শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মহান একুশে সংখ্যা

লেখালেখি

শে খ দ র বা র আ ল ম | প্রকাশের সময় : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

।। এক।।


ফেব্রুয়ারি মাস এ দেশে ঢাকার বাংলা একাডেমি এলাকায় এক মাসব্যাপী বইমেলার মাস। এই বইমেলা উপলক্ষে অনেক প্রকাশক অনেক লেখকের বই ছাপেন। বইমেলায় বিভিন্ন সময়, এমনকি, মেলার শেষের দিকেও কোনো কোনো প্রকাশনী সংস্থা কোনো কোনো লেখকের বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের অনুষ্ঠান করেন। কোন লেখকের বা কোন লেখিকার বই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে, এ বিষয়ে এক সময় খবর বের হতো। এক সময় শুনতাম তসলিমা নাসরিনের বই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে। ইসলামের বিষয়ে এবং ইতিহাস-ভূগোলের বিষয়ে তসলিমা নাসরিনের এক একটা বক্তব্য এক এক সময় প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করত। পরে বুঝেছিলাম এ দুটোর কোনো একটির বিষয়ে আল্লাহর রহমতে তাঁর প্রয়োজনীয় কোনো জ্ঞান-গম্যি নেই।

এ দেশে বইমেলা হয় বাংলা ভাষা আন্দোলনের মাস বলে অভিহিত ফেব্রুয়ারি মাসে। তবে স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিন্দির বিরুদ্ধে কোনো ভাষা আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গে না হলেও সেখানেও বইমেলা হয়। কেবল কলকাতায় নয়, আরো অনেক জায়গায়।

।। দুই।।
শ্রদ্ধেয় এক নতুন কবির কাছে বছর দুই যাবৎ শুনছি, বইমেলা উপলক্ষে তাঁর প্রথম কবিতার বই বের হবে। এবার প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সেই প্রথম কবিতার বই।
তাঁর প্রথম কবিতার প্রথম দিককার পাঠক আমি। এই ফেব্রুয়ারি আসার দ্বিতীয় দিনে তাঁর বই পেলাম। বাংলা একাডেমি এলাকার এই বইমেলার কোন দিকের কত নম্বর স্টলে “কাব্য ঘর” শিরোনামে তাঁর এই কবিতার বই পাওয়া যাবে, সেটিও তিনি জানালেন। কবি মো. হুমায়ুন কবির সাহেবের এই আবেগকে আমি সম্মান করি। মানুষের আবেগকে অনুভ‚তিকে শ্রদ্ধা করতে হয় সম্মান করতে হয়। আমার স্ত্রীও তাঁর কবিতা ভক্তি ভরেই পড়েন। তাঁর আবেগকে শ্রদ্ধা করেন, সম্মান করেন।

।। তিন।।
আমার নজরুল বিষয়ক সাতটা, সংস্কৃতি বিষয়ে দুটো এবং কথাসাহিত্যের একটা বই আছে। এর মধ্যে সাতটা বই আর ছাপা নেই। বাকি তিনটা বইও মেলায় পাওয়া যাবে কি না জানি না। আমি কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও সৃষ্টি বিষয়ে সমস্ত ভ্রান্তি দূর করার জন্য এই বইগুলো লিখেছি। কিন্তু এ দেশে কোনো ক্ষমতাবানকে বা বিত্তবানকে তোয়াজ করার প্রয়োজন না থাকলে সাধারণত কেউ কোনো বই নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন বোধ করেন না। এ দেশের কিছু বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এম এ ক্লাসের পাঠ্যতালিকায়ও মুসলমান সমাজের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরস্পরা এবং এই পরস্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা অচ্ছুৎ! আমি তো ঘরে স্বেচ্ছানির্বাসনে থাকি। তবে এখানকার সাহিত্য-সংস্কৃতির আঙিনা সম্পর্কে একটা ধারণা আছে আমার। দলের এলাকার, গোষ্ঠীর, স্লোগানের মূল্য আছে এ দেশের অনেকের কাছেই। কোনো কিছু গভীরভাবে খতিয়ে দেখার কাজের তেমন কোনো মূল্য নেই। আর লেখা বের হওয়ার ব্যাপারটা, বই বের হওয়ার ব্যাপারটা এ দেশের এখনকার অনেক লোক স্রফে লেখকের অর্জন হিসেবে দেখেন। এতে পাঠকের কিছু পাওয়ার আছে কি না এ নিয়ে চিন্তা করার অবসর বা মানসিকতা অনেকেরই নেই। পশ্চিমবঙ্গের হোক কিংবা বাংলাদেশের হোক। বাংলাভাষী মুসলমানদের অনেককেই চিনি, তাই বলতে পারি খুব প্রয়োজনীয় অনেক বিষয়ে বাংলাভাষী মুসলমানরা এখনো লেখার এবং পড়ার বিষয়ে, জ্ঞানচর্চার বিষয়ে যথেষ্ট প্রস্তুত হয়ে উঠতে পারেননি। প্রয়োজনীয় অনেকট কিছুই গভীরভাবে খতিয়ে দেখার মানসিকতাটাই এখনো অনেকের মধ্যে আসেনি।
এখানে অনেকেরই এ বিষয়ে গঠনমূলক চিন্তা-ভাবনা, ঔদার্য, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, মনের সংবেদনশীলতা আসেনি । এ আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই লক্ষ করেছি। একটা উদাহরণ দিই।

। চার।।
উনিশ শ’ আশি সালের কথা। এর অন্তত বছর পাঁচেক আগে থেকে আমি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন গ্রন্থাগারে আর্কাইভাল ওয়ার্ক করছিলাম। এরই অংশ হিসেবে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ লাইব্রেরি, আনন্দবাজার পত্রিকার লাইব্রেরি, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, কলকাতার আলীপুরের ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতার এসপ্লানেড ইস্টে কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরির নিউজ পেপার সেকশন, এ রকম বিভিন্ন জায়গায় আর্কাইভাল ওয়ার্ক করেছি।
নজরুল-সুহৃদ মুজফফর আহমদের, নজরুল সান্নিধ্যধন্য খান মুজাম্মদ মঈনুদ্দীনের, নজরুল সান্নিধ্যধন্য প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায়ের, নজরুল সান্নিধ্যধন্য সুফি জুলফিকার হায়দারের স্মৃতিকথায় যেসব তারিখ-তথ্য আছে, সেগুলো দৈনিক ও সামরিক পত্রে প্রকাশিত তারিখ-তথ্যের সঙ্গে এক সময় মিলিয়ে দেখার প্রয়োজনে কলকাতার এসপ্লানেড ইস্টে কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরির নিউজ পেশার সেকশনে আর্কাইভাল ওয়ার্ক করছিলাম।

১২ বঙ্গিম চ্যাটার্জী স্ট্রিট, কলকাতা ১২, এই ঠিপনাস্থিত ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড থেকে ১৯৬৯-এর অক্টোবরে প্রকাশিত কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথার তৃতীয় মুদ্রণে ৩৬ পৃষ্ঠায় নজরুল সুহৃদ মুজফকর আহমদ সাহেব লিখেছেন-
“শেষ পর্যন্ত ১৯১৭ সালে ভারতের ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট একটি বেঙ্গলি ডবল কোম্পানী গঠন করতে রাজি হলেন তখন সেই সময়ের দেশনেতারা সৈন্যদলে ভর্তি হওয়ার জন্যে বাঙ্গালী যুবকদের আহ্বান জানালেন। অন্য অনেক যুবকের মতো রানীগঞ্জের শিয়ারশোল রাজ হাইস্কুলের দশম শ্রেণীর প্রথম ছাত্র কাজী নজরুল ইসলামও এই আহ্বানে সাড়া দিলো।”

কলকাতার এসপ্লানেড ইস্টে কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরির নিউজ পেপার সেকশনে ১৯১৭ সালের বিভিন্ন দৈনিকের ফাইল তন্ন তন্ন করে ঘেঁটে বেঙ্গলী ডবল কোম্পানী গঠনের কোনো খবর পেলাম না। এ বিষয়ে অনেক তারিখ তথ্য পেলাম পিছিয়ে গিয়ে ১৯১৬ সালের কোনো কোনো দৈনিকে। সবচেয়ে বেশি তারিখ-তথ্য পেলাম ইংরেজি দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকায়।

কিছু তারিখ-তথ্য কালানুক্রমিকভাবে সাজিয়ে একটা নিবন্ধ লিখলাম ‘বেঙ্গলী ডবল কোম্পানী ও কবি-সৈনিক’ শিরোনামে।
তখন কলকাতার কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের হরফ প্রকাশনী থেকে আব্দুল আজীজ আল আমান সাহেবের মালিকানায় এবং সম্পাদনায় প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা কাফেলায় নজরুল বিষয়ক অনেক লেখা ছাপা হতো। একদিন সকাল ১০টার দিকে গিয়ে লেখাটা ছাপার জন্য তাঁকে দিয়ে এলাম।
এর পর একটা সময় বিভিন্ন দৈনিকে এবং সাময়িক পত্রে কবি কাজী নজরুল ইসলামের কারা জীবন সম্পর্কে অনেক তথ্য পেলাম। সে সবের একটা অংশ কলানুক্রমিকভাবে সাজিয়ে ‘রাজবন্দী কবি’ শিরোনামে একটা প্রবন্ধ লিখলাম। ‘বেঙ্গলী ডবল কোম্পানী ও কবি-সৈনিক’ শিরোনামের নিবন্ধটি আব্দুল আজীজ-আল আমান সাহেবের হাতে দেয়ার বৎসরাধিক কাল পর।
‘রাজবন্দী কবি’ শিরোনামের প্রবন্ধটি নিয়ে একদিন সকাল দশটার দিকে হরফ প্রপশনীতে আবদুল আজীজ-আল আমান সাহেবের কাছে সেটা দিতে গেলাম।

দিলাম। তিনি হাত বাড়িয়ে সেটা গ্রহণ ও করলেন। এর পর কিছু বলার আগে ‘বেঙ্গলী ডবল কোম্পানী ও কবি- সৈনিক’ শিরোনামের নিবন্ধটি নীরবে ফিরিয়ে দিলেন।
আমিও কিছু বললাম না। সৌজন্যবোধের পরিচয় দেয়ার প্রয়োজনে ‘রাজবন্দী কবি’ শিরোনামের প্রবন্ধটিও ফেরত চাইলাম না। ‘বেঙ্গলী ডবল কোম্পানী ও কবি-সৈনিক’ শিরোনামে নিবন্ধটি হাতে নিয়ে কলেজ স্ট্রীট মোড়ে এসে ট্রাম ধরে গেলাম আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসে তখনকার সপ্তাহিক ‘দেশে’ পত্রিকার সম্পাদক সাগরমর ঘোষ মশাইয়ের কাছে। তিনি নিবন্ধটি হাতে নিয়ে প্রথম দু-একটা লাইন বোধহয় দেখলেন।
সেই দিন ছিল শুক্রবার। তখন বেলা এগারোটার মতো হবে।
প্রথম পৃষ্ঠার দু-একটা লাইনের ওপর একটু চোখ বুলিয়ে সম্পাদক সাগরময় ঘোষ মহাশয় বললেন,


ছবি দেবেন (সোমবার) এ রকম সময়ে আসুন।
সোমবার বেলা এগারোটার দিকেই গেলাম। ছবি দিয়ে এলাম।
এর সপ্তাহ খানেক পরেই বহুল প্রচারিত দৈনিক ‘আনন্দ বাজার পত্রিকায়’ এই লেখায় বাইকালার বিজ্ঞাপন কার হলো। সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকার বেঙ্গলী ডবল কোম্পানী ও কবি সৈনিক প্রচ্ছদ নিবন্ধ হিসাবে ছাপা হয়েছে। সে দিক দিয়ে এই লেখারই বিজ্ঞাপন।
প্রথমে আমার লেখাটার ছাপা অংশ আলাদা করে ডাকে পাঠিয়ে দিলেন ওরা। তারপর ডাকেই পাঠালেন পত্রিকার একটা কপি।
এরপর ডাকেই পাঠালেন, অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেক। সেই টাকায় আমাদের দু’জনের এক মাসের সংসার খরচ চলে গিয়েছিল।
১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি তারিখে ছাপা হয়েছিল ‘বেঙ্গলী ডবল কোম্পানী ও কবি সৈনিক’।
কলকাতার পত্রিকা স্টলে ওই সংখ্যার একটা কপির বেশি কিনতে পাইনি। আনন্দ বাজার পত্রিকা অফিসের সেলস কাউন্টারে গিয়েও একটা কপির বেশি পাইনি।
আমার ঐ লেখাটা নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে কেবল সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় নয়, দৈনিক আনন্দ বাজার পত্রিকায়ও। দৈনিক আজকাল পত্রিকায়ও এই লেখার ওপর একটা রিভ্যু বের হয়েছিল।
নিজের লেখা প্রকাশ হওয়া নিয়ে অনেক আনন্দ পেয়েছিলাম সে সময়ে এই বইমেলা উপলক্ষে সেটাই মনে পড়ছে।

।। পাঁচ ।।
ইতিপূর্বে আব্দুল আজীজ আল আমান সাহেবের কাছে রাজবন্দী কবি শিরোনামের প্রবন্ধ দিয়ে আসার কথা লিখেছি।
কিন্তু এর চার মাসের মধ্যেও মালিক সম্পাদক আব্দুল আজীজ আল আমান সাহেব মাসিক কাফেলায় রাজবন্দী কবি যখন ছাপলেন না তখন ঠিক আগের মতোই এক শুক্রবারে সকাল দশটার দিকেই গেলাম হরফ প্রকাশনীতে।
আব্দুল আজীজ আল আমান সাহেব বললেন, ওরা লেখাটা খুব মর্যাদা দিয়ে ছেপেছেন।
এরপর আমার লেখা রাজবন্দী কবি হাত বাড়িয়ে নীরবেই ফেরত দিলেন।
আগের মতোই হরফ প্রকাশনীর দোতলা থেকে নেমে কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে এসে ট্রাম ধরে গেলাম দৈনিক আনন্দ বাজার পত্রিকা অফিসে সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ মহাশয়ের রুমে।
আগের মতোই তিনি লেখাটার প্রথম পৃষ্ঠা দু-এক লাইনের ওপর চোখ বুলিয়ে মাঝখানের দু’দিন বাদ দিয়ে সোমবারেই এগারোটার দিকে ছবি নিয়ে যেতে বললেন।
গেলাম সোমবার ঠিক বেলা এগারোটায়।
রাজবন্দী কবিতে শেষের দিকে তারিখ তথ্যভিত্তিক একটা দীর্ঘ ঐতিহাসিক পটভ‚মিকা ছিল। দেখলাম উনি উডপেন্সিল দিয়ে এক জায়গায় ছোট একটা টিক মার্ক দিয়ে রেখেছেন। বললেন, আপনি ইতিহাস বিষয়ে অনেক কাজ করেছেন। আমরা এ পর্যন্ত ছাপব।
দেখলাম, উনি কাঁচি এগিয়ে দিচ্ছেন।
বললাম, আপনিই কেটে দিন।
উনি বললেন, ও কাজটা আমরা করি না।
এরপর সেই রাজবন্দী কবিওতো ছাপা হলো একক প্রচ্ছদ নিবন্ধ হিসাবেই। দৈনিক আনন্দ বাজার পত্রিকায় এর বাইবালার বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছিল।

সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকার ২৯ মে ১৯৮২ তারিখের সংখ্যায়।
ওই একইভাবে একক প্রচ্ছদ নিবন্ধ হিসাবেই সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল নজরুলের পরিচালনায় নাঙ্গল ২৫ আগস্ট ১৯৮৪ তারিখে। এটা ছাপার আগে দৈনিক আনন্দ বাজার পত্রিকায় এর বিজ্ঞাপন কিভাবে যাবে দেখিয়ে সাগরময় ঘোষ মহাশয় বলেছিলেন, ‘আপনাকে বাঙলার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবো।’
একক প্রচ্ছদ নিবন্ধ হিসাবে ওভাবেই দৈনিক আনন্দ বাজার পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় ‘ঢাকায় নজরুল’ ছাপা হয়েছিল ৩১ আগস্ট ১৯৮৫ তারিখের সংখ্যায়। আমার জীবনে সেই দিনগুলি ছিল খুবই আনন্দের। মানুষ প্রশংসা করতেন।
আমার জীবনে আনন্দ বাজার কর্তৃপক্ষের একটা দান আছে। সেটা আমি স্বীকার করি এবং স্মরণ করি। কোনো দিনই ভুলতে পারব না একটি সমাজের কাছে কিছু মানুষের কাছে সে আমার ঋণ।


।। ছয়।।
১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট তারিখে ভারতীয় উপমহাদেশে একটা মুসলিম প্রধান দেশ হলো বাঙ্গালী মুসলমানদের একটা অংশ প্রথমে একটা প্রদেশ পেলেন। পরে দেশ পেলেন। কিন্তু সাপ্তাহিক কিংবা পাক্ষিক দেশ পত্রিকার মতো একটা পত্রিকায় বের হলো না। মাসিক সওগাত, ত্রৈমাসিক বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, মাসিক মোসলেম ভারত, মাসিক মোহম্মদীর মতো পত্রিকাগুলোও আর থাকল না।
১৯৪৭-এর মধ্য আগস্টের বিভাজনের দুই দিকের দুই জাতীয়তাবাদের চাপে নজরুল অবরুদ্ধ হয়ে গেলেন দুই দিকের বাংলাভাষীদের কাছেই!
১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টের পর থেকেই আর্থিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার রাজনীতি শিক্ষাঙ্গনে, সাহিত্য সংস্কৃতির আঙ্গিনায়, গণমাধ্যমে এ রকম সর্বত্রই আমাদের মুসলমান সমাজের ইতিহাস ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতি সত্তা আক্ষরিক অর্থেই যেন গিলে খাচ্ছে সর্বগ্রাসী ক্ষুধা নিয়ে। এমন সর্বনাশ ১৯৪৭-এর মধ্য আগস্টে ভারতীয় উপমহাদেশ ভাগ না হলে হতে পারত না। কথাটা আক্ষরিক অর্থেই সত্য!

১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট থেকে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এমএ ক্লাসের পাঠ্য তালিকায়ও মুসলমান সমাজের ইতিহাস ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরপাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা অচ্ছ্যুৎ হয়েছিল ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের প্রয়োজনে। সাম্য ও সহাবস্থানের কবি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য-সঙ্গীত ও আবশ্যক পাঠ্য ছিল না। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ কায়েম করার প্রয়োজনেই ১৭৫৭-র ২৩ জুনের পলাশীর ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধ যুদ্ধ প্রহসনের সময় থেকে ১৯৪৭-এর মধ্য আগস্ট পর্যন্ত একশ’ নব্বই বছরের ইংরেজদের উপনিবেশিক শাসনামলের ইতিহাসটাও পড়ানোর ব্যবস্থা হয়নি। আমাদের ঘরের শিক্ষার্থীরা কি শিখবেন? কীভাবে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন সচেতন ও দায়িত্বশীল নাগরিক হবেন।
সাহিত্য সঙ্গীত হিসাবে কী শেখানো হচ্ছে, সংস্কৃতির নামে কী শেখানো হচ্ছে, জাতিসত্তার নামে জোরজবরদস্তি করে কী শেখানো হচ্ছে, ইতিহাসের বিকৃতভাবে নামে কী শেখানো হচ্ছে এবং কী শেখানো উচিত, এ সব সঠিকভাবে দেখার কেউ কোতাও ছিলেন বা আছেন বলে জানি না। জ্ঞানচর্চা ছেড়ে স্লোগানমত্ত হওয়াটা কোনো জনগোষ্ঠীর জন্য কখনো ভালো হয় না। ভারতীয় উপমহাদেশে আমাদের প্রতিবেশী বড় সমাজ বলেন যে, তাদের ইতিহাস পাঁচ হাজার বছরের। আমাদের ইতিহাসটা কত দিনের? এসব ভেবে দেখার, এসব নিয়ে আলোচনা করার মতো একটা সাময়িকপত্রও কি থাকবে না? সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক দেশ পত্রিকা বের করার মতো যোগ্যতা কি আমরা অর্জন করেছি?

।। সাত।।
যাঁরা রাজনীতির চর্চা করে ক্ষমতায় আরোহণের প্রয়াস চালান তাদের মতো প্রকাশের স্বাধীনতা কতটুকু থাকবে? বা না থাকবে সে সিদ্ধান্ত না হয় রাজনৈতিক নেতারাই নেন! কিন্তু বিভিন্ন ধর্মীয় সমাজের অর্থনৈতিক সাম্য ও সামাজিক সাম্য ও বিভিন্ন ধর্মীয় সমাজের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত, আইনগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক সহাবস্থানের নীতিতে আমাদের শিক্ষাঙ্গনে, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এবং গণমাধ্যমে মুসলমান সমাজের ইতিহাস ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা চর্চার সংস্থানটা কেড়ে নিলে তাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কী উপকার হবে?
একের ধর্ম অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যেমন ভালো নয়, তেমনি কোনো একটা জনগোষ্ঠীর জাতিসত্তাও কি অন্য কোনো জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া ভালো? এ প্রসঙ্গে জাতীয়তাবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতার কথা আসে। জাতীয়তাবাদ কী এবং সাম্প্রদায়িকতা কী সেটা আমাদের সবাইকেই বুঝতে হবে, উপলব্ধি করতে হবে।
ধর্মভিত্তিক হোক বর্ণ বা গায়ের রঙভিত্তিক হোক, ভাগভিত্তিক হোক, কিংবা কোনো অঞ্চল বা আঞ্চলিকতাভিত্তিক হোক, যে কোনো জাতীয়তাবাদ তুঙ্গে তোলা তো অনেক দূরের কথা, গড়ে তুলতে হলেও কোনো জনগোষ্ঠীকে প্রতিপক্ষ ও শত্রু হিসাবে শনাক্ত করতে হয়। প্রতিপক্ষ ও শত্রু হিসাবে শনাক্ত এই জনগোষ্ঠীকে এক বা একাধিক বিষয়ে অধিকার বঞ্চিত করাটাই হলো সাম্প্রদায়িকতা। আর প্রতিপক্ষ ও শত্রু হিসাবে চিহ্নিত জনগোষ্ঠীর জানমাল কেড়ে নেওয়াটাই হলো ফ্যাসিবাদ, নাৎসীবাদ। আর মানবিক মূল্যবোধ বা মানবতাবাদটা হলো এই যে, নিজে অন্যের কাছ থেকে যে রকম কথা শুনতে চাই এবং যে রকম ব্যবহার পেতে চাই, ঠিক সে রকম কথাই আর কাউকে বা অন্য কাউকে বলা এবং সে রকম ব্যবহারই অন্য কারো সঙ্গে করা। আমরা মানবাধিকার মানলে কেবল ধর্মের ভিত্তিতে ধর্মের বা গায়ের রঙের ভিত্তিতে অঞ্চল বা আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে নয়, ভাষার ভিত্তিতেও কোনো জনগোষ্ঠীকে প্রতিপক্ষ ও শত্রু হিসাবে শনাক্ত করে জাতীয়তাবাদী হয়ে কোনো জনগোষ্ঠীকে অধিকার বঞ্চিত করে সাম্প্রদায়িক হতে পারি না; প্রতিপক্ষ শত্রু হিসাবে শনাক্ত জনগোষ্ঠীর জানমাল কেড়ে নিয়ে ফ্যাসিবাদী হওয়া তো অনেক দূরের কথা! মনে রাখা দরকার যে, তৌহিদীবাদ কেন্দ্রিক অর্থাৎ আল্লাহর একত্ববাদ কেন্দ্রিক বা আল্লাহর ঙহবহবংং কেন্দ্রিক ইসলাম কোনো জনগোষ্ঠীকে প্রতিপক্ষ ও শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করে জাতীয়তাবাদী হওয়ার ফলে জানমাল কেড়ে নেওয়ার ফ্যাসিবাদী হওয়ার অনুমোদন দেওয়া তো অনেক দূরের কথা, অধিকার বঞ্চিত করে সাম্প্রদায়িক হওয়ারও অনুমোদন দেয় না। অতএব আমাদের যে জাতীয়তাবাদই থেকে থাকুক, সেটা ত্যাগ করার প্রয়োজন আছে।
ভারতীয় উপমহাদেশে একদিকে আমাদের প্রতিবেশী বড় সমাজের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ এবং অন্য দিকে আমাদের ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ এই দুই জাতীয়তাবাদে আমরা পিষ্ট হচ্ছি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন