মোহাম্মদ আবু নোমান
পরিবার মানব সমাজের মূল ভিত্তি। পারিবারিক জীবন বিবর্জিত মানব সভ্যতা কল্পনা করা যায় না। প্রত্যেক মানুষের পারিবারিক জীবন তার অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য। সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা, স্থিতিশীলতা, অগ্রগতি ইত্যাদি পারিবারিক সুস্থতা ও দৃঢ়তার ওপরই বহুলাংশে নির্ভরশীল। যদি পারিবারিক জীবন অসুস্থ ও নড়বড়ে হয়, তাতে ভাঙন ও বিপর্যয় দেখা দেয়, তাহলে সমাজ জীবনে নানা অশান্তি ও উপদ্রব সৃষ্টি হতে বাধ্য। পরিবারই হচ্ছে কল্যাণকর সমাজের ভিত্তি। সুতরাং আদর্শ সমাজ গঠনের অপরিহার্য শর্ত আদর্শ পরিবার গঠন।
মানব জীবনের সূচনালগ্ন থেকেই পৃথিবীতে কোনো না কোনোভাবে পারিবারিক ব্যবস্থা চালু ছিল। সব আম্বিয়ায়ে কেরামের জীবন ও তাদের অনুসৃত সময়কালে পারিবারিক জীবনের ইতিহাস রয়েছে। ইসলাম পারিবারিক জীবনকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করাসহ কোরআন-সুন্নাহর বিধিবিধানের একটা বৃহৎ অংশ জুড়ে রয়েছে পরিবার। সর্বপ্রথম আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.)-কে সৃষ্টি এবং তাদের দাম্পত্য জীবনের মাধ্যমে পৃথিবীতে পারিবারিক জীবনের সূচনা করেন মহান আল্লাহপাক। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মানব! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি হতেই সৃষ্টি করেছেন ও যিনি তা হতে তার স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তাদের দুজন হতে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন’ (সূরা নিসা)। ‘হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ এবং নারী থেকে। তারপর তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হতে পার’ (সূরা হুজুরাত)। এ আয়াত থেকে অতীতকালে পরিবার ও সমাজের অস্তিত্বের ইঙ্গিত ও মানুষের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের যাত্রা প্রমাণ করে। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘হে আদম, তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে একত্রে বসবাস কর এবং যেখান থেকে মন চায় তোমরা দুজনে অবাধে পানাহার কর। কিন্তু এই বৃক্ষের নিকটবর্তী হবে না; তাহলে তোমরা অন্যায়কারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (সূরা বাকারা)। বিবাহকেন্দ্রিক পরিবারের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে মহান আল্লাহ জান্নাতেই আদম ও হাওয়া (আ.)-এর বিবাহের ব্যবস্থা করেন। তাদের জান্নাতে বিবাহ ও অবাধে পানাহার করার সুযোগ দেয়ার পরেও একটি বৃক্ষের নিকট যেতে নিষেধ করা হয়েছিল। এতে করে বিধিবদ্ধ জীবন-যাপনের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
পরিবার হলো আমাদের নাড়ির বাঁধন। মানব জীবন বিকাশের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে আমাদের পরিবার। মানব জীবনে প্রথম এবং সবচেয়ে বড় মানবীয় সংগঠনের নাম পরিবার। সৃষ্টির নিয়মে প্রধানত রক্তের সম্পর্কিত মানুষজন নিয়েই গঠিত হয় পরিবার। একটি শিশুর পরিবার থেকেই নৈতিকতাসম্বলিত আদর্শিক জীবন গঠিত হয়ে থাকে। পরবর্তীতে বড় হয়ে ধীরে ধীরে সে সমাজে কিংবা রাষ্ট্রে নিজের অবস্থান করে নেয়। পাশাপাশি তার নিজ যোগ্যতায় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। তাই ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের জন্য পরিবার ও পারিবারিক কাঠামো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অন্যতম গুণ হবে সুন্দর পারিবারিক জীবন কামনা। ইরশাদ হয়েছেÑ ‘হে আমার পরোয়ারদিগার রব! আমাদেরকে আমাদের স্ত্রী-পরিজন ও আমাদের সন্তান-সন্ততির চোখের শীতলতা দান করুন এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের ইমাম ও পরিচালক নিয়োজিত করুন’ (সূরা ফোরকান)।
পরিবারের গুরুত্ব অশান্ত উচ্ছৃঙ্খল পৃথিবীতে পাশ্চাত্য সমাজ দেরিতে হলেও বুঝতে পেরেছে। আর তাই তো পালন করছে ‘পরিবার দিবস’, ‘মা দিবস’, ‘বাবা দিবস’ ইতাদি। এসব দিবস পাশ্চাত্যের জন্য অত্যাবশ্যকীয় হলেও মুসলিম বিশ্বে আদৌ প্রয়োজন থাকার কথা নয়। পাশ্চাত্য সমাজ বস্তুবাদের রঙিন নেশায় বুঁদ হয়ে পরিবার প্রথাকে উপেক্ষা করছে। ফলে বন্ধনহীন, আদর-স্নেহ, মায়া-মমতা বঞ্চিত শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতী তথা আপামর জনতা অবৈধ যৌনাচারসহ নানাবিধ অন্যায়-অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। ডিএনএ টেস্ট করে সন্তানের পিতা শনাক্ত করতে হচ্ছে। পাশ্চাত্যের মতো এ অবস্থা আমাদের দেশে এখনও হয়নি ধর্মীয় অনুশাসন ও পারিবারিক প্রথার কারণে। কিন্তু কিছু দেশি-বিদেশি এনজিও, এজেন্ট পাশ্চাত্য অবস্থা সৃষ্টির লক্ষ্যে ধর্ম ও পরিবার প্রথাকে ভেঙে দেয়ার জন্য গোপনে ও প্রকাশ্যে কাজ করে যাচ্ছে বহুদিন ধরে। আর এ কাজে সহায়তা করছে কিছু প্রচার মাধ্যম ও তথাকথিত বুদ্ধিজীবী। পাশ্চাত্যে বহু আগেই পারিবারিক প্রথা ভেঙে বিয়ের স্থান দখল করেছে অনৈতিক ভালোবাসা তথা যৌনাচার, যা তাদের সভ্যতার বিদায় ঘণ্টা বাজাচ্ছে নিরন্তর। নারী সহজলভ্য হওয়ায় পারিবারিক বন্ধন বালির বাঁধের মতো ঠুনকো হয়ে গেছে। ফলে নারী-পুরুষ একজন আরেকজনকে যে কোনো সময় ত্যাগ করতে আইনগত কোনো বাধা থাকে না। পাশ্চাত্যবাসী ইতোমধ্যেই এর কুফল লক্ষ্য করেছে। এখন পাশ্চাত্যের অনেক জ্ঞানী, চিন্তাশীল ও দূরদর্শীরা নারীকে তার মূল দায়িত্বে ফিরিয়ে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা নারীকে তার মূল দায়িত্ব তথা সন্তান-সন্ততি প্রতিপালন ও গার্হস্থ্য ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত করার জোর দাবি জানাচ্ছে। অথচ এদেশে আজকে নারী স্বাধীনতার নামে মুসলিম নারীদেরকে ঘর ও পরিবার থেকে বাইরে বের করে বেহায়াপনার দিকে ঠেলে দেয়ার পাঁয়তারা চলছে পুরোদমে। এর মূল লক্ষ্যই হচ্ছে মুসলমানদের পারিবারিক ব্যবস্থার ভিত্তিকে ধসিয়ে দেয়া। নারীদেরকে চাকরি করতেই হবে এমন ধোঁকায় ফেলে তাদেরকে তাদের মূল দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখার সার্বিক প্রয়াস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিভিন্ন প্রলোভনে নারীদেরকে গোলকধাঁধায় ফেলে আমাদের পরিবারগুলোতে নরকের আগুনে দাউ দাউ করে প্রজ্বলিত করার নগ্ন পাঁয়তারা অব্যাহত রয়েছে। আজকে এনজিওগুলো আমাদের মা-বোনদের মুখ দিয়ে বলাতে চেষ্টা করছে, ‘কিসের ঘর কিসের বর। শাক-শুঁটকি খাব না, স্বামীর কথা মানব না’ ইত্যাদি।
পরিবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সৌহার্দ্য, সহমর্মিতা ও ভালোবাসার দৃঢ় বন্ধনের মাধ্যমে পরিবারে একজন মানুষ সমাজের সর্বোচ্চ সুবিধা ভোগ করে থাকে। বিশ্বের প্রতিটি দেশ ও সংস্কৃতিতে পরিবারের গুরুত্ব অপরিসীম। পরিবারকে বলা হয় সমাজ ও রাষ্ট্রের আয়না। রাষ্ট্রের সামাজিক উন্নয়নে পরিবারের ভূমিকা ও দায়িত্ব বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারই একজন মানুষের সর্বপ্রথম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠ। রাষ্ট্র পরিচালনায় যেমন কিছু নিয়মনীতি আছে তেমনি পরিবারেরও নিয়মনীতি রয়েছে। যেমনÑ পরিবারের সবার সঙ্গে সদ্ভাব গড়ে তোলা, সাংসারিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা, মিথ্যা না বলা, গুরুজনদের শ্রদ্ধা করা, নির্দিষ্ট সময়ে ঘরে ফেরা, নিজের কাজ নিজে সম্পন্ন করা এবং মানবিক মূল্যবোধগুলোর চর্চার মাধ্যমে অন্তরকে বিকশিত করা প্রভৃতি।
আধুনিক সমাজে পরস্পরের মিল-মহব্বত সম্বলিত যৌথ পরিবার ও পূর্বেকার সেই মানবিক বন্ধনের রূপটি ক্রমশ হারিয়ে গিয়ে বাড়ছে একক পরিবার। পরিবার মানুষের প্রথম শিক্ষালয়। কাজের প্রয়োজনে হোক আর ইচ্ছে করেই হোক মানুষ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে, ফলে হারিয়ে যাচ্ছে পারিবারিক শিক্ষা এবং আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য। সেই পারিবারিক বন্ধনকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে পৃথিবীব্যাপী ১৫ মে পালিত হয় আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস। প্রতিটি শিশুর শিক্ষা-দীক্ষার প্রথম বিদ্যাপীঠ পরিবার। শিশুরা সামাজিক আচার-আচরণ, পরিবারের সবার প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, হাসি-আনন্দ, দুঃখ ভাগাভাগি করার মধ্য দিয়ে দৃঢ় মানবিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার গুণাবলী শিখে থাকে। যে কারণে পরিবারকে সমাজের মৌলিক ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়।
প্রতিটি মা-বাবাই সন্তানদের নিয়ে স্বপ্ন দেখেন, সন্তানদেরও ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে শেখান। দেখা যায়, যেসব পরিবার সন্তানের প্রতি উদাসীন, যারা সন্তানের প্রতি সঠিক দায়িত্ব পালন করছে না, তাদের অধিকাংশ যুবক-যুবতী ও সন্তানরা উচ্ছৃঙ্খল, অনৈতিক জীবনযাপন করাসহ সমাজে নানা সমস্যা সৃষ্টি করে। এদের মধ্যে বেশির ভাগই ‘ধনী শ্রেণি’ ও ‘দরিদ্র বস্তিবাসী।’ এদের মাঝে ধর্ম, ইসলামী মূল্যবোধ, ইসলামী সংস্কৃতির চর্চা, পারিবারিক বোঝাপড়া, পারস্পরিক দায়িত্ব-কর্তব্যবোধ নেই বললেই চলে। ধনী শ্রেণী বৈধ-অবৈধ পন্থায় টাকা রোজগার এবং ভোগবিলাসেই মত্ত থাকে বেশির ভাগ সময়। সন্তানের চাহিবামাত্র টাকা-পয়সা, কাপড়-চোপড়, দামি মোবাইল, গাড়ি ইত্যাদি কিনে দিয়েই খালাস। অন্ধস্নেহে সন্তানের কোনো ভুলত্রুটি মা-বাবার চোখে ধরা পড়ে না। অভিভাবকগণ এসব ব্যাপারে আগের মতো সচেতন নন, তারা কেবল অর্থের পেছনে ছুটছেন। সন্তানকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করাই একমাত্র বা প্রধান উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। ধর্ম-কর্ম, নীতি-নৈতিকতা গৌণ হয়ে গেছে। নিজেদের ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট ও পদোন্নতির চিন্তায় ব্যস্ত। সন্তানদের সময় দেয়ার সময় নেই, সন্তানও তাই কথা শুনছে না। সমাজের গণ্যমান্য চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ বাংলাদেশের বর্তমান পারিবারিক সমস্যা ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে তাদের উদ্বেগ ও হতাশা ব্যক্ত করেছেন।
পরিবার এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেখান থেকে ভবিষ্যৎ জীবনের পথ নির্দেশনা গড়ে ওঠে। সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে পরিবারবদ্ধ হয়ে বসবাস করে আসছে। তাই সমাজ সৃষ্টিতে পরিবারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে মা, বাবা, ভাই, বোন, শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে বসবাস করছে আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ। একজনের সুখে অন্যজনও সুখী, একজনের দুঃখে কাঁদছে অন্যজন। নিবিড় বন্ধন রয়েছে পরিবারের মধ্যে। একে অপরকে নানাভাবে সাহায্য করে। পরিবারের মধ্যে এই যে বন্ধন, যা আমাদের দেশে খুবই নিবিড়। শহর আর গ্রামের চিত্রটা একটু এদিক ওদিক হলেও ভালোবাসার বন্ধন কিন্তু সব পরিবারেই অটুট। মা-বাবা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী সবার সঙ্গে সবার আত্মার সম্পর্ক। পরিবারে একজন অসুস্থ হলে উদ্বিগ্ন হয়ে থাকে সবাই। খুশির খবরে সবাই খুশি। এই তো আমাদের পরিবার। সমাজ বিজ্ঞানের ভাষায় মা-বাবা, ভাই-বোন, চাচা-চাচি, দাদা-দাদি নিয়েই আমাদের পরিবার। মানুষ যৌথ বা একান্নবর্তী পরিবারে বাস করার কারণেই হয়তো পরিবারের সংজ্ঞা এভাবে করা হয়েছিল। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এখন সেই চিত্র পাল্টে গেছে। শুধু মা-বাবা আর সন্তান মিলেই হচ্ছে পরিবার। অথচ সমাজ জীবনে বৃহত্তর বা যৌথ পরিবারের ভূমিকা ব্যাপক।
১৭৫০ থেকে ১৮৫০ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ড এবং আমেরিকায় শিল্প-বিপ্লব ঘটতে থাকে। শিল্প প্রসারের কারণে পশ্চিমা দেশগুলোর নারী-পুরুষ অর্থ উপার্জনে ঝুঁকে পড়েন। এতে পরিবারের প্রতি তাদের আগ্রহ ও পারিবারিক বন্ধন প্রায় শিথিল হয়ে আসে। অনেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় পরিবার থেকে। কাজ এবং অর্থের প্রয়োজনে যে যেখানে পারছে ছোট ছোট পরিবার গড়ে তুলেছে। আধুনিক সামাজিক ব্যবস্থার প্রসার, অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং সংখ্যানুপাতিক হারে জীবিকার তারতম্য ঘটতে থাকায় যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে যাচ্ছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে বিয়ের প্রতি অনীহা, বিবাহ বিচ্ছেদসহ নানা অঘটন ঘটছে। অনেক শিশু পিতৃপরিচয়হীন জীবনের অসহায়ত্বও বরণ করতে বাধ্য হয়। এ ছাড়াও বাধ্য হয়ে অনেক শিশুকে দিনের একটা বড় অংশ ডে কেয়ার সেন্টারেও কাটাতে হয়।
এ ছাড়াও পারিবারিক জীবনে ধস নেমে আসে খ্রিস্ট ধর্মের প্রভাবে। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দী ছিল ধর্মের ইতিহাসে এক যুগসন্ধিক্ষণ। চতুর্থ শতাব্দীর শেষ ভাগে খ্রিস্ট ধর্মে বৈরাগ্যবাদ ব্যাপক আকার ধারণ করে। সেই যুগে বৈরাগ্যবাদ হয়ে দাঁড়ায় এক সাধারণ ব্যাপার। তখন বহু বিজ্ঞজনও সমাজকে বিদায় জানিয়ে সংসার ত্যাগী সাজে। মায়া-মমতার বন্ধন ছিন্ন করাই ছিল বৈরাগ্যবাদের মূল কথা। অসংখ্য সংসারত্যাগী মানুষ তাদের বাবা-মা, স্ত্রী এবং ছেলে মেয়েদেরকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়। তারা মনে করত পরিবারের প্রতি কর্তব্য পালন করতে গেলে তাদের মনের একাগ্রতা নষ্ট হবে। কিন্তু ইসলাম পরিবার বিচ্ছিন্ন বৈরাগ্য জীবনের অনুমতি দেয় না। কোরআন-হাদিস এমন জীবনকে গর্হিত মনে করে। কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘আর যে রাহবানিয়াতকে (খ্রিস্টানরা) তাদের দীনের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে, তাকে আমি তাদের ওপর ফরজ করিনি’ (হাদিদ)। রাসূল (সা.) বলেন, ‘ইসলামে বৈরাগ্যবাদ নেই’। নবী করীম (সা.) পারিবারিক জীবনের উপরে ভীষণ গুরুত্ব প্রদান করেছেন, যা আমাদের অনুসরণযোগ্য। রাসূল (সা.) একবার তার মেয়ে ফাতেমা (রা.), তার স্বামী হযরত আলী (রা.) ও হাসান হোসাইনকে এক চাদরের নিচে রেখে আল্লাহর নিকট দোয়া করলেন যে, হে আল্লাহ! এরা তো আমার আহলে বাইত (অর্থাৎ পরিবারভুক্ত সদস্য)।
রাসূল (সা.) বিয়েকে ঈমানের অর্ধেক গণ্য করে বলেন, ‘যখন কোনো বান্দা বিয়ে করে তখন সে অর্ধেক দ্বীন পূর্ণ করে। কাজেই অবশিষ্ট অর্ধেকের ব্যাপারে সে আল্লাহকে ভয় করুক।’ তিনি আরো বলেন, ‘বিয়ে করা আমার সুন্নাত। সুতরাং যে আমার সুন্নাত বর্জন করবে সে আমার দলভুক্ত নয়।’ এ থেকে বোঝা যায়, পরিবার গঠনে ইসলামের গুরুত্ব কতটুকু। বিয়ের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য লাভ ও আর্থিক সচ্ছলতা বৃদ্ধি পায়। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তির সাহায্য করা আল্লাহর কর্তব্য হয়ে পড়ে। তার মধ্যে একজন হলোÑ ‘যে লোক বিয়ে করে চারিত্রিক নিষ্কলুষতা রক্ষা করতে চায়।’ অন্যত্র এসেছে, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি সর্বোত্তম যে তার স্ত্রীর নিকট সর্বোত্তম’। ‘সমগ্র পৃথিবীটাই হলো সম্পদ। আর পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ হলো সতী-সাধ্বী নারী।’
হুজুর (সা.) বলেছেন, ‘বিশ্বাসী মুমিনের মধ্যে ওই ব্যক্তির ঈমান সর্বাপেক্ষা পূর্ণ, যে চরিত্রের সৌন্দর্যে উন্নত এবং নিজের পরিজনের প্রতি সর্বাপেক্ষা সদয় ও নম্র ব্যবহার করে’। রাসূল (সা.) নিজের নাতি হাসান এবং হুসাইনকেই নয়, নিজের ক্রীতদাস যায়েদের পুত্র উসামাকেও কত গভীর স্নেহ করতেন, হাদিসে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না’।
অভিজাত এলাকাগুলোর কোনো কোনো পিতা-মাতা যুবক-যুবতী সন্তানদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ, তারা যেন সন্তানের নিকট এক ধরনের জিম্মি হয়ে আছেন। ঘরে ঘরে অশান্তির আগুন জ্বলছে। প্রকৃতপক্ষে, আমরা প্রত্যেকেই কারো না কারো ওপর দায়িত্বশীল। স্ব-স্ব দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করলে সমাজে এত সমস্যা হওয়ার কথা নয়। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকেই যার যার অধীনস্থ লোকজন সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’। তাই স্বামী-স্ত্রী পারস্পরিক পরামর্শ করে কোরআন-হাদিসের আলোকে সন্তানদের গাইড করা উচিত। আল্লাহভীতি, পরকালীন জবাবদিহিতা মুসলমানদের দায়িত্ব-কর্তব্য, আল্লাহর হক, বান্দার হক, পারস্পরিক সহমর্মিতা শিখানোর পাশাপাশি সন্তানদের পর্যাপ্ত সময় দেয়া দরকার। সন্তানের সাথে গ্যাপ সৃষ্টি করা ঠিক নয়। অতিরিক্ত স্নেহ, মাত্রাতিরিক্ত বকাঝকা, মান-অভিমান না করে সন্তান কোথায় যায়, কাদের সাথে মেলামেশা করে অর্থাৎ বন্ধু সার্কেল কেমন তার খোঁজখবর রাখা। ইদানীং বন্ধুরাই বেশি ক্ষতি করে থাকে, এর ভূরি ভূরি নজির রয়েছে। পোশাক-আশাক, চিন্তা-চেতনায় যেন ইসলামী সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের ধারক বাহক হয় সে বিষয়ে সবিশেষ লক্ষ্য রাখা প্রত্যেক মুসলিম পিতা-মাতার অবশ্য কর্তব্য। সন্তানের জীবন গঠনের কোনো পর্যায়ে বাবা-মায়ের দায়িত্বে অবহেলার কারণে যদি সে পথচ্যুত হয়ে যায় তা হলে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতেই মা-বাবাকে তার দায়িত্ব বহন করতে হবে।
বিশেষ করে বর্তমানে স্যাটেলাইটের যুগে অপসংস্কৃতির সয়লাবে আমাদের পারিবারিক জীবন হুমকির মুখে পতিত। স্যাটেলাইটে প্রদর্শিত উলঙ্গপনা ও বেহায়াপনা আমাদের সমাজ জীবনকে কলুষিত করে তুলছে। আমাদের পোশাক-আশাকেও এসেছে উলঙ্গপনার ছাপ। ভ্যালেন্টাইন ডে, বয়ফ্রেন্ড ও গার্লফ্রেন্ডের সংস্কৃতি এখন আমাদের দেশেও চালু হতে শুরু করেছে। ‘ফাদার ডে’ আর ‘মাদার ডে’ পালন করে পরিবার ও পারিবারিক জীবনে সুখ আসবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না পরিবার ও পারিবারিক জীবনে সুন্নাতে নববী (সা.)-এর পূর্ণাঙ্গ অনুশাসন আমরা মেনে চলব। আমাদের ছেলে-মেয়েদেরকে পরিবার থেকেই সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা, সত্যবাদিতা, পরস্পরে শ্রদ্ধাবোধ, আদব-কায়দা তথা ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন