মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

মায়ের ভালোবাসা ভোলার নয়

প্রকাশের সময় : ৮ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোঃ তোফাজ্জল বিন আমীন
‘মা’ একটি ছোট্ট শব্দ। এই শব্দের মধ্যেই লুকিয়ে আছে পৃথিবীর সব মায়া, মমতা, অকৃত্রিম ¯েœহ, আদর, নিঃস্বার্থ ভালোবাসার সব সুখের কথা। চাওয়া-পাওয়ার এই পৃথিবীতে বাবা-মায়ের ভালোবাসার সঙ্গে কোন কিছুর তুলনা চলে না। মায়ের তুলনা মা নিজেই। মায়ের মতো এমন মধুর শব্দ অভিধানে দ্বিতীয়টি আর নেই। নদীর তলদেশে তো যাওয়া যায় কিন্তু মায়ের ভালোবাসার গভীরতা পরিমাপ করা যায় না। ‘মা’ যেন সীমার মাঝে অসীম। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও মা দিবস এমন একটি সময়ে এসেছে যে সময়ে মায়েদের কান্নার শেষ নেই। মহান আরশের অধিপতির নিকট প্রার্থনা করি তিনি যেন পৃথিবীর সকল মায়ের কান্নাকে থামিয়ে দেন। হযরত আবু উমামা (রা.) হতে বর্ণিত এক হাদিসে আছে, এক ব্যক্তি রাসূল (সা.)কে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, সন্তানের উপর পিতা-মাতার কী হক আছে? তিনি বললেন তারা তোমার জান্নাত ও জাহান্নাম। (ইবনে মাজাহ) হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। আরেক হাদিসে আছে, এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)- আমার সর্বোত্তম ব্যবহারের হকদার কে? হুজুর (সা.) বললেন, তোমার মা। লোকটি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, অতঃপর কে? হুজুর (সা.) বললেন তোমার মা। লোকটি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, তারপর কে? এবারও জবাব দিলেন, তোমার মা। লোকটি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, অতঃপর কে? এবার নবী করীম (সা.) জবাব দিলেন, তোমার বাবা। (বুখারী ও মুসলিম) মহাগ্রন্থ আল কোরআনের সূরা বনী ইসরাঈলের ২৩-২৪নং আয়াতে মা-বাবা সম্পর্কে বলা হয়েছে, তোমার প্রতিপালক এ আদেশ করেছেন যে, তোমরা তাকে ভিন্ন অপর কারও ইবাদত করো না। পিতা-মাতার সঙ্গে সদাচরণ করো। যদি তাদের একজন অথবা উভয়ই তোমার নিকট উপনীত হয়; তবে তাদের কখনো ‘উহ’ শব্দ পর্যন্ত বলবে না। তাদের ধমক দেবে না বরং তাদের সঙ্গে মার্জিত কথা বলবে। আর তাদের উদ্দেশ্যে অনুগ্রহে বিনয়ের বাহু অবনমিত করবে। আর বল, (তাদের জন্য দোয়া কর) হে আমার প্রতিপালক তাদের উভয়কে অনুগ্রহ কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবে প্রতিপালন করেছে। মা-বাবা যে কত মূল্যবান তা কোরআন এবং হাদীসে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে।
মা শব্দটি ছোট হলেও এর বিশালতা আকাশের চেয়েও বড়। মা দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করে তিল তিল করে আমাদের বেড়ে উঠতে সাহায্য করেন। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই মায়ের কষ্ট বহুগুণে বেড়ে যায়। রাতের পর রাত জেগে সন্তানের দেখভাল করলেও মায়ের কোনো ক্লান্তি হয় না। সন্তানের সুখের জন্য হাসিমুখে সব কিছু বিলিয়ে দিতেও মা কার্পণ্য করেন না। সন্তানের সঙ্গে মায়ের নাড়ির যে সম্পর্ক রয়েছে তা কখনো ছিন্ন হবার নয়। পৃথিবীর আদিকাল থেকে মা তার ভালোবাসা, ¯েœহ, মায়া-মমতা বিলিয়ে দিয়ে সন্তানের জন্য যে অসামান্য, অমূল্য ও অপরিশোধ্য অবদান রেখে যাচ্ছেন, তা সর্বজনস্বীকৃত। এই পৃথিবীর হাজারো অভিধানের মধ্যে সবচেয়ে সুমধুর শব্দ হচ্ছে মা। মা বলতেই চোখের সামনে মায়ের সদা হাস্যময়ী চেহারা ভেসে ওঠে। কি শহরে কি গ্রামে কি বিদেশে সবখানেই মায়ের শাশ্বত রূপ সদাই যেন একই রকম। মাকে ঘিরেই সন্তানের শৈশব-কৈশোর আবর্তিত হয়ে থাকে। মা তারুণ্যের পথপ্রদর্শক ও প্রেরণার উৎস হিসেবে সন্তানের পাশে চাদরের মতো জড়িয়ে থাকেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। মা এই শব্দটি উচ্চারণ করার মধ্যেই অবধারিত সুখের সন্ধান পাওয়া যায়। সে কারণে একটু আঘাত পেলে মনের অজান্তে মুখ থেকে মা শব্দটি উচ্চারিত হয়ে যায়।
শিশুকাল থেকে এ পর্যন্ত মায়ের কাছে শুধু হেরেই গেলাম। কোন দিন জিততে পারিনি। এই মুহূতে মায়ের সড়ক দুর্ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। যে কোন দুর্ঘটনা কষ্টের আর তা যদি হয় প্রিয় মা জননীর তাহলে তো সহ্য করা কঠিন। প্রকৃতির কাছে আমরা সবাই অসহায়। যদিও একশ্রেণীর মানুষ ক্ষমতার দাপটে অন্ধ হয়ে যায়। ২০১৫ সালের ২৭ ডিসেম্বরের পড়ন্ত বিকেলে বাড়ি যাওয়ার পথে সিএনজি দুর্ঘটনায় মর্মান্তিকভাবে আহত হন বাবা-মা, দুই বোনসহ চার ভাগিনা। বাবার মাথা ফেটে যায়। মায়ের বাম হাতটা কাঁধের জয়েন থেকে আলাদা হয়ে। বাবা-মা দুজনকে বাজিতপুর জহিরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মায়ের অবস্থা অবনতি হলে তিন দিন পর অবচেতন অবস্থায় ইবনে সিনা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মায়ের দুইবার মাথায় অপারেশন করা হয়েছে। আল্লাহর অশেষ মেহেরবাণীতে বাবা-মা এখন সুস্থ আছেন। মায়ের হাতটা এখনও ভালো হয়ে উঠেনি।
একজন সন্তানের জীবনে মায়ের অবদান কতটুকু তা দাঁড়িপাল্লা দিয়ে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। মায়ের কাছে বড় সম্পদ হচ্ছে তার সন্তান। একজন সন্তানকে লালন পালন করতে একজন মা-ই যথেষ্ট। অনেক কষ্ট করে মা তার সন্তানকে বড় করে তোলেন। তাকে লেখাপড়া শেখানো থেকে শুরু করে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার পেছনে মায়ের ভূমিকাই অগ্রগামী। মায়ের অবদানের কথা হাজার পৃষ্ঠা লিখেও শেষ করা যাবে না। মায়ের ভালোবাসার ঋণ কোনদিনই শোধ হওয়ার নয়। শত দুঃখ-কষ্টেও মা সন্তানকে দূরে ঠেলে দেন না। ‘মা’ সবসময়ই সন্তানের জন্য আশীর্বাদ। মায়ের কাছে সন্তানের হাজারো বায়নার মূল্য থাকে। কিন্তু সন্তানের কাছে মায়ের বায়নার যেন কোন মূল্য নেই। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমার মা আমার জন্য একদিন নয় দুই দিন নয়, মাসের পর মাস রাত জেগে ছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের কি নিয়তি মায়ের জন্যে একটি রাতও আমি জাগতে পারিনি। আমার মনে হয় আমিই পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্ভাগা সন্তান। সব কষ্ট-বেদনা সইতে পারি। কিন্তু মায়ের চোখের পানি সহ্য করতে পারি না। কখনও যদি একটু রেগে উচ্চকণ্ঠে কথা বলি মা খুব কষ্ট পান। মায়ের হাসিমাখা মুখ কালো দেখলে মনটা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
বহু দিন আগে পত্রিকার পাতায় মুদ্রিত একটি ছবি দেখে দ্রুত পত্রিকার পাতা উল্টিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। কারণ একজন পুলিশের পা ধরে আছে সত্তরোর্ধ্ব একজন বৃদ্ধা মা। মনের মধ্যে আবার কৌতূহল হলো কেন বুড়ি মা পুলিশের পা ধরেছে। তারপরে পুরো ঘটনাটি পড়লাম। ঘটনাটির সারমর্ম হচ্ছে: বুড়ি মায়ের কুলাঙ্গার সন্তান তার গর্র্ভধারিণী মাকে প্রতিনিয়ত লাঠি দিয়ে পেটাতো। দিনের পর দিন সে তার মায়ের উপর নির্যাতন করতো। গ্রামের মানুষ সহ্য করতে না পেরে অবশেষে এই কুলাঙ্গারকে পুলিশের নিকট কাছে সোপর্দ করে। পুলিশ থানায় নিয়ে যখন আচ্ছামত পেটানি দিচ্ছিল তখন একজন এসে বুড়ি মাকে বলল তোমার ছেলেকে পুলিশ কি পিটানি না দিচ্ছে। এই কথা শোনার পর বুড়ি মা আর নিজেকে স্থির রাখতে পারেননি। সোজা থানায় চলে যান। সেখানে গিয়ে দেখেন সত্যিই পুলিশ তার ছেলেকে বেধড়ক পেটাচ্ছে। সন্তানের এই কষ্ট দেখে বুড়ি মা আর নিজেকে সামলাতে না পেরে পুলিশের পা ধরে বলেন, বাবা আমার সন্তানকে আর মেরো না, তাকে ছেড়ে দাও। আমি তার কষ্ট সহ্য করতে পারছি না। সে আমাকে মারধর করতো, খাবার দিত না একথা ঠিক। কিন্তু সে তো আমাকে মা বলে সম্বোধন করতো। মায়ের কোমল মন সন্তানের জন্য রাগ-অভিমান করে থাকতে পারেনি। একেই বলে মা।
একটি নির্মম সত্যি কথা হচ্ছে যে, একজন মা একসাথে দশটি সন্তানকে দেখাশোনা করতে পারেন কিন্তু কখনো কখনো দশজন সন্তান একজন মায়ের দেখাশোনা করতে পারেন না। এরকম হাজারো ঘটনা ঘটে চলেছে সমাজের সর্বস্তরে। তার মূল কারণ হচ্ছে আমাদের পারিবারিক স্ট্রাকচার ভেঙ্গে যাওয়া। সমাজের হাজারো গঞ্জনা সয়ে কোনো কোনো মা শুধু সন্তানের দিকে তাকিয়ে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যান জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। বিভক্তির এই দুনিয়ায় সবকিছুই যখন বৈষম্যের মোড়কে ঢাকা তখনো মায়ের ভালোবাসা অবিভক্ত। যে মা গর্ভধারণের কষ্ট সহ্য করলো, কষ্ট করে লালন পালন করে বড় করে তুললো, যে পিতা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্থ উপাজন করে সন্তানের খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজন মিটালো, আজকাল দেখা যায় তারা কখনও কখনও সন্তানের অসহ্যের কারণ হয়ে দাঁড়ান। তাই আজকের সভ্য সমাজে বৃদ্ধ পিতা-মাতার জন্য মা দিবসের প্রচলন শুরু হয়েছে। একদিনের মা দিবসের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে প্রকৃত মাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমরা আমাদের প্রিয় মাকে প্রতিনিয়ত শ্রদ্ধাভরে ভালোবাসতে চাই। শুধুমাত্র মা দিবসের ভালোবাসার মধ্যে যেন আমরা আবদ্ধ না হয়ে পড়ি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
৭ মে, ২০১৭, ১১:৪৯ এএম says : 2
বাড়ীতে মানুষ যতই থাকুক! মা যদি বাসায় না থাকে... বাসাটা শূন্যই থেকে যায়।
Total Reply(1)
অভিষেক ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ৮:২৬ এএম says : 4
একেবারে ঠিক কথা।
MD Shuyaib Al Hasan Asif sharker ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১০:১৬ এএম says : 0
বাড়িতে ভালবাসার মতো যতোই লোক থাকুক না কেন।মায়ের মতো ভালবাসার কোনো মানুষ নেই।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন