বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মহান একুশে সংখ্যা

একুশের দিন রাত্রি

ফ রি দা হো সে ন | প্রকাশের সময় : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

মফস্বল শহর নারায়ণগঞ্জের অভিজাতপাড়া চাষাঢ়া।
স্টেশন থেকে মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথ। বড় রাস্তার ধার ঘেঁষে চাষাঢ়ায় ঢুকতেই পাশে মস্ত পুকুর।
চারদিকে বড় বড় গাছ।
আম-জাম, কদম-চালতা।
নারিকেল গাছও রয়েছে কয়েকটা।
একপাশে আছে মস্ত বাঁধানো ঘাট।
পাড়ার দস্যি ছেলেদের অশ্রান্ত হুটোপুটিতে প্রতিদিন তোলপাড় হয়ে ওঠে পুকুরটা।
বড়রাও কম যায় না।

দিনের বেলা বাদ দিয়েও চাঁদের আলোয়ও আসর বসে ঘাটে।
একেবারেই নিরাপদ আর নির্ঝঞ্ঝাট একটা জায়গা যেন।
এই পুকুরের একটা ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে সব অভিজাত পরিবারের বাড়িগুলো।
বেশির ভাগই দোতলা।
পুকুরের পাড়েই বড় একটা মাঠ। একপাশ দিয়ে চলে গেছে সরু একটা রাস্তা। মিশেছে একেবারে পাড়ার শেষ মাথায়।
সেখানেও রয়েছে বিশাল এক মাঠ।
বিভিন্ন সময়-সাজ সাজ রব পড়ে যায় পাড়াময়।
ঈদ, মহররম ও পূজার সময়।

দেশ বিভাগের পর তখনো হিন্দু মুসলমানের মোটামুটি প্রায় সমঅবস্থান চাষাঢ়ায়।
হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার আছে একেবারেই খানদানী।
পাড়ার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নেতৃত্বও দিচ্ছে এসব পরিবারের তরুণরা। এদের কেউ কেউ ঢাকার বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে।
দুর্গা পূজার সময় বিশাল আয়োজন হয় পুকুরপাড়ের মাঠটায়। পূজা মন্ডপ ঘিরে উৎসবের আমেজে মেতে থাকে পাড়ার হিন্দু-মুসলমান সব ছেলেমেয়েরা।

এ পাড়ারই পুকুর পাড়ের কোনের বড় বাড়িটিতে বেড়ে উঠতে লাগল ছোট, ফুটফুটে একটি মেয়ে। কবি-কবিতা যার নাম। দুধে আলতা গায়ের রঙ, গভীর দুটো চোখ। আর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব যেন ঐ বালিকা বয়সেই।
বিকেলের বৈকালি রোদে পাড়ার ছেলে-মেয়েরা যখন মাঠে হুটোপুটি করত অথবা আম-জামগাছের মগডাল থেকে পুকুরে ঝাঁপ দিত, তখন ওদের দুরুন্তপনায় মুখরিত হয়ে যেত চারদিক। কবিতা নামের মেয়েটি তখন রাস্তার ধারের জানালায় দাঁড়িয়ে, লালচে মেঘের আড়ালে সূর্য ডোবা দেখত।

পাখিগুলো ডাকতে ডাকতে ফিরছে নীড়ে। সবুজ নারিকেল গাছের দীর্ঘ বাহুগুলো কেমন অস্পষ্ট ছায়াময়।
কবিতার দীর্ঘ পল্লব ঘেরা দু’টি চোখ যেন বিস্মিত।
বিস্মিত হতো রাতের জোছনা প্লাবিত আকাশে পূর্ণ চাঁদের একাকীত্ব দেখে।
ভাবত কেউ নেই ওর? বাবা, মা অথবা দিদা?
মা বলতেন-
আলসে মেয়ে।
ঘরকুনো মেয়ে।
কি হবে ওকে দিয়ে।
আর দশটা ছেলে-মেয়ের মতো যেন নয়।
একেবারেই অস্বাভাবিক।
কিন্তু কেউ জানে না কবিতা তখন প্রকৃতির সমুদ্রে ডুব দিয়ে মুক্তো তুলছে।
অসংখ্য ঝকঝকে মুক্তো।
তাল তাল মুক্তো।
সমুদ্রের তলায় রঙিন মাছগুলো যেন সেই মুক্তোর পাহাড়ে লুকোচুরি খেলছে।
আর বালিকা কবিতা আকণ্ঠ পান করছে সেই নৈসর্গিক সৌন্দর্য।
উঠোনের আমগাছে দোলনা বাঁধা ছিল একটা।
দুপুরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে একা একা সেই দোলনায় চড়ত কবিতা। কখনো কখনো ওর হাতে থাকত ঠাকুর মার ঝুলি।
পড়তে পড়তে সেই পঙ্খীরাজ ঘোড়ার খোঁজে দৃষ্টি চলে যেত মেঘময় আকাশে।
কখনো কখনো ধ্যান ভাঙত মা অথবা আর কারো ডাকে।
কিছুদিন ধরে শহরের আবহাওয়া কেমন যেন অন্যরকম।
মহল্লায় মহল্লায় সভা মিছিল....। খন্ড খন্ড জটলা।
বড়দের চোখে মুখে উৎকণ্ঠা আর দুশ্চিন্তার ছাপ।
বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে মাতাল তখন সারা পূর্ব পাকিস্তান।
কবিতার দুই মামা হারুন ও মামুন ছাত্র রাজনীতি করে।
আন্দোলনের প্রথম সারির ছাত্রনেতা ওরা।
বাড়িতে নানা রকম আলোচনা শোনে কবিতা।
অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বাবার সাথে কথা বলেন মামারা।
ছোট্ট কবিতা যাওয়া আসার পথে শোনে অনেক কিছু। আর এইটুকুন বুঝতে পারে কিছু একটা ঘটছে কোথাও। যার জন্য সবাই চিন্তিত।
একদিন সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে চাতালে আঁক কষে এক্কা দোক্কা খেলছিল কবিতা।
পুকুরপাড়ের মাঠটায় কি যেন নিয়ে জটলা করছিল পাড়ার ছেলে-মেয়েরা।
এমনি সময় কিছু স্লোগান এবং একটু পরেই শোনা গেল গুলির আওয়াজ। একবার, দুবার, তিনবার।
ঝটপট ডানা ঝাপটে উড়ে গেল কয়েকটা কাক। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে এদিক সেদিক সরে গেল সবাই।
একটু পরেই আবার উন্মত্ত স্লোগান এবং গুলির গুড়–ম গুড়–ম গুড়–ম।
তারপরই আর্তচিৎকার এবং আবার নীরবতা চারদিকে।
ছুটে এসে ঘরে ঢুকল কবিতা।
বলল-
: এ কিসের শব্দ মা।
: ‘গুলির’। জানালার ধার থেকে সরে যা, বলে মা জানালাটাও বন্ধ করে দিলেন।
বন্ধ করে দিলেই কি সব কিছু ঠিক হয়ে যায়?
চারদিকে তখন ভাষা আন্দোলনের উত্তাল ঝড়।
ভেঙে গেল কদমতলায় শিশুদের খেলাঘর।
খালি পড়ে থাকল কিশোরদের খেলার মাঠ।
বন্ধ হয়ে গেল বড় জামগাছটার ওপর থেকে দস্যি ছেলেদের ঝুপঝাপ পুকুরে লাফিয়ে পড়া। বরং পুকুরের পানিতে লাশ পড়ল দুটো ঝুপঝাপ, বন্দুকের গুলির শব্দের সাথে সাথে।
আন্দোলনকারীদের কেউ একজন পালাতে চেষ্টা করছিল পুকুরপাড় দিয়ে। দু-একটা কুকুর ডেকে চুপ হয়ে গেল। আবার নিশ্চিদ্র নীরবতা চারদিকে।
বাড়ির ছেলে দুটো হারুন আর মামুন এখনো বাড়ি ফেরেনি। থম থম করছে চারদিক।
মা, ঠায় বসে আছেন খাটের এক কোনায়।
অস্থির পায়চারী করছেন বাবা, উৎকণ্ঠার যেন শেষ নেই।
এমনি সময় পেছনের দরজায় কষাঘাত হলো।
চমকে উঠল সবাই।
একটু চুপ থেকে মা বললেন-
: কে-
ওধার থেকে একটু চাপা গলায় শোনা গেল-
: আমি হারুন। আপা দরজা খোল।
দরজা খুললেন মা।
অস্থির হয়ে বললেন-মামুন কোথায়?
কোথায় রেখে এলি ওকে?
পাশের ঘরে চলে গেল কবিতা।
মায়ের অবস্থা দেখে হারুন এক সময় বলল-
: তোমরা অত চিন্তা করো নাতো। আমি কাল সকালে এক ফাঁকে বেরিয়ে...।
হারুনের মুখের কথা শেষ না হতেই মা বললেন-
: আর কাজ নেই বেরিয়ে। তোর দুলাভাই-ই যাবে। উনিতো আর পলিটিক্স করেন না। ওনার কিছু হবে না। হারুন সোজা হয়ে বসল অনেক কষ্টে। বলল-
: মামুনকে ওরা কোথায় রেখেছে আমি জানি। দুলাভাই ওসব বুঝবে না।
একসময় কবিতা এসে দাঁড়াল ধীর পায়ে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বসল পাশে। হারুনের হাতটা ধরল। ওর দিকে তাকিয়ে একটু হাসল হারুন। জিজ্ঞেস করল-
: ভয় পেয়েছিস?
ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল কবিতা।
হারুন আদর করে ওর পিঠে হাত বুলালো। বলল-
: কাঁদছিস কেন রে বোকা মেয়ে। আমার তো কিছুই হয়নি। এই দ্যাখ আমি একদম ভালো আছি। সত্যি বলছি। হঠাৎ কবিতার হাতের দিকে চোখ পড়ল হারুনের। হাতে একটা খাতা। হারুন জিজ্ঞেস করল-
: স্কুলের পড়া তৈরি করছিলি?
অশ্রুসজল চোখে মাথা নাড়ল কবিতা।
: না।
তাহলে? দেখি।
কবিতার হাত থেকে খাতাটা নিয়ে চোখ বুলালো হারুন এবং বিস্ময়ে তাকালো ওর দিকে। জিজ্ঞেস করল-
: তুই লিখেছিস?
: হ্যাঁ
বিস্মিত আবেগে সোজা হয়ে বসে ছোট্ট কবিতাকে কাছে টানল হারুন। এ তুই কি করেছিস কবি? কি লিখেছিস তুই-
মায়ের কোলে জন্ম নিয়ে
মাকে ডাকতে বড় ভয়
মায়ের বুকে দু’চোখ বুজে
ঘুমুতে যে ইচ্ছে হয়
মুহূর্তের মধ্যে যেন শরীরের যন্ত্রণার কথা ভুলে গেল হারুন। কবিতার লেখা ঐ দু’টি লাইনের সামনে। দু’হাতে আদর করতে লাগল ছোট্ট কবিতাকে। কম্পিত কণ্ঠে বলল-
আমি জানি-নিশ্চিত করে বলতে পারি এই যুদ্ধে আমরা জয়ী হবই। আমরা মাকে...মা...বলে ডাকবই....। আর এই ভাষা আন্দোলনের জয়ের পতাকা থাকবে তোর হাতে।
আর একদিন তুই হবি ভাষাসৈনিক কবিতা চৌধুরী।
এর কয়েক দিন পরে অত্যন্ত গোপনে এবং সাবধানে মামুনের খোঁজ নিতে বেরুলেন হারুন মামা ও বাবা। প্রায় সারা দিন লেগে গেল চার দিকে খোঁজ নিতে।
যখন ফিরলেন তখন সন্ধ্যা সমাগত। মায়ের গা ঘেঁষে বসেছিল কবিতা। দরজায় আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠল মা। হারুনের গলার আওয়াজও পেল। দরজা খুলতেই বাবা ও হারুন ঘরে ঢুকল।
কবিতা অস্থির চোখে চার দিকে তাকালো। তারপর দৌড়ে এলো বাবার কাছে।
বলল-
: বাবা ছোট মামা?
নিজেকে সামলে নিয়ে কবিকে কাছে টেনে নিলেন বললেন-
আয় আয়, আমার কাছে আয়।
বলছি-
দরজার ওপাশে মার সাথে কথা বলছে হারুন
এক সময় বলল-
থানা থেকে মামুনকে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। পেটে গুলি লেগেছিল ওর......। কিন্তু শেষ পর্যন্ত.....।
নিজের মুখে হাত চাপা দিয়ে ডুকরে উঠল হারুন।
কথা শেষ করতে পারল না।
মা কাঁদতে লাগল আর্তনাদ করে এবং ওখানেই বসে পড়ল দেওয়ালে ভর দিয়ে।
একটু স্বাভাবিক হয়ে বোনের দু’টি হাত নিজের হাতে নিলো হারুন।
বলল-
: কেঁদো না আপা। আমাদের পরিবারের একজন সদস্য শহীদ হয়েছে এই ভাষা আন্দোলনের যুদ্ধে। এ কি কম বড় কথা?
তারপর কম্পিত কণ্ঠে আবার বলতে লাগল-
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো
একুশে ফেব্রুয়ারি।
আমি কি ভুলিতে পারি........? আমি কি ভুলিতে পারি।
এরই মধ্যে কখন কাছে এসেছে কবিতা.......? কখন ওর শিশু চোখ দু’টি ভিজে উঠেছে অশ্রুতে। কেউ টের পাইনি।

এরপর অনেক দিন কেটে গেল। সফল আন্দোলনের পর চার দিক এখন শান্ত।
বাংলা ভাষা অবশেষে স্বীকৃতি পেয়েছে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে।
কিন্তু ভোলা হয়নি সেই দু’টি অবিস্মরণীয় লাইন।
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
যাদের আপনজনরা গেছে, তারা জানে কি ভীষণ রকমের কষ্ট এই ভুলতে না পারাটা।
কি গভীর দগদগে ক্ষত অবস্থান করছে বুকের মাঝখানটায়-।
মামুনের শূন্য বিছানার দিকে তাকাতে পারে না হারুন। ওদিকে তাকালে বুকটা যেন ফেটে যায়। এতটা বছর একসাথে বড় হলো। লেখাপড়া শিখল।
স্কুল কলেজ ভার্সিটি এমনকি রাজনীতিতেও নেতৃত্ব দিয়েছে হারুন। আর আজ সেই বড় ভাই হারুনকে পেছনে ফেলে রেখে শহীদ হয়ে গেল মামুন। হারিয়ে দিলো হারুনকে.......? কি বেদনাময়.......।
পাশের দরজা দিয়ে তাকালো হারুন, দেখল মেঝেতে বসে কোলের ওপর খাতা রেখে লিখেছে কবিতা। ঐটুকুন তো মেয়ে!
ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাস ওর হাতে কলম তুলে দিয়েছে।
মায়ের কোলে জন্ম নিয়ে
মাকে ডাকতে বড় ভয়
মায়ের বুকে দু’চোখ বুজে
ঘুমুতে যে ইচ্ছে হয়

কি অবিশ্বাস্য.......। কি অসাধারণ?
শক্তিশালী লেখনী কবিতার.......!
আর কেউ না জানুক ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক হারুন জানে-
বুঝতে পারে-
কবিতার ঐ শিশু হাতের লেখনী একদিন শক্তিশালী তরবারিতে পরিণত হবে।
ও যেন আর দশটা ছেলেমেয়ের চাইতে একদম আলাদা......।
একেবারে অন্যরকম।
এরপর সময় এগিয়ে গেছে তার স্বাভাবিক গতি এবং নিয়মে।
অনেক উত্থান পতন আর নানাবিধ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে পাল্টে গিয়েছে সমাজ ও মানুষের চেহারা।
নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া ছেড়ে ঢাকায় এসেছে কবিতারা। বাবার কর্মক্ষেত্রে। শৈশব থেকে কৈশোর।
শান্ত কবিতার কলম তখন গুলিবিদ্ধ হরিণের মতো অস্থির চঞ্চল।
দেশের প্রায় সবগুলো পত্রিকায় শিশু বিভাগে ছাপা হচ্ছে ওর লেখা।
ওর খোঁজ খবর নিচ্ছে সম্পাদকরা। কি শক্তিশালী কলম মেয়েটির।
ভাষা আন্দোলনে জয়ী হয়ে কি এতটা সাহসী হয়েছে কবিতা?
বাবা একদিন ডেকে বললেন,
: তোমার স্কুলের রেজাল্ট মোটেই ভালো নয়। লেখালেখি হচ্ছে সেকেন্ডারি ব্যাপার।
মাও বললেন একই কথা। ভালো রেজাল্ট করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হও। গল্প কবিতা লেখা হচ্ছে অবসরে কাজ।
কিন্তু কবিতা বুঝে নিয়েছে এটাই তার জীবনের অন্যতম প্রধান কাজ।
কলেজ তারপর বিশ্ববিদ্যালয়। লেখাপড়ার পাশাপাশি সাহিত্য জগতে দারুণ জনপ্রিয়তা কবিতার।
কর্মক্ষেত্র থেকে মাঝে মাঝে হারুন মামা আসে ঢাকায়। ওদের বাড়িতে। কবিতা একদিন একটা বড় পান্ডুলিপি তুলে দিলো হারুনের হাতে।
বিস্মিত হারুন।
বলল
: কি এটা!
কবিতার কণ্ঠ আর দৃষ্টিতে অন্যরকম এক আবেগ।
বলল
‘ভাষা আন্দোলনের গল্প’
তারপর একটু দম নিয়ে বলল
: এটা ছাপিয়ে দিতে পারবে মামা?
বিস্ময়ে হতবাক হারুন
এক সময় প্রশ্ন করল
ভাষা আন্দোলনের গল্প........ বলিস কি ?
কবিতা একটা দীর্ঘশ্বাস চাপতে চাপতে বলল।
হ্যাঁ মামা। খুব শৈশবে ’৫২ সাল থেকে যা দেখেছি শুনেছি আর জেনেছি সব আছে এতে মামা।
তারপর একটু থেমে আবার বলল : ছোট মামার কথাও এখানে আছে।
: বলিস কি।
: হ্যাঁ মামা। সেদিন ভাষা আন্দোলনের যুদ্ধে ছোট মামা যদি অংশ না নিত, যদি মারা না যেত....তবে....সালাম, রফিক, বরকতের সাথে সাথে ছোট মামার নামটা কি লিখতে পারতাম?
হারুন দেখল ’৫২ সালের সেই ভয়াবহ রাতের মতো আজও ছল ছল করছে কবিতার ভাষাময় চোখ দুটো।
কিছুদিন পর আত্মপ্রকাশ করল কবিতা চৌধুরীর প্রথম উপন্যাস।
‘একুশের দিন রাত্রি’
সাড়া পড়ে গেল সারা দেশে।
হৈ হৈ রৈ রৈ চার দিকে।
কবিতা চৌধুরীকে একনজর দেখবার জন্য অস্থির হয়ে গেল পাঠককুল।
কিন্তু কেউ জানে না এ উপন্যাস লিখতে গিয়ে কতটা রক্তক্ষরণ হয়েছে কবিতার বুক থেকে।
একদিন বন্ধু জাহেদ কবিতাকে আবেগময় কণ্ঠে বলেছিল
: কোনো দিন তো একটুখানি সময় দাওনি কাউকে জানবার, আর ভালোবাসবার জন্য। অনেকটা জীবন তো তুমি পেরিয়ে এলে সাফল্যের পতাকা হাতে।
জাহেদের কথার কোনো জবাব দেয়নি কবিতা।
কি জবাব দেবে সে?
কাউকে ভালোবাসবার জন্য সময়ের দরকার।
আবেগময় মুহূর্তের দরকার।
কিন্তু এসবের জন্য সময় কোথায় কবিতার?
সে যে আকণ্ঠ ডুবে বুঁদ হয়ে আছে।
সাহিত্য আর প্রকৃতির প্রেমে।
যে সমৃৃদ্ধ বাংলা ভাষার অনুরণ তার সমস্ত শিরা-উপশিরায়.....।
যে ’৫২ ভাষা আন্দোলন কলম তুলে দিয়েছিল ওর শিশু হাতে...।
যে আকাশ, বাতাস, আমতলার দোলনা, শরতের শিউলী, আর পুলিশের গুলির সাথে অসহায় মানুষদের আর্তনাদ, আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে জিম্মি করে রেখেছে কবিতাকে। কি করে সে নিজেকে আলাদা করবে এর থেকে?
প্রসব বেদনা কি কবিতা জানে না।
কিন্তু কোনো কিছু সৃষ্টির প্রকাশের যন্ত্রণা যেন ভীষণ ভয়াবহ।
আর সেই ভয়াবহ সৃষ্টি সুখের যন্ত্রণাময় পথে এগোতে লাগল কবিতা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন