পাশ্চাত্যের গবেষকদের লেখা, বক্তৃতা ও দলিল-দস্তাবেজ পর্যালোচনা করলে যে চিত্রটি চোখের সামনে ভেসে উঠে তা হলো এই যে, তারা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে-খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর প্রথম পৈঠায় আরব তথা বহির্বিশ্বে ইসলামের দ্রুত প্রচার ও বিকাশের মুখ্য কারণ ছিল এই যে, তাতে আরবের অধিবাসীদের খাহেশাতে নফসানী পরিপূরণের যাবতীয় উপায়-উপকরণ মওজুদ ছিল। পূর্ব থেকেই আরবরা ছিল যুদ্ধ-বিগ্রহ, লুটতরাজ ও ঝগড়াপ্রিয় জাতি। ইসলাম এ সকল কর্মকাণ্ডকে জিহাদ এবং গণিমতের আকারে পরিবর্তন করে দিয়েছিল। আরবরা ছিল জৈবিক চাহিদা ও যৌনক্ষুধা পরিপূরণ ও নিবারণের জন্য খুবই আগ্রহী এবং পাগলপ্রায়। ইসলাম তাদেরকে চারজন স্ত্রী গ্রহণ এবং অগণিত দাসী-বাঁদি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিল। আরবদের মাঝে দুনিয়ার সাথে সম্পর্কহীনতা মূলত মনোবৃত্তি পোষণ করার অভাব ছিল না।
এরপরও ইসলাম রুহবানিয়াত বা বৈরাগ্য প্রথাকে নিকৃষ্ট বলে ঘোষণা দিয়েছে এবং সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে যে, ‘লা রুহবানিয়তা ফিল ইসলাম।’ অর্থাৎ ইসলামে বৈরাগ্য বলতে কিছুই নেই। সুতরাং এহেন অবস্থায় আরবদের সামনে জীবন-জিজ্ঞাসার কী উপাদান অবশিষ্ট ছিল, যা তাদেরকে ইসলামগ্রহণ হতে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে? ফলে, যা হওয়ার তাই হয়েছে। আরবরা এবং তাদের দোসররা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং একটি পৃথক শক্তির রূপ পরিগ্রহ করেছে।
কিন্তু তাদের এ ধারণা সর্বতোভাবে ভুল এবং নিরর্থক ও বিদ্বেষপ্রসূত। ইসলামে জিহাদ এবং স্ত্রীদের সংখ্যা নির্ণয় ও দাস-দাসীদের সঙ্গে আচার-ব্যবহার প্রসঙ্গে এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে, ইসলাম জিহাদ অথবা স্ত্রীদের সংখ্যা নির্ধারণ সংক্রান্ত যে বিধান কায়েম করেছে, তা প্রাচীন অন্ধকার যুগের বল্গাহীন জীবনযাত্রাকে পবিত্র ও নির্মল করতে সক্ষম হয়েছে। জিহাদ শুধুমাত্র আক্রান্ত হলে কাফিরদের বিরুদ্ধেই বৈধ করা হয়েছিল। অন্যথায় অকারণে রক্ত ঝরানোর অনুমতি ইসলামে নেই।
মনে করুন, একটি গোত্র ইসলামগ্রহণ করেছে। তারপর কোনো মুসলিম সেই গোত্রের প্রতি হাতিয়ার উঠাতে পারত না। এমন কি তাদের ধন-সম্পদ ও বিত্ত-বৈভবের প্রতিও হস্ত সম্প্রসারণ করতে পারত না। ইসলামের এই বিধি-বিধান তাদের নির্মল জীবন যাত্রার দিকনির্দেশনা দিয়েছে এবং পূর্ববর্তী উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাত্রার পথকে চিরতরে রুদ্ধ করেছে।
ইসলামপূর্ব যুগে আরবদের মাঝে একক ও অভিন্ন ধর্মাদর্শের কোনো প্রতিচ্ছায়া বা নমুনা বিদ্যমান ছিল না। সকল গোত্রই ছিল মূর্তিপূজার শৃঙ্খলে আবদ্ধ। তারা মূর্তিপূজার ক্ষেত্রে একরকম ভ‚মিকা পালন করলেও সব সময়মই একে অন্যর ওপর লুটপাট চালাত। নারী-শিশু নির্বিশেষে দাস বানিয়ে বিক্রি করে দিত। পক্ষান্তরে ইসলামে জিহাদ পরিচালনার জন্য যে সকল নিয়ম-নীতির প্রবর্তন করা হয়, তা পূর্বে আরবদের মাঝে মোটেই ছিল না। তা ছাড়া জিহাদে শুধুমাত্র আশেপাশে অবস্থানকারী গোত্রের লোকেরাই অংশগ্রহণ করত। সুতরাং দূরে বহুদূরে অবস্থানকারী গোত্রসমূহ এ থেকে কোনো ফায়দাই হাসিল করতে পারত না।
অনুরূপভাবে জিহাদে যে সকল দাসী বন্দী হতো, তাদেরকে নিজেদের ব্যবহারে খাটানোর পথ তখনই উন্মুক্ত হতো, যখন একমাস অতিবাহিত হয়ে যেত। অথবা গর্ভবতী মহিলারা সন্তান প্রসব করত। কিন্তু ইসলামপূর্ব যুগে বিজয় অর্জিত হওয়ার সাথে সাথে যুদ্ধ বন্দিনীদের ওপর যথেচ্ছাচার চালানো হতো এবং এই কর্মটি ছিল তাদের অহঙ্কারের বস্তু।
ইসলামপূর্ব যুগে বিয়ের জন্য স্ত্রীদের কোনো সীমা-সংখ্যা ছিল না। একসাথে আটজন অথবা ১০ জনকেও তারা বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ করত। ইসলাম তাদেরকে চার সংখ্যায় আবদ্ধ করে ফেলে এবং তাও কঠিনতম শর্তের সাথে যে, সকল স্ত্রীদের সাথে ন্যায়-নীতি ও ইনসাফ বজায় রাখতে হবে। কোনো মতেই বেইনসাফি করা যাবে না।
তাই দেখা যায় যে, আরবদের পূর্ববর্তী যাবতীয় অনিয়ম-অনাচার, অবিচার ও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড ও চিন্তা-ভাবনাকে ইসলাম সমূলে উৎপাঠন করতে সক্ষম হয়েছিল বলেই তা আরব ও আজমে গ্রহণীয় ও বরণীয় হয়ে উঠেছিল। সুতরাং এ কথা জোর গলায় বলা যায়, ইউরোপের গবেষকদের এতদসংক্রান্ত ধারণা সম্পূর্ণই ভুল এবং পরিত্যাজ্য।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন