:’এক্সকিউজ মি! এটা মৌ’দের বাসা না?’
:’জ্বী জ্বী বাড়িওয়ালীর মেয়ের কথা বলছেন তো?’
:’হুমম’
:’এইতো একটু ডানে গিয়ে সোজা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় বাঁ-দিকের রুমে চলে যান।’
:’থ্যাঙ্কয়ু...!’
পরিচয়ের শুরুটা এভাবেই। একটু বাঁকা মিষ্টি হাসি দিয়ে সুবাস ছড়িয়ে হনহন করে চলে যায় মেয়েটি। হা করে আমি রাজ্যের মুগ্ধতা নিয়ে তার গমনপথের দিকে চেয়ে থাকি। লিলি’র সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়টা হয় ফুড়ুত করে। ব্যস প্রথম দর্শনেই ‘ফার্স্ট সাইড লাভে’র ফাঁদে পড়ে যাই। মৌ আর লিলি একিসঙ্গে পড়ে। ইডেনের ছাত্রী। কলেজে নতুন এসে ভর্তি হয়েছে। কিছুদিন হলো লিলি’রা সাতক্ষীরা থেকে ঢাকা আসে। বাবা সরকারি চাকুরীজীবী। এসব মৌ থেকে প্রাপ্ত খবর। অল্প কিছুদিনের মধ্যে মৌ’দের বাসায় লিলি’র যাতায়াত বৃদ্ধি পেতে থাকে। আসা-যাওয়ার পথে আমাদের মধ্যেও কখনো কখনো টুকটাক হাই হ্যালো, হাসি ও মুগ্ধতা বিনিময় হতে থাকে। একসময় সেটা বাড়তে বাড়তে গড়িয়ে যায় আরও কিছুদূর। পদ্মা-মেঘনায় অনেক জল গড়ায়, সময়ও এগিয়ে যায় অনেক।
ঘড়ির কাঁটা রাত ৯টা ছুঁই ছুঁই। কাজের চাপে ত্রাহি অবস্থা। অফিসের জরুরি একখান ফাইল নিয়ে ব্যস্ত আছি। রাতের মধ্যে দেখে শেষ করতে হবে। বসের নির্দেশনা এমনি। ইদানিং টুকটাক বিষয়ের দিকে নজর দেওয়ার মওকা পাই না। নিজের শরীরের প্রতিও নয়। এই ছন্নছাড়া জীবনে কী-বা হবে! যে দেখতো সেতো হারিয়ে গেছে আমার জীবন থেকে। দূরে বহুদূরে। বারকয়েক চেষ্টা করেও ফাইলে মন বসাতে পারছি না। বার বার চোখ আটকে যাচ্ছে দেয়াল ঘড়ির দিকে। এখনি ধ্যানে মগ্ন হতে হবে। মাত্র আধা ঘণ্টার ধ্যান। ৯টা থেকে সাড়ে ৯টা। দু›হাতের পিঠের ওপর থুতনি রেখে চোখ বন্ধ করে একনাগাড়ে বসে বসে লিলিকে ভাবতে হবে। এ সময়টা একান্ত আমার আর লিলির। আর কারও নয়। সারাদিনের পর রাতের এ সময়টুকু আমরা একে অপরকে দিই। একই সময়ে দুজন-দুজনকে নিয়ে ভাবতে বসি। দূরত্বের দিক থেকে যে যেখানে যতদূর থাকি, মনের দিক থেকে তখন এ সময়টুকু আমরা খুব কাছাকাছি থাকি। প্রায় দু’মাস হতে চলল লিলি›র কোনো খোঁজখবর নেই। তবুও এ সময়টুকু লিলি আমার কাছেই থাকে। অশরীরীভাবে। ওর অস্তিত্ব আমি বেশ বুঝতে পারি। রাগ অভিমানও। ঘরজুড়ে ওর হাসি শুনতে পাই। হাঁটার শব্দ শুনতে পাই। শ্বাস-প্রশ্বাস উঠা-নামার মৃদু শব্দও শুনতে পাই। আরো কত কী। চোখের আড়াল হলে কী মনের আড়াল হওয়া যায়! আচ্ছা, লিলি এখন কোথায়? ও কী আমাকে নিয়ে ভাবছে? ছি (!) আমি এসব কী ভাবছি? আমাদের মধ্যে তো এমনই কথা ছিল! এসব ভাবনা চিন্তা নিয়ে ওর কখনো ভুল হয়নি। হতে পারেনা। লিলি ভুল করার মেয়ে নয়। ও ভিন্ন ধাতুতে গড়া। রাতের ওই আধঘন্টা সময়টুকু ধ্যান করার বিচিত্র আইডিয়াটুকু ওই তো প্রথম আমাকে দিয়েছিল। এটা এক আশ্চর্য ঘোরলাগা ফিলিংস! ভালোবাসা এমনি!! খুব দূরে থেকেও কাছে থাকার অনুভূতি জাগায়। দেহমনে হিলোল তোলে।
আজ শনিবার। অফিস নেই। কাজে থাকতে পারলে ভালো। যদিও একসময় উল্টো মনে হতো। লিলিকে হারানোর পর থেকে রাতের ওই সময়টুকু ছাড়া ভাবনা-চিন্তায় আমার অনেক পরিবর্তন এসেছে। ফার্মগেট পার্কে আজ প্রতিদিনের তুলনায় লোকজন অনেকটা কম। দুই-চারজন। এদের কেউ লিলি না। প্রতিদিন এখানে অফিস থেকে আসার পথে একটু খোঁজ-খবর নিই। আজও একটু আগে-ভাগে চলে আসি। আশা যদি লিলিকে পেয়ে যাই। তাকে ভালোবাসার কথা প্রথম এখানে বলেছিলাম। টানা টানা হরিণীর চোখ, দীঘল কালো খোলা চুল আর হলুদ শাড়িতে সেদিন তাকে অপুর্ব লাগছিল। সাদামাটা হালকা সাজেই লিলিকে অপুর্ব লাগে। বাঁকা চাহনি আর খিলখিল হাসি হৃদয় হরণ করার মতো। সহজ-সরল টাইপের মেয়ে ও। ইন্দিরা রোডে ওদের বাসা। বাবা সরকারি কর্মকর্তা। ঘনঘন বদলির চাকরি। গত দু-মাসে ছয় ছয়বার ওদের বাসার কড়া নেড়েছি। নতুন ভাড়াটিয়া উঠেছে। কেউ কোনো খোঁজ দিতে পারেনি। মৌও না। লিলি›র সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগের ব্যর্থ চেষ্টা করেছি। যোগাযোগ করতে পারিনি। সুইচ অফ। এ জীবনে কী আর লিলিকে পাবো না? আমিই প্রথম প্রপোজ করি লিলিকে। হাঁটু গেড়ে ডান হাতে একখান লাল টুকটুকে গোলাপ বাড়িয়ে বলেছিলাম, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমাকে এক ফোটা জল দাও প্লীজ, নিজেকে একটু সিক্ত করি।’ ‹ভালোবাসি› কথাটা শুনে ও যেন মুহূর্তে আকাশ থেকে পড়ল! অস্ফুটস্বরে বলল, ‘এক ফোটা জল! ওম্মা এটা আবার কী!’ তারপর শুরু হয় হাসি। হাসি আর থামে না। ‹ভালোবাসা’ শব্দটি যেন লিলি এই জীবনে আর শুনেনি! আজই প্রথম শুনল। সহজ-সারল্যে ভরা মুখে লিলি›র অদ্ভুত প্রতিক্রিয়াও তাই বলে। লাজ রাঙা চোখে গালে টোল পড়াটাও ছিল মনে রাখার মতো। কথাটা আজও আমার কানে ভেসে আসে। রাস্তা চলার পথে কোন তরুণীর মুখে ‘ওম্মা’ কথাটা শুনলে আমার দৃষ্টি আটকে যায়। কে ওখানে? লিলি নয়তো?
অশরীরী লিলি আমার সঙ্গেই থাকে। তার এক ফোটা জলে প্রতিনিয়ত সিক্ত হই আমি। নিরন্তর খুঁজে ফিরি রক্ত-মাংসের শরীরী লিলিকে। ওই তো লিলি, দেখতে পাচ্ছি ওকে। হাতের একদম নাগালে। আমার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। বাতাসে ওর ভুবনজয়ী হাসি শোনা যাচ্ছে। অনেক দূর পর্যন্ত ভেসে ভেসে যাচ্ছে তার হাসি। ঝর্ণার মতো। খিল খিল শব্দ করে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন