মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১, ০৫ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সারা বাংলার খবর

মাটিখেকোরা বেপরোয়া

মুন্সী কামাল আতাতুর্ক মিসেল, কুমিল্লা থেকে | প্রকাশের সময় : ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০২ এএম

মাটি খেকোরা বেপরোয়া। কুমিল্লার খরস্রোতা খ্যাত গোমতী নদী থেকে অবাধে মাটি চুরি হচ্ছে। নদীর ভেতর থেকে অবৈধভাবে মাটি-বালি তুলে নেয়ার কারণে হুমকির মুখে পড়েছে বাঁধ, সড়ক ও সেতু। নদীর বুকে ভেকু বসিয়ে প্রভাবশালীরা অবাধে কেটে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকার মাটি। প্রতিদিন শত শত ট্রাক মাটি বিক্রি করে তারা বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অবৈধভাবে মাটি উত্তোলনকারীরা স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা। এই চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে নদীতে ভেকু দিয়ে মাটি উত্তোলন করে আসছে। ক্রমাগত মাটি কাটার ফলে গ্রামীণ রাস্তাঘাট, বাজার, মসজিদ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হুমকির মুখে পড়েছে। জেলা প্রশাসন কিংবা পানি উন্নয়ন বোর্ড এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে এলাকাবাসী অভিযোগ করলেও এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ বলছেন, লোকবলের অভাবে তদারকি করা যাচ্ছে না। কালিকাপুর গ্রামের খলিলুর রহমান অভিযোগ করে দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, একটি চক্র ক্ষমতার দাপট এবং লোকজনদের ভয়ভীতি দেখিয়ে দিনে-রাতে মাটি চুরি করে নিচ্ছে। মাটি কাটা বন্ধের জন্য তাদের অনুরোধ করা হলে উল্টো তাদের মিথ্যা মামলায় জড়ানো হবে বলে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো হয়। এ ছাড়া প্রভাবশালীদের সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে প্রাণনাশের হুমকিও দেয়া হয় বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, নদী থেকে অবৈধভাবে মাটি কেটে নেয়ার ফলে গোমতীর বাঁধ ও সেতু ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। অনেক জায়গায় বাঁধের পাকা সড়কের পিচ উঠে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্ত। খলিলপুর, চরবাকর, লক্ষ্মীপুর, কালিকাপুরসহ ১০/১২টি ঘাট থেকে প্রায় ৩ শতাধিক ট্রাক্টর মাটি কেটে নিচ্ছে। সড়ক কেটে নদীর বাঁধের ভেতর দিয়ে এসব ট্রাক্টর ওঠানামা করছে। নিয়মিত এই মাটি কেটে নেয়ায় কারণে হুমকির মুখে পড়েছে কালিকাপুর, লক্ষ্মীপুর, খলিলপুর ও দেবিদ্বারের চারটি সেতু। মাটি বোঝাই ট্রাক্টর সেতুর ওপর দিয়ে চলাচল করলে প্রচন্ড বেগে কম্পনের সৃষ্টি হয়। এতে ধীরে ধীরে সেতুর পিলার থেকে মাটি সরে গিয়ে যেকোন সময় দেখা দিতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। লক্ষ্মীপুর, চরবাকর এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে প্রভাবশালীরা নদীর বুকে ভেকু দিয়ে শত শত ট্রাক দিয়ে মাটি নিয়ে যাচ্ছে। একই অবস্থা দেখা গেল খলিলপুর ও কালিকাপুর এলাকায়। ট্রাক্টর ও ভেকু মেশিনের চলাচলের কারণে রাস্তাঘাট ও ছোট ছোট সেতুগুলোর অবস্থা বিকল হয়ে পড়ছে। আবার নিয়মিত মাটি কাটার ফলে সৌন্দর্য হারাচ্ছে গোমতী নদী। প্রতিবছর শীত আসার পরপরই দুই পাশের বাঁধ কেটে বিকট শব্দে ওঠানামা করছে শত শত ট্রাক্টর।
রাতদিন মাটিবাহী ট্রাক্টরের দাপটে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে নদীর দুই পাড়ের বাসিন্দারা। ধুলাবালির কারণে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে নদীর আশপাশে বসবাস করা শত শত পরিবার। ধুলায় বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কুমিল্লা জেলার সভাপতি মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, গোমতী কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী নদী। খরস্রোতা এ নদীটি এখন বিপন্ন প্রায়। ক্ষমতার অপব্যবহার করে একটি চক্র এ নদীর গতিপথসহ সবকিছু ধ্বংস করে দিচ্ছে। প্রশাসনের কাছে দাবি জানিয়েও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি। অভিযোগ রয়েছে প্রভাবশালী চক্রটি পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমি অফিসের এক শ্রেণির দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে যোগসাজস করে দীর্ঘদিন ধরে মাটি চুরির জমজমাট ব্যবসা চালিয়ে আসছে।
তবে ভূমি অফিসের কর্তারা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ভূমি অফিসের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী মাটি চোরদের সঙ্গে জড়িত নয় বলে জানান। তবে এ ব্যাপারে কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিকল্পনা ও রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল লতিফ বলেন, ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই মাটি কাটার ধুম পড়ে। মাটি আনা-নেয়ার কাজে ব্যবহৃত ট্রাক্টরগুলোতে কোনো নম্বর থাকে না। সংঘবদ্ধ চক্র মাটি কাটার জন্য নম্বরবিহীন এসব অবৈধ ট্রাক্টর ব্যবহার করে। এ কারণে তাদের বিরূদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। আমরা এ বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানিয়েছি। লোকবলের অভাবে এসব তদারকি করা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য রাজী মোহাম্মদ ফখরুল এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, একটি কুচক্রী মহল মাটি কাটছে। খুব শিঘ্রই এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া হবে। এদিকে কুমিল্লায় গোমতী নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের ওপর দিয়ে অবাধে মাটি পরিবহনকৃত ট্রাক্টর চলাচলের কারণে এর ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। বাঁধের যেসব অংশ এর আগে পাকা করা হয়েছিল সে সব অংশের পিচ নষ্ট হয়ে গেছে। সকাল-সন্ধ্যা মাটি পরিবহনকৃত ট্রাক্টরের ধূলায় গোমতী তীরের বাসিন্দাদের জন্য পরিবেশ বিপর্যয়ও দেখা দিয়েছে।
ট্রাক্টর চলাচল প্রসঙ্গে পাউবোর সাফ কথা, পুলিশ নিয়ে অভিযানে গেলে রহস্যজনক কারণে একটি ট্রাক্টরও খুঁজে পাওয়া যায় না। তাছাড়া মাঠ পর্যায়ে পাউবোর ৫/৬ জন জনবল দিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালী ট্রাক্টর মালিকদের সঙ্গে লড়াই করতে গেলে উল্টো মার খেয়ে আসতে হয়। এ নিয়ে পুলিশ ও পাউবোর মধ্যে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া গেছে।
জানা যায়, প্রায় গোমতী নদীর উভয় তীরে গোমতী ও পাউবো বিভাগের অধীন প্রায় ১৪১ কিমি. বাঁধ রয়েছে। বর্তমানে কুমিলা আদর্শ সদর, বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া, দেবিদ্বার এবং মুরাদনগর উপজেলার গোমতী চর থেকে মাটি কেটে তা ট্রাক্টরে করে গোমতী বাঁধের ওপর দিয়ে বহন করা হচ্ছে। গোমতী বাঁধের সংরক্ষিত এলাকা থেকে অবৈধভাবে মাটি কাটার ফলে বর্ষা মৌসুমে অধিকাংশ স্থান দিয়ে বাঁধ ভাঙার আশঙ্কা রয়েছে।
কুমিল্লা পাউবোর গোমতী বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, চলতি বছর বাঁধের ১৪১ কিমি. এলাকায় কাউকে ট্রাক্টর দিয়ে মাটি পরিবহনের অনুমতি দেয়া হয়নি, এখন যে ট্রাক্টরগুলো চলছে সবই অবৈধ, সময়মতো পুলিশ চেয়েও পাওয়া যায় না, তাই সামান্য জনবল নিয়ে ট্রাক্টর শ্রমিকদের আটক করতে গিয়ে উল্টো মার খেয়ে আসতে হয়। তবে কুমিল্লা পুলিশের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা জানান, বাঁধ তদারকি করে থাকে পাউবো, তাই ট্রাক্টর আটক করতে তারা যখনই পুলিশ চায় তখনই পুলিশ সহায়তা করে থাকে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন