচারের কাজে মাইক ভাড়া, পরিবহন ভাড়া, কর্মীর খরচ, পোস্টার, ফেস্টুন তৈরি, ছোট ছোট তোরণ তৈরি, কর্মীদের জন্য চা-নাশতা, বিভিন্ন বাজার বা লোকসমাগম হয় এমন স্থানগুলোয় নির্বাচনী ক্যাম্প স্থাপনখাতে টাকা খরচ করছেন। গ্রামে ও শহরে নির্বাচনী প্রচারে এবার নতুন যুক্ত হয়েছে মোটরসাইকেল। মোটরসাইকেল ভাড়া নিয়ে প্রার্থীর পক্ষের লোকজন প্রচারে নেমে গেছেন। এসব মিলে নির্বাচন কেন্দ্র করে সারাদেশে এখন টাকা উড়ে বেড়াচ্ছে।
এ ছাড়া প্রার্থীদের সংবর্ধনা, প্রার্থীদের শুভেচ্ছা জানানোর নামে করা হচ্ছে আলোচনা সভা। ওই আলোচনা সভা ব্যয়ের একটি অংশ মেটাচ্ছেন প্রার্থীরাই। পাশাপাশি অনেক দিনমজুর ও স্বল্প আয়ের মানুষ এ সুযোগে আয় রোজগারের পথ বেছে নিয়েছেন নির্বাচন ঘিরে। ঢাকা থেকে ইতোমধ্যে অনেক চলে গেছেন গ্রামে। বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষে নিয়মিত কাজ করছেন। বিনিময়ে দিন শেষে হাজিরাও পাচ্ছেন। তবে এ বছর স্বতস্ত্র প্রার্থীরা বেশি অর্থ ব্যয় করবেন। কারণ তারা জয়ী হওয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়ে নেমেছেন মাঠে। নির্বাচনে টাকার মালিকরা অংশগ্রহণ করছেন। ফলে বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয় হবে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) বেঁধে দেয়া নির্ধারিত সিলিংয়ের মধ্যে কোনো প্রার্থী তাদের ব্যয় সীমাবদ্ধ রাখবে না। এটা অনেকটা টাকা দিয়ে গণতন্ত্র কেনার প্রতিযোগিতা হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে অনেকে। টাকার বিনিময়ে গণতন্ত্রের কোনো মূল্য নেই।
৩০০টি নির্বাচনী আসনের প্রতিটিতে কমপক্ষে তিনজন করে প্রার্থী থাকেন। ওই হিসাবে প্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৯০০। প্রতি প্রার্থী বৈধভাবে ২৫ লাখ টাকা ব্যয় করলে আর্থিক পরিমাণ দাঁড়াবে ২২৫ কোটি টাকা। কিন্তু একজন প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয় কখনই ২৫ লাখ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। প্রতিটি আসনে প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীর প্রত্যেকের ৩ কোটি থেকে ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যয় হবে। এতে প্রার্থীদের ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়াবে ৯০০ কোটি টাকা থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা। আর তিনজন করে প্রার্থী ওই হারে টাকা খরচ করলে খরচ দাঁড়াবে ২ হাজার ৭০০ কোটি থেকে ৯ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে কোনো কোনো আসনে শতকোটি টাকা খরচ হবে বলে অনেকের ধারণা। এই বিপুল পরিমাণ অর্থের বড় অংশই যাবে ভোটারদের কাছে। ফলে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে টাকার প্রবাহ বেড়ে যাবে।
আসন্ন নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণের কারণে নির্বাচনী ব্যয় রেকর্ড ভঙ্গ করছে। নির্বাচন ঘিরে প্রাথমিক হিসাবে এ ব্যয় ৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। প্রার্থীদের ন্যূনতম ব্যয়, ইভিএম প্রকল্পে আংশিক বরাদ্দ, নির্বাচন কমিশন ও গোয়েন্দা সংস্থার ব্যয়, আনসারদের অতিরিক্ত ভাতাসহ আনুষঙ্গিক কাজে বিপুল পরিমাণ এ অর্থ ব্যয় হবে।
সূত্র মতে, ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) প্রকল্পের আংশিক বাস্তবায়নে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা, নির্বাচন কমিশনের ব্যয় ৭৩২ কোটি টাকা, প্রার্থীদের ব্যয় প্রায় ৯০০ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা, গোয়েন্দা সংস্থার প্রস্তুতিমূলক ব্যয় ৩০ কোটি টাকা, আনসারদের বর্ধিত ভাতায় ব্যয় হবে ২৪৩ কোটি টাকা। ফলে সাধারণ ভোটারদের পাশাপাশি এ অর্থ নির্বাচনকালীন দায়িত্ব থাকা অবস্থায় সংশ্লিষ্ট সবার কাছেও পৌঁছবে।
ভোটার ছাড়াও টাকা ব্যয় হচ্ছে নানাভাবে। এসব অর্থ যাবে নির্বাচনের সময় দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আনসার-ভিডিপির সদস্য, পোলিং এজেন্টসহ সংশ্লিষ্ট খাতে। ইসি সূত্রমতে, জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য নির্বাচন কমিশন ৭৩২ কোটি টাকা ব্যয় করবে। ব্যয়ের মধ্যে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পেছনে ৪৫০ কোটি টাকা এবং বাকি ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় হবে পরিচালনা খাতে। এর মধ্যে আনসার সদস্যদের জন্য ১৯০ কোটি, পুলিশের জন্য ১৬৫ কোটি, সেনাবাহিনীর জন্য ৪৫ কোটি এবং র্যাব ও বিজিবির জন্য ৩০ কোটি টাকা ব্যয় হবে। নির্বাচন পরিচালনা ব্যয়ের ৩০০ কোটি টাকার মধ্যে ১৬০ কোটি টাকা যাবে সাত লাখ নির্বাচন পরিচালনা কর্মীর পেছনে। এ ছাড়া দেশের ৩০০ সংসদীয় আসনে ব্যালট পেপার ছাপাতে ৩০ কোটি, অন্যান্য মুদ্রণসামগ্রী ক্রয় ১০ কোটি, স্ট্যাম্প প্যাড বিভিন্ন ধরনের সিল ও কালি কিনতে ব্যয় হবে ৮ কোটি টাকা।
সারা দেশে প্রায় ৪০ হাজার ১৯৯টি সম্ভাব্য ভোট কেন্দ্রে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি ৪০ হাজার ১৯৯ প্রিসাইডিং অফিসার, প্রায় ৮০ হাজার সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার এবং পাঁচ থেকে ছয় লাখ পোলিং অফিসারসহ প্রায় সাত লাখ নির্বাচন পরিচালনাকারী কর্মী এবং ৫ লাখ আনসার সদস্য দেশব্যাপী নির্বাচনী কাজে সম্পৃক্ত থাকবেন। এরা সবাই আলাদা ভাতা পাবেন। প্রতিটি বুথের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার টাকা। একটি কেন্দ্রে কমপক্ষে ১২ থেকে ২০টি বুথ থাকে। কোনো কোনো কেন্দ্রে আরও বেশি থাকে। এসব টাকা ব্যয়কে কেন্দ্র করে সরগরম হয়ে উঠছে নির্বাচনী মাঠ।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন