এবি সিদ্দিক
কিছুদিন আগে কমানো হলো জ্বালানি তেলের দাম। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম কমলো লিটার প্রতি ৩ টাকা আর অকটেন আর পেট্রোলের দাম কমানো হলো লিটার প্রতি ১০ টাকা। যারা ধনী ব্যক্তি, নিজেস্ব গাড়িতে চলেন আর বিমানে ভ্রমণ করণে তারা সুফল পাবেন অকটেন আর পেট্রোলের দাম কমানোয়। আর দিনমজুর, কৃষক, শ্রমিক আর খেটে খাওয়া শতকরা ৮৫ জনের জন্য হলো কেরোসিন আর ডিজেল। ৩ টাকা করে কমানোর ফলে শতকরা ৮৩ জন কোনো সুফল পাবে না। সরকারেরও তেমন কোনো লোকসান হবে না। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের হিসাব মতে, দেশে বর্তমানে জ্বালানি তেলে ব্যবহার প্রায় ৪৫ হাজার টন। এর মধ্যে কেরোসিন আর ডিজেল ব্যবহার হয় প্রায় ৩৮ হাজার টন। প্রাথমিক হিসাবে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর ফলে সরকারের প্রায় ১৮শ থেকে ২ হাজার কোটি টাকা আয় কমে যাবে। যদিও সরকার প্রতি মাসে এখাতে বর্তমানে প্রায় আড়াই হাজার টাকা মুনাফা করছে। অপরদিকে গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গ্যাসের দাম বাড়িয়ে জ্বালানি তেলের ক্ষতিটুকু পুষিয়ে নেয়া হবে। গ্যাসের দাম বাড়িয়ে সেই ৮৫ জনের জীবনের আরেক দফা দুর্ভোগ নামিয়ে আনা হবে। বাড়বে পরিবহন ভাড়াও। গ্যাসের দাম ৬৬ থেকে ১৪০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর সুপারিশ করেছে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো। ১ জুলাই থেকেই বাড়তি দাম কার্যকরের দাবি জানিয়েছে কোম্পানিগুলো। অপরদিকে বিদেশি কোম্পানি কনোকোকে পিএসসি করার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। প্রস্তাবে আবাসিক গ্যাসের দুই চুলার জন্য ৬৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার ২০০ টাকা এবং এক চুলার জন্য ৬০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার টাকা করার কথা বলা হয়েছে। যানবাহনের সঙ্কুচিত প্রাকৃতিক গ্যাস (সিএনজি) দাম প্রতি ঘনমিটারের ৩৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৮ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আবাসিক মিটারে প্রতি ঘনমিটার সাত টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৬ টাকা ৮০ পয়সা, শিল্প কারখানার নিজস্ব (ক্যাপটিভ) বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতি ঘনমিটার আট টাকা ৩৬ পয়সা থেকে ১৯ টাকা ২৬ পয়সা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুই টাকা ৮২ পয়সা থেকে চার টাকা ৬০ পয়সা, কারখানার বয়লারের জন্য ছয় টাকা ৭৪ পয়সা থেকে ১০ টাকা ৪৫ পয়সা, বাণিজ্যিক গ্রাহকদের ১১ টাকা ৩৬ পয়সা থেকে ১৯ টাকা ৫০ পয়সা এবং সার কারখানার জন্য দুই টাকা ৮২ পয়সা থেকে চার টাকা ৪১ পয়সা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এর আগে ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে গড়ে ২৬ দশমিক ২৯ শতাংশ গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছিল।
এদিকে পেট্রোবাংলার অধীনস্থ গ্যাস কোম্পানিগুলো মুনাফাতেই চলছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) কোম্পানিগুলো পরিচালনা মুনাফা করে ১ হাজার ১৬৭ কোটি ২০ লাখ ৮২ হাজার টাকা, বিবিধ আয় করে ১ হাজার ৫ কোটি ২০ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা, আয়করপূর্ব মুনাফা করে ২ হাজার ১৭২ কোটি ৫০ লাখ ২৭ হাজার টাকা, করঅন্তে নিট মুনাফা করে ১ হাজার ৫৫৪ কোটি ৯০ লাখ ৪৬ হাজার টাকা আর রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয় ২ হাজার ৯১৪ কোটি ৬০ লাখ ৪৪ হাজার টাকা (সূত্র : পেট্রোবাংলা)। এই গেল গ্যাসে মুনাফার চিত্র। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলে দাম কমায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ২০১৪-১৫ অর্থবছরের ৪ মাসে (জুলাই-অক্টোবর) নিট মুনাফা করে ৫ হাজার ২৬৮ কোটি ৮ লাখ টাকা আর একই সময়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয় ৫ হাজার ৪৪৮ কোটি ৬১ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরে বিপিসির নিট মুনাফার লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৭ হাজার কোটি টাকা। এখানে উল্লেখ্য, ১৯৭৬-৭৭ থেকে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের অক্টোবর মাস পর্যন্ত বিপিসির নিট লোকসান ৪৫ হাজার ৯৪৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা দেখানো হয়। পাশাপাশি সরকারের কোষাগারে যায় ৬৯ হাজার ৬০২ কোটি ২৪ লাখ টাকা। মূলত জ্বালানিতে সরকারের কোন ভর্তুকি নেই। বিদ্যুতেও সরকারের ভর্তুকি নেই। গ্যাস-বিদ্যুৎ-জ্বালানি তেলের মুনাফার একটি চিত্র হলো এমন- বর্তমানে প্রতি লিটার অকটেন উৎপাদন খরচ কমে দাঁড়িয়েছে ৫০ টাকারও কম আর পেট্রোলের উৎপাদন খরচ পড়ছে ৪০ টাকার মতো। অথচ দেশে এক লিটার অকটেনের দাম কিছুদিন আগে নেয়া হয়েছে ৯৯ টাকা এবং পেট্রোলের দাম ৯০ টাকা। তার মানে, এই দুটো পণ্যে ১০০ শতাংশের বেশি মুনাফা করেছে পেট্রোলিয়াম করপোরেশন। তেল ডিজেলের লিটার প্রতি আমদানি খরচ পড়েছে ৪০ টাকার কম। অথচ এক লিটার ডিজেল বিক্রি করা হয়েছে ৬৮ টাকায়। এ ক্ষেত্রে মুনাফার হার ৭০ শতাংশ। ফার্নেস অয়েলের ক্রয়মূল্য পড়েছে ২৫ টাকা। বিক্রয়মূল্য ৬২ টাকা। এ ক্ষেত্রে মুনাফা করা হচ্ছে ১৪৮ শতাংশ। যদিও বর্তমানে কিছুটা দাম কমলো। ১১টি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কোম্পানিকে এখন সরাসরি জ্বালানি তেল আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে। অতএব, তাদের প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ এখন ছয় টাকার নিচে নেমে এসেছে। অথচ পিডিবি বিদ্যুতের গড় বিক্রয়মূল্য পাচ্ছে ছয় টাকার বেশি। তাহলে তাদের লোকসান হচ্ছে কীভাবে? আর সরকারি ভর্তুকি লাগছে কোথায়? এমতাবস্থায় দাম বাড়ানোর আবদারের কী যুক্তি? সামিট পাওয়ারের জনৈক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও ব্যাপারটা স্বীকার করেছেন। (যেসব রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট এ সুবিধা পায়নি, তারা সরকারি দাম ৬২ টাকায় এক লিটার ফার্নেস অয়েল কিনছে অথবা ৬৮ টাকায় ডিজেল কিনছে এবং তাদের খরচ পড়ছে ইউনিট প্রতি ১৫ থেকে ২০ টাকা। ওই দামে সরকার বিদ্যুৎ কিনছে তাদের কাছ থেকে, ভর্তুকি দিয়েছে ইউনিট প্রতি ৯ থেকে ১৪ টাকা। পিডিবিকে লোকসানের অজুহাতে ভর্তুকি প্রদানের এই তেলেসমাতি কার স্বার্থে? ফার্নেস অয়েলের দাম কমলে জনগণের কোন লাভ নেই। এই তেল বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার হয়। এতে বরং বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সম্প্রতি এক মূল্যায়নে বলেছে, জ্বালানি তেলের দাম ১০ শতাংশ কমানো হলে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বাড়বে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ। তৈরি পোশাক রপ্তানি আর ভোক্তা চাহিদাও বাড়বে যথাক্রমে শূন্য দশমিক ৪ এবং শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি আর সরকারের সঞ্চয় কমবে যথাক্রমে শূন্য দশমিক ২ এবং শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। এই বক্তব্যকেও গুরুত্ব দিতে হয়। এ প্রসঙ্গে একজন ব্যবসায়ী নেতা বলেছেন, ‘লিটারপ্রতি ডিজেলে ১০ ও অকটেনে ২০ টাকা কমানো হলে সরকারের মুনাফা খুব বেশি কমবে না। তবে আমরা ব্যবসায়ীরা একটু নিশ্বাস ফেলার সুযোগ পাব। সরকার প্রতি লিটার অকটেনে মুনাফা করছে প্রায় ৪০ টাকা। আর কেরোসিন, ডিজেল ও ফার্নেস তেলে ১৫ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত। সিপিডি অবশ্য সম্পূর্ণ জ্বালানি তেলের দামই গড়ে ১০ শতাংশ কমানোর পক্ষে। আর এর পাশাপাশি সমন্বয় চায় গ্যাস ও বিদ্যুতের দামে। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, উৎপাদন পর্যায়ে বড় একটি অংশই ব্যয় হয় এই জ্বালানি খাতে। এসব কথা খুবই যৌক্তিক এবং সময়োপযোগী, সন্দেহ নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে এতটা পড়তির পর দেশে জ্বালানি তেলের দাম এভাবে ধরে রাখার যৌক্তিকতা সম্পর্কে অবশ্যই প্রশ্ন তোলা যায়। এর মধ্যে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, যেসব দেশ তেল বিক্রয়লব্ধ আয়ের ওপর প্রধানত নির্ভর করে, তারা ঘাটতি মেটাতে আরও অধিক উৎপাদনে যাচ্ছে। ফলে আরও কমতে পারে এর দাম।
লেখক : সাংবাদিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন