২০০৯ সালের এক ভাষা শুমারিতে জানা গেল পৃথিবীতে সেই সালে ৬,৯০৯টি ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করলেন যে পরবর্তী শতাব্দীর ভেতর এর কমপক্ষে তিন হাজার ভাষার (অর্থাৎ প্রায় অর্ধেকের) মৃত্যু হবে। এই সমীক্ষা করে করেছিল। ‘এথলোলগ’ নামে পৃথিবীর ভাষা নিয়ে গবেষণা করা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। পৃথিবীতে ভাষাভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্র রয়েছে ২২৫টা মাত্র। গবেষকরা বলেন যে, দুর্বল ভাষার মৃত্যু হয় যখন, কখনও অভিজাত সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়, দুর্বল জাতির উপর স্টিমরোলার চালান হয়, রাষ্ট্র হয়ে পড়ে পুলিশি রাষ্ট্র, চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ফলে দুর্বল জাতির তথা পরাজিত জাতির ভাষা আধ মরা হয়ে পড়ে।
পনর শতকে স্পেন-পর্তুগালের খ্রিষ্টান-মুসলমানদের সম্মিলিত ভাষা মোজারাবিক-এর এখন আর নাম নিশানা নেই। এর আর এক নাম ছিল আজমী ভাষা। অষ্টম থেকে পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত এ ভাষা ব্যবহৃত হত। মুসলিম পরাজয়ে এটির ব্যবহার নিষিদ্ধ হয় স্পেন-পর্তুগালে। আর একটি ভাষা না চালু ছিল মুসলিম শাসনে আন্দালুসি আরবী তাও নিষিদ্ধ হয় ইসলাম ধর্মের নিষিদ্ধতার সঙ্গে সঙ্গে। খ্রিষ্ট সরকার এই ভাষাগুলোর বই পুস্তক পর্যন্ত ধ্বংস করে ভাষা-পুলিশের দ্বারা। মুসলিম শিশুদের জন্য বিশেষ স্কুলে ভাষা বদল করানো হয়। মজার ব্যাপার অনেক পরে স্পেনের ক্যাটালোনিয়া এলাকাতে ক্যাটলান ভাষাও নিষিদ্ধ করে স্পেন সরকার, সবাইকে এক স্পেনীয় ভাষা বলতে বাধ্য করতে। উল্লেখ্য যে, ইউরোপীয় শাসকদের একটা নিয়ম ছিল রাজার ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতি প্রজার ভাষা।
আমেরি নওঅস্ট্রেলিয়া মহাদেশের ভাষার মড়ক লাগে। একে তো শতকরা নব্বই ভাগ আদিবাসী নিহত বা সংক্রামক ব্যাধিতে নিপাত যায়। তারপর তাদের ভাষাগুলোও শেখে। আমেরি বা অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে আদিবাসীদের বাধ্য করা হয়, মাতৃভাষা না বলে ইংরেজী বলতে। ভাষা বদলাও সরকার ও খ্রিষ্টান মিশনারীরা আদিবাসীদের ছেলে মেয়ে চুরি করে নিয়ে যেত যে কাহিনী “স্টোলেন চিল্ডরেন” নামে কুখ্যাত।
হার্ভার্ড ম্যাগাজিনে ২০০২ মার্চ-এপ্রিলে “ল্যাংগুয়েজ ওয়ারস” নামক লেখায় নেল লেক লেখেন যে যখন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭৭৬ সালে শতকরা চল্লিশ ভাগের, ভাষা ছিল ইংরেজী। বর্তমানে তা ৮৭ ভাগ। আর একতথ্যে জানা যায়, মাত্র শতকরা একভাগ কম হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে জার্মান ভাষা রাষ্ট্র ভাষা না হয়ে ইংরেজী হয়। উল্লেখ করতে হয় যে. ডোনাল্ড ট্রাম্প কিন্তু জার্মান রক্তসূত্রে। নেল লেক লিখেছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ রাজ্যগুলোতে দাস মালিক ও দাস ব্যবসায়ীরা কখনও কখনও দাসদের জিহ্বা কেটে ফেলত যদি- তারা ইংরেজী বলতে অসমর্থ বা অনিচ্ছুক হতো। ভাষাযুদ্ধের অন্য একটি চিত্র এই যে গৃহযুদ্ধের (১৮৬১-১৮৬৫) সময় ১৮৬২ সালে জেনারেল বেনজামিন বাটলার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের ইউনিয়নিস্ট সরকারের পক্ষে নিউ অবলিনস এলাকায় ঢোকেন, তিনি ইচ্ছা করেই কতিপয় ফরাসি বুদ্ধীজীবীকে ফাঁসি দিলেন ফরাসি ভাষার প্রভাব কমাতে, বলেন নেল লেক। আব্রাহাম লিংকনের মত উদার মানুষও ভাষাভিত্তিক বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করলেন। কি আশ্চর্য!
পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে ব্লাকফুট রেড ইন্ডিয়ান নামক আদিবাসীদের বোডিং স্কুলে পাঠান হয় যেখানে আদিবাসীদের মাতৃভাষা বলা ছিল নিষিদ্ধ। যদি কেউ বলত তাকে পিটানো যেত। এখন বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশে জার্মান ভাষা বলা নিষিদ্ধ করা হয়। এ যুগে এসে দেখা যায়, সার্বিয়ার নেতা শ্লোবেডেন মিলোসেভিক আলবেনীয় ভাষীদের, সে ভাষা বলা নিষিদ্ধ করেন। আলবেনীয়রা অস্বীকার করল। শুরু হল যুদ্ধ। ভাষা থেকে যুদ্ধ শুরু।
চতুর্থ শতকে হিব্রæ ভাষার মৃত্যু হলেও রাজনৈতিক ও পাশ্চাত্য সহযোগিতায় ১৮৮০ সালে এর পুনজন্ম হলো। এটা এখন ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় ভাষা।
ভারতের আসামে বাঙলা ভাষার পক্ষে আন্দোলনে বরাক উপত্যকার শিলচর রেল স্টেশনে ১৯ মে ১৯৬১ সালে ১১ বাঙালী নিহত হয়। ১৭ আগস্ট ১৯৭২ সালে আর একব্যক্তি আসামে নিহত হলো। একই দাবি হত, ১৯৮৫ ও ১৯৮৬ সালে আরও তিনজন নিহত হয়। ১৯৭৬ সালের জুন মাসের ১৬ তারিখে প্রায় সাতশত স্কুল ছাত্রছাত্রীকে দক্ষিণ আফ্রিকায় হত্যা করা হয় তাদের ভাষা আন্দোলন থামানোর জন্য। চীনের তুর্কী অধ্যুষিত প্রদেশ সিনকিয়াঙের উইঘুর ভাষা বর্তমানে নিষিদ্ধ। এমনকি তাদের ধর্ম ইসলাম, নামাজ, রোজা, দাড়ি, টুপিসহ নিষিদ্ধ।
ভারতে বাংলা ভাষা রাষ্ট্র ভাষা হওয়ার কোনোই সম্ভাবনা নেই। এমনকি সে ভাষা এখন কোন ভাষা। পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেছেন, “বাংলা ভাষা এই পশ্চিমবঙ্গের যথাযত সম্মান ও স্বীকৃতি পাচ্ছে না। বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা ও আবেগ বাংলাদেশের নাগরিকদের অনেক বেশি। কিন্তু সেই তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা যা করে তা কিছুই নয়।” (বাংলাদেশ প্রতিদিন”, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯)।
ভাষার দিক দিয়ে ইন্ডিয়ার চেয়ে বাংলাদেশ বাংলা ভাষা ভালো অবস্থানে রয়েছে। ইন্ডিয়াতে বাংলা ভাষা কোনোদিন রাষ্ট্র ভাষা হতে পারবে না। বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠান আন্দোলন প্রথম শুরু করে ১৯৪৭ সালে তমদ্দুন মজলিস। ইংরেজীতে একটি কথা আছে “টু বেল দি ক্যাট” তমদ্দুন মজলিস তাই করে। এর স্বীকৃতি রয়েছে বঙ্গবন্ধুর “অসমাপ্ত আত্মজীবনী”-তে। এ ছাড়া নবম-দশম শ্রেণীর পাঠ্য পুস্তক ও প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন সময়ের ভাষা দিবসের বাণীও প্রমাণ বিশেষ। তমদ্দুন মজলিসের সুপ্রিম লিডার অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল গফুর ও ভাষা সৈনিক অধ্যাপিকা চেমন আরা আজও জীবিত আছেন। ১১ মার্চ ১৯৪৮ সালে ভাষার জন্য ধর্মঘট হয় তমদ্দুন মজলিস ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে। সে ধর্মঘটে ছাত্র হিসেবে আমিও যোগ দেই বগুড়ার কাগইল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে গোকুল উচ্চ বিদ্যালয় আসা যাওয়া প্রায় বার কি:মি: পর্যন্ত মিছিল করে। তমদ্দুন মজলিসের অবদান নিয়ে, প্রায় আট পৃষ্ঠার “জাতীয় পুনর্জাগরনে তমদ্দুন মজলিস” শীর্ষক গবেষণা গ্রন্থ রচনা করেছেন এম এ বর্ণিক। এটি একটি বিশাল ও মহান কাজ হয়েছে। এর জন্য “একুশে পদক” বা “স্বাধীনতা পদক” যোগ্য প্রতিদান হতে পারে। এমনকি এই মহান গবেষণার জন্য “ডিলিট” সম্মাননা ও উপযোগী। গুণীর সম্মান না দিলে আমরা নিজেরাই দরিদ্র হয়ে যাব। বইটির আর্থিক মূল্য অনেক বেশি পনের শত টাকা।
কোনো “স্পন্সর” পেলে সস্তায় পাঁচশো টাকার ভেতর পরিবেশন করতে পারলে সংস্কৃতির জগতে একটা মূল্যবান কাজ হতো।
তমদ্দুন মজলিস বাংলা ভাষার পক্ষে কাজ করে চলেছে। তবে এটা বিষয়ে তাদের পরিসর এখন ক্ষুদ্রতর। বাংলা প্রবীণ নেতৃত্ব, কলেজ, আবুজর গিফারী কলেজ, ইসলামী একাডেমি, সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকা ইত্যাদি হারিয়ে তমদ্দুন মজলিস এখন এই অবস্থায়। তমদ্দুন মজলিসের বর্তমান সভাপতি হিসেবে আমি আবেদন রাখব ভাষা, স্বাধীনতা ও সুসংস্কৃতির পক্ষে কার্যরত এই ঐতিহ্যবাহী সংগঠনকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করতে। এ বছর ২০১৯ সালে তমদ্দুন মজলিস ২১ ফেব্রæয়ারি ২০১৯ ঢাকা ফটোজার্নালিস্ট এসোসিয়েসন মিলনায়তনে বিকেল তিনটা থেকে আলোচনা করবে। বিষয় থাকবে, “ভাষা আন্দোলন থেকে বাংলাদেশ।” এ উপলক্ষে ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় ভাষাসৈনিক অধ্যক্ষ আশরাফ ফারুকীকে তমদ্দুন মজলিসের মাতৃভাষা পদক ২০১৯ প্রদান করা হবে। এছাড়া ভাষার উপরে তিনটি বিষয়ে রচনা প্রতিযোগিতায় ও পুরস্কার বিতরণ করা হবে। রচনা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দেশপ্রেম ও সুসংস্কৃতি উৎসাহ প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে লেখক তৈরির প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে। তমদ্দুন মজলিস বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষায় ওয়াদাবদ্ধ।
লেখক: ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন