সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

নির্বাচন নিয়ে আরো কিছু কথা

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ২৬ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:১১ এএম

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের (২০১৮) গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নচিহ্নটা দিন দিন বড় হচ্ছে। বুদ্দিজীবী মহল, বিভিন্ন সংগঠন ও রাষ্ট্রের সিরিজ আকারে নির্বাচনী সুষ্ঠুতা নিয়ে অভিন্দনের পর অভিনন্দন থেকে প্রথমে বুঝার উপায় ছিল না যে, নির্বাচনী পরিবেশের সুষ্ঠুতা ও নিরপেক্ষতা ও অভিনন্দন বার্তার সাথে বাস্তবতার সামঞ্জস্য কোথায়? বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্টের অনেক ব্যর্থতা থাকতে পারে কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, জাতি তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হতেই থাকবে। নির্বাচনের দিন সকল বেলা ঠাকুরগাঁয়ে নিজ এলাকায় নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া সম্পর্কে বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্য ও জামায়াতের নির্বাচনে অংশগ্রহণ সম্পর্কে ড. কামাল হোসেনের অজ্ঞতার সংবাদ ভারতীয় পত্রিকায় প্রকাশ সরকারের কোর্টে একটি যুক্তি দাঁড় করানোর উপাদান তুলে দিলেও নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে সরকারের উচ্চ মহল সত্যের যে অপলাপ করছে তার মূল্য জাতিকে কতটুকু দিতে হবে, জানি না, তবে কালের বির্বতনে কাউকে না কাউকে জবাব অবশ্যই দিতে হবে। যুদ্ধাপরাধ যেমন অপরাধ, রাষ্ট্রীয় খরচে সত্যের অপলাপ করাও একটি অপরাধ। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস এবং শপথ ভঙ্গকারীদের একদিন না একদিন জাতির মুখোমুখি হয়তো দাঁড়াতে হতে পারে, যার নজির পৃথিবীর সর্বত্র রয়েছে। রাজনীতি একটি কৌশল। এ কৌশলে বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্টের সফল না হওয়ার অর্থ এই নয় যে, যারা অনৈতিক সূত্র ব্যবহার করে জনগণের ভোটাধিকারের পরিবেশ নষ্ট করলো তাদের কোনো দিন জবাবদিহি করতে হবে না। জবাবদিহিতার হাত অনেক লম্বা। এর আওতায় অনেককেই আসতে হয়েছে, কিন্তু বিষয়টি সময়, কাল, ক্ষেত্র বিশেষে ভিন্নতর হয়ে এসেছে। উৎসবমুখর ও নির্বাচনের সুষ্ঠুতার জয়গান যতই হতে থাকুক না কেন পাশাপাশি কিছু সংগঠন (রাজনৈতিক/অরাজনৈতিক) নির্বাচনিক পরিস্থিতি ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অবস্থান জাতির নিকট তুলে ধরছে। জাতি আজ নির্মমভাবে অসহায়, দাঁড়ানোর কোনো জায়গা নাই, তবে ধ্বংসস্তূপ থেকেই অনেক আশাবাদের সৃষ্টি হয়, ভোটাধিকারের প্রশ্নে জাতিকে সে দিকেই তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে, তবে সে সময় কতদিন দীর্ঘ হবে তা অনুমান করা যাচ্ছে না। 

জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনের এক গণশুনানি অনুষ্ঠানে বাম গণতান্ত্রিক জোট বলেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন একটি কলঙ্কিত নির্বাচন। এমন নির্বাচন দেশের ইতিহাসে আর হয়নি। নজিরবিহীন ভুয়া ভোটের এই নির্বাচনের আগের দিনই বিভিন্ন কেন্দ্রে প্রশাসনের সহায়তায় ভোট ডাকাতি করে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা হয়েছে। প্রশাসন এসব অনিয়ম ঠেকাতে সক্রিয় ছিল না। গত ১১ জানুয়ারি বাম গণতান্ত্রিক জোটের ওই গণশুনানিতে ভোট ডাকাতি, জবর দখল ও অনিয়মের নানা চিত্র তুলে ধরেন বাম দলগুলোর প্রার্থীরা। ১৩১টি আসনে বাম গণতান্ত্রিক জোটের ১৪৭ জন প্রার্থী অংশ নেন। দিনব্যাপী এই গণশুনানিতে বাম দলের ৮০ জন প্রার্থী তাদের নির্বাচনী এলাকায় ভোটের সময়কার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। সংসদ নির্বাচনে অনিয়মের নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ করেন প্রার্থীরা। তাদের অভিযোগ, ভোট হয়েছে ২৯ ডিসেম্বর রাতেই। তারা জানান, ভোটের আগের দিন ভোটের ও পরের দিন অনেক অনিয়ম হয়েছে। এর পক্ষে সুনির্দিষ্ট ঘটনার উদাহরণও দেন তারা। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি ঢাকা-১২ আসন থেকে কোদাল মার্কায় দাঁড়ান। গণশুনানিতে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের আগের দিন রাতেই কেন্দ্রভেদে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ ভোট সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরে ফেলা হয়েছে। আমরা যারা প্রার্থী ভোট দিতে গিয়েছিলাম, দেখেছি, একটা ভোটকেন্দ্রে ভোটারের তেমন কোন ভিড় নেই’।
অনুরূপ কথা ডানপন্থী দল যারা সরকারের লেজুড়বৃত্তি করে নাই তারাও বলে যাচ্ছে, যেমন খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক ১১ জানুয়ারি বলেছেন, গত ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের নামে জাতির সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। নির্বাচনে বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের স্বাধীনভাবে প্রচার-প্রচারণার ন্যূনতম সুযোগ দেয়া হয়নি। উপরন্তু সরকারি দল ও পুলিশ প্রশাসনের হামলা, মামলা, গ্রেফতার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বহু সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকেরা। তিনি বলেন, ভোটের দিন অধিকাংশ ভোটকেন্দ্রে বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের এজেন্টদের কেন্দ্রে বসতে দেয়া হয়নি। যেসব কেন্দ্রে কিছু কিছু এজেন্ট গিয়েছিল সময়ের ব্যবধানে তাদেরও জোর করে কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়ে মহাজোটের নৌকা ও লাঙ্গল মার্কায় সিল মারা হয়। খেলাফত মজলিস মনোনীত সংসদ সদস্য প্রার্থীদের নিয়ে আয়োজিত নির্বাচন-উত্তর মতবিনিময় সভায় সভাপতির বক্তৃতায় তিনি এ কথা বলেন।
এ বারের নির্বাচন হয়েছে পুলিশ নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন এবং এ জন্য জনগণের পক্ষ থেকে না হলেও সরকারের পক্ষ থেকে সর্বাগ্রে পুলিশকেই মোবারকবাদ, ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা জানানো বাঞ্চনীয় এবং সরকার তাই করেছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশ যে, একাদশ সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সম্পন্ন করার পুরস্কার হিসেবে পুলিশ কর্মকর্তাদের পদক দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ পদক দেয়া হচ্ছে পুলিশের রেঞ্জ ডিআইজি, পুলিশ কমিশনার ও জেলা পুলিশ সুপারদের। এ ব্যাপারে একটি প্রস্তাব যাচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সরকার প্রস্তাব অনুমোদন করলে পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের হাতে এ পদক তুলে দেয়া হবে বলে জানা গেছে। সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় দেশের সব জেলার পুলিশ সুপারকে ইতোমধ্যে প্রশংসাপত্র দিয়েছে পুলিশ সদর দফতর।
কোনো কোনো বিষয় কারো জন্য উৎসব, আবার কারো জন্য হৃদয়বিদারক। ইঁদুর যখন টিকটিকি’কে আক্রমণ করে তখন ইঁদুরের জন্য উৎসব হতে পারে, কিন্তু বিড়াল যখন ইঁদুরকে আক্রমণ করে তখন উৎসবটি হয়ে যায় ইঁদুরের পরিবর্তে বিড়ালের জন্য। উৎসব শব্দটি আপেক্ষিক। যেমন বাংলা প্রবদ রয়েছে যে, কোনো বিষয় ‘কারো জন্য সর্বনাশ এবং কারো জন্য ভাদ্রমাস’ ফলে উৎসবটি ১৭ কোটি মানুষের, না একটি গোষ্ঠির তা অবশ্যই ইতিহাসের পাতা থেকে বাদ যাবে না।
পত্রিকান্তরে প্রকাশ দেশের প্রতিটি থানায় পুলিশের প্রীতিভোজ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে ছিল খাওয়া-দাওয়া এবং গান-বাজনার ব্যবস্থা। পুলিশ সদর দফতরের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে প্রতিটি থানায় নির্দেশনা জারি করা হয়। প্রতিটি থানায় পুলিশ সদর দফতর থেকে বরাদ্দ পাঠানো হয়েছে। মাঠপর্যায়ের একাধিক সদস্য বলেন, পুলিশ সদর দফতরের এই আয়োজনে তারাও খুশি। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ইতোপূর্বে কোনো জাতীয় নির্বাচনের পর পুলিশকে প্রীতিভোজ দেয়ার কোনো প্রকার নিয়ম-নীতি বা অনুষ্ঠান লক্ষ করা যায় নাই। এ সম্পর্কে জনগণ মনে করে, ভোটারবিহীন একটি তথাকথিত শান্তিপূর্ণ অর্থাৎ কোনো প্রতিবাদবিহীন নির্বাচন করার জন্য সরকার পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা স্বরূপই এই প্রীতিভোজের উপঢৌকন। পুলিশ কর্তৃক দায়েরকৃত গায়েবি মামলা, ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা জজ’দের ভ‚মিকা ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচন করতে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। তবে কথিত শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য পুলিশের মতো ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা জজ’দের আনুষ্ঠানিক পুরস্কার এখনো কেন ঘোষণা করা হচ্ছে না, সেটাই বুঝতে পারছি না। এ নির্বাচনে জজ-ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবদের ভ‚মিকার কমতি ছিল না। গায়েবি মামলা মিথ্যা জেনেও তারা বিএনপি সমর্থকদের জামিন না দিয়ে বিএনপি’র নেতাকর্মীদের ঘরে ঘরে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছেন, ফলে দেশের বিভিন্ন জেলা, থানা থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষকে হাইকোর্টের বারান্দায় আগাম জামিনের শুনানির জন্য ঘুরপাক খেতে হচ্ছে। দেশব্যাপী গায়েবি মামলাগুলিতে যত মৃত ব্যক্তির নাম এসেছে, এ ধরনের বিরল দৃষ্টান্ত পৃথিবীর আর কোথায় পাওয়া যাবে?
লেখক: কলামিস্ট ও আইনজীবী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
No name ২৬ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:১০ এএম says : 0
Vote chor
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন