উপজেলা নির্বাচন নিয়ে জনগণের মধ্যে কোনো আগ্রহ, উৎসাহ ও উদ্দীপনা নেই। এ নির্বাচনের পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্ব›িদ্বতায় আওয়ামী লীগ। এ নিয়ে তাদের মধ্যে দলীয় কোন্দল প্রবল আকার ধারণ করেছে। কেউ যেন কাউকে মেনে নিতে পারছে না।
বিগত উপজেলা নির্বাচনে প্রথম দফা ও দ্বিতীয় দফা নিরপেক্ষ ভোট হলেও তারপর আর নিরপেক্ষ ভোট হয়নি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভয়াবহ বিপর্যয়ের পর বিএনপিতে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। নির্বাচনে অপ্রত্যাশিত পরাজয়ের জন্য নির্বাহী কমিটি থেকে শুরু করে অঙ্গ সংগঠন, জেলা উপজেলা পর্যায়ের নেতৃত্ব পুনর্গঠনের কাজও চলছে। সেই নির্বাচনের দুঃসহ অভিজ্ঞতার ‘ঘা’ না শুকাতেই ঘোষণা করা হয়েছে উপজেলা নির্বাচনের তফসিল। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ১০ মার্চ প্রথম ধাপে ৮৭টি উপজেলায় এবং ১৮ মার্চ দ্বিতীয় ধাপে ১২৯টি উপজেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ২৪ মার্চ তৃতীয় ধাপে ১২৬ উপজেলায় নির্বাচন হবে। মনোনয়ন পত্র যাছাই-বাছাই চলছে। তবে অন্যন্য প্রার্থীদের মনোনয়ন পত্র যাছাই-বাছাইয়ের পর বাদ পড়লেও আওয়ামী লীগের কারো মনোনয়নপত্র বাদ পড়ছে না। বিগত ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনে ভোট চুরি, জালিয়াতি এবং আগের রাতে সিল মারার অভিযোগে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দল বিএনপি। গত ২৪ জানুয়ারি দলটির স্থায়ী কমিটির সভায় এই নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তবে দলের সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায় বিএনপির প্রায় একশ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ চেয়ারম্যান পদের জন্য প্রথম ধাপে ৮৭ জন এবং দ্বিতীয় ধাপে ১২২ জন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে এবার ভোট হবে পাঁচ পর্বে।
১৯৮৫ সালে উপজেলা পরিষদ চালু হওয়ার পর ১৯৯০ ও ২০০৯ সালে একই দিনে সব উপজেলায় ভোট হয়েছিল। ২০১৪ সালে সব উপজেলায় ছয় ধাপে ভোট করেছিল তৎকালীন ইসি। সেই ধারা বজায় রেখে এবার বিভাগওয়ারী ভোট করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার বিষয়টি দেখে বাকিগুলোর ভোট হবে পঞ্চমধাপে। উপজেলা ভোটেও ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ব্যবহার করবে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। আগে উপজেলা নির্বাচন র্নিদলীয়ভাবে হলেও এবার হচ্ছে দলীয় প্রতীকে। ফলে এ নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দলের কোনো আগ্রহ নেই। নির্বাচনে প্রশাসনযন্ত্র ব্যবহার করে বিজয় নিশ্চিত করতে চায় সরকারি দল, এ ব্যাপারে কারো কোনো সন্দেহ নেই। অনেকের মন্তব্য, এ দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে শত প্রতিকূলতা মধ্যেও গণতান্ত্রিক রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে খানিকটা আলো দেখা গিয়েছিল। সবার অংশগ্রহণমূলক হলেও নির্বাচনের সুষ্ঠতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে নানা প্রশ্ন ছিল নানা মহলে। অনেকে বলেছিলেন, নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ বড় বিষয় নয়, নির্বাচনটি অবাধ, নিরপেক্ষ হওয়াই বড় বিষয়। নির্বাচনে সবার প্রত্যাাশা পূরণ হয়নি। এই নির্বাচন গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ ও স্বচ্ছ রাজনীতির বিষয়ে নানা প্রশ্ন দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে কার্যকর গণতন্ত্র আছে কিনা এই প্রশ্নটি ইতোমধ্যে উঠে এসেছে। একাদশ সংসদ নির্বাচন সর্ম্পকে এক কথায় বলা যায়, কতৃত্ববাদী ব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য অশনি সংকেত। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যে এদেশে চালু নেই এ নির্বাচনের মাধ্যমে তা প্রমাণিত হয়েছে। ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল সে নির্বাচনে পরাজিতদের কিছু অভিযোগ থাকলেও নির্বাচন সবার কাছে বৈধতা পেয়েছিল। কিন্তু এখন দেশের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে উল্টো চলছে গণতন্ত্র। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করা সম্ভব নয়, তা আবার প্রমাণিত হলো।
২০০৮ সালে ডিসেম্বরের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনেকটা একক অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনে গণতন্ত্রকে দুর্বল করে ফেলে। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে নজিরবিহীন অনিয়ম ও নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে ক্ষমতাসীন দলের অনুকূলে সিল মেরে রাখা, বুথ দখল করে প্রকাশ্যে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের অনুকূলে ব্যালটে সিল মারা, সরকার বিরোধী জোটের পোলিং এজন্টদের ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেয়া, সরকার বিরোধী দল বা জোটের প্রার্থীদের সমর্থক ও নেতাকর্মীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, হামলা, নির্বাচনী ক্যাম্প ভাংচুর করা ও পুড়িয়ে দেয়া ইত্যাদি গণতন্ত্রকে আরও দুর্বল করে তুলেছে। গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার সূচকে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসেবে ফ্রিডম হাউসের ২০১৯ এর প্রতিবেদনে এসব কথা উল্লেখ রয়েছে। সংবিধান স্বীকৃত নাগরিক স্বাধীনতা বিপর্যয়ের মুখে। জনগণের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গত এক দশকে গুমের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। এখানে বড় অভিযোগটি হলো, মানুষের জীবনের নিরাপত্তা প্রদানের জন্য জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পালিত আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সরকার অপরাধ সংগঠনে ব্যবহার করছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক আর্ন্তজাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট-২০১৮ এর প্রতিবেদনে বাংলাদেশে নাগরিক অধিকার হ্রাসের বিপরীতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং পুলিশসহ নিরাপত্তা বাহিনীর ক্ষমতা বৃদ্ধি উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে। সর্বশেষ বলতে চাই, গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার সূচকে দেশের মানোন্নয়নের জন্য সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিকল্প নেই- সে নির্বাচন জাতীয় বা স্থানীয় যে পর্যায়েই অনুষ্ঠিত হোক। দেশের সংবিধান ও আর্ন্তজাতিক মানবাধিকার আইন স্বীকৃত নাগরিক অধিকারগুলোর রক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। জনগণ দেখতে চায়, তাদের প্রিয়দেশ অদূর ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার সূচকে মুক্ত দেশের তালিকায় স্থান পাচ্ছে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন