বরিশালের চরবাড়িয়ায় কীর্তনখোলা ও শরিয়তপুরের নড়িয়াতে পদ্মার ভয়াবহ ভাঙন রোধে আসন্ন বর্ষার আগেই টেকসই প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলছে নৌ বাহিনী। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নকশা ও তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ নৌবাহিনী এদুটি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় প্রায় ১৩শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাঙন প্রতিরোধ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। এলক্ষ্যে ইতোমধ্যে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে এদুটি নদী তীরে। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশ ‘ডিপার্টমেন্টাল প্রকিউরমেন্ট মেথড-ডিপিএম’এর ভিত্তিতে শরিয়তপুরের নড়িয়া-সুরেশ্বর এলাকার ভাঙন রোধে প্রায় ১ হাজার ৭৭ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে নৌ বাহিনীর অধিভূক্ত প্রতিষ্ঠান খুলনা শিপইয়ার্ড। একইভাবে বরিশাল মহানগরী সংলগ্ন চরবাড়িয়াতে কীর্তনখোলা নদীর ভাঙন রোধেও প্রায় সোয়া ২শ’ কোটি টাকার প্রতিরোধ কার্যক্রম করছে প্রতিষ্ঠানটি। পানি সম্পদ মন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামিম ও উপমন্ত্রী এনামুল হক শামিম এদুটি প্রকল্পের বিষয়ে নিবিড় তদারকি করছেন। দায়িত্ব লাভের পরে প্রতিমন্ত্রী এবং উপমন্ত্রী ভাঙন কবলিত দুটি এলাকাই একাধিকবার পরিদর্শন করে সরেজমিনে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা প্রদান করছেন। গতকালও পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ে এবিষয়ে নৌবাহিনী ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের নিয়ে পর্যালোচনা বৈঠক করেছেন।
গতবছর জানুয়ারীর প্রথমভাগে শরিয়তপুরের নড়িয়া-জাজিরা এলাকায় ভয়াবহ নদী ভাঙন রোধে ১ হাজার ৯৭ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষ একটি প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি-একনেক-এর অনুমোদন লাভ করে। শরিয়তপুরে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পটির আওতায় নড়িয়া ও জাজিরা উপজেলার ঠাকুর বাজার, বাঁশতলা, কুন্ডেরচর সংলগ্ন প্রায় ৯ কিলোমিটার এলাকায় জিওব্যাগ ও সিসি ব্লক দিয়ে পদ্মার স্রোত থেকে ভাঙন রোধ সহ নদী তীর রক্ষা এবং একই উদ্দেশ্যে আরো পৌনে ১০ কিলোমিটার এলাকায় ড্রেজিং করে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের বিষয়ও অন্তর্ভূক্ত রয়েছে।
তবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এখনো এ প্রকল্পটির সুষ্ঠু বাস্তবায়ন কিছুটা পেছনে রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ‘নড়িয়া-সুরেশ্বর এলাকার ভাঙন রোধ প্রকল্প’টি একনেক’এর অনুমোদন লাভ করে গত বছর জানুয়ারী মাসের প্রথমভাগে। কিন্তু বিগত বর্ষা মৌসুমের আগে ভাঙন রোধে ন্যূনতম কোন কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড। ফলে বিগত বর্ষার শেষভাগে এসে প্রমত্তা পদ্মা ফুসে উঠে শরিয়তপুরের নড়িয়া ও জাজিরার বিশাল এলাকাকে গ্রাস করে। এর প্রেক্ষিতে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় কিছুটা নড়েচড়ে বসে। তরিঘড়ি করে প্রকল্প প্রস্তাবনাটি মন্ত্রী পরিষদের ক্রয় সংক্রান্ত কমিটিতে পাঠানো হয়। একনেক-এর অনুমোদনের সাড়ে নয় মাস পরে গত ১৯ সেপ্টেম্বর এ সংক্রান্ত প্রস্তাবনা ক্রয় কমিটির অনুমোদন লাভ করে। এরও একমাস ১০ দিন পরে গত ২৯ অক্টোবর নৌ বাহিনীর প্রতিষ্ঠান খুলনা শিপইয়ার্ডের সাথে পানি উন্নয়ন বোর্ডের এ সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করে। গত ৮ ডিসেম্বর পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব শরিয়তপুরের ভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করে জিওব্যাগ ফেলার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ভাঙন প্রতিরোধ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন।
তবে ভাঙন প্রতিরোধে মধ্য পদ্মায় জেগে ওঠা চর অপসারনে ড্রেজিং-এর পরিপূর্ণ নকশা খুলনা শিপইয়ার্ডকে হস্তান্তর করা হয়েছে গত ১০মার্চ। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট দীর্ঘদিন ধরে সরেজমিনে ও ভাঙন কবলিত এলাকার মডেল পর্যলোচনার মাধ্যম এ একটি নকশা প্রনয়ন করেছে। ইতোমধ্যে প্রকল্প এলাকায় প্রতিরক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে জিও ব্যাগ ডাম্পিং সহ ব্লক প্রস্তুত কার্যক্রম পুরোদমে এগিয়ে চলছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নকশা অনুযায়ী ভাঙন কবলিত ৮.৯ কিলোমিটার এলাকায় ৪০ লাখ ১০ হাজার জিও ব্যাগ ফেলতে হবে। গতকাল পর্যন্ত প্রায় ১৪ লাখ ব্যাগ প্রস্তুত করে বেশীরভাগই ভাঙন কবলিত এলাকায় ফেলা সম্ভব হয়েছে বলে জানা গেছে। বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ২৫ হাজার জিও ব্যাগ প্রস্তুত ও ফেলা হচ্ছে। আগামী ৩০ জুনের মধ্যে ২৮ লাখ ব্যাগ ফেলার লক্ষ্য স্থির থাকলেও ঐ সময়ের মধ্যে সমুদয় জিও ব্যাগ ভাঙন কবলিত এলাকায় ফেলার জন্য প্রস্তুত করবে খুলনা শিপইয়ার্ড।
ভাঙন কবলিত ৮.৯ কিলোমিটার এলাকায় জিও ব্যাগের ওপর প্রায় ৩২ লাখ ৪৭ হাজার বিভিন্ন মাপের সিসি ব্লক ফেলা হবে। ইতোমধ্যেই প্রায় ৫০ হাজার ব্লক তৈরীর কাজ শেষ হয়েছে। বর্তমানে গড়ে ৬ হাজার ব্লক তৈরী হলেও প্রয়োজনীয় জমির অভাবে নতুনকরে ব্লক তৈরী কিছুটা পিছিয়ে পড়ার আশংকার কথা জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দায়িত্বশীল মহল। তবে ‘শের আলী মাতুব্বর’ এলাকায় একটি নতুন জমি প্রস্তুত করা হচ্ছে ব্লক তৈরীর জন্য। আগামী ৩০ জুনের মধ্যে ৬ লাখ ব্লক তৈরীর লক্ষ্য স্থির রয়েছে। খুব দ্রুত জমি পাওয়া গেলে এলক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন খুলনা শিপইয়র্ডের প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগন।
২০২১-এর ৩০ এপ্রিলের মধ্যে শরিয়তপুরের ভাঙন প্রতিরোধ প্রকল্পটির বাস্তবায়ন সম্পন্ন করার কথা রয়েছে। সে আলোকে ২০২০-এর জুনের মধ্যে ভাঙন কবলিত এলাকায় ২৩ লাখ ২৭ হাজার ও ২০২১-এর জুনের মধ্যে সর্বমোট ৩২ লাখ ৪৭ হাজার ব্লক ফেলার কাজ শেষ করতে হবে।
এদিকে শরিয়তপুরের নড়িয়া এলাকায় পদ্মার মধ্যভাগে বিশাল চর জেগে ওঠায় প্রায় ৩ কোটি ৩৩ লাখ ২৩ হাজার ঘন মিটার পলি অপসারন করে নদীর গতিপথ পরিবর্তন করতে হচ্ছে। নদী গবেষনা ইনস্টিটিউট প্রণীত নকশানুযায়ী ড্রেজিং কার্যক্রম ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। তবে অপসারন করা পলি ফেলার স্থান সংকটে ড্রেজিং কার্যক্রম কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। খুলনা শিপইয়ার্ড ইতোমধ্যে দুটি ড্রেজারের সাহায্যে মধ্যভাগের ডুবো চর অপসারন কার্যক্রম শুরু করেছে। গত ২৯ মার্চ পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী এ ড্রেজিং কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছেন। আগামী ৩০ জুনের মধ্যে ৬০ লাখ ঘন মিটার পলি অপসারনের লক্ষ্য স্থির রয়েছে এখানে। সে লক্ষ্যে আরো ১টি বড় ড্রেজার চলতি সপ্তাহে প্রকল্প এলাকায় নিয়োজিত করা হচ্ছে। আগামী বছরের ৩০ জুনের মধ্যে মোট ২ কোটি ৬০ লাখ ঘন মিটার ও ২০২১-এর এপ্রিলের মধ্যে ৩ কোটি ৩৩ লাখ ২৩ হাজার ঘন মিটার ড্রেজিং সম্পন্ন করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়েছেন খুলনা শিপইয়ার্ডের দায়িত্বশীল মহল।
এদিকে বরিশালে ভাঙন কবলিত ৩.৩৬ কিলোমিটার এলাকায় প্রায় ২১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১২ লাখ ২১ হাজার সিসি ব্লক এবং ৪ লাখ ৭৫ হাজার জিওব্যাগ ফেলতে হচ্ছে। প্রকল্পটি অনুমোদনের প্রায় ১৬ মাস পরে খুলনা শিপইয়ার্ডের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ইতোমধ্যে ভাঙন কবলিত এলাকায় ২০ হাজার জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যে জিওব্যাগ ফেলার কাজ শেষ করে আগামী বছরের শুরু থেকে সিসি ব্লক তৈরী ও তা ডাম্পিং-এর কাজ শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে। ইতোমধ্যে ব্লক তৈরীর সব পদক্ষেপও গ্রহন করা হয়েছে। জিও ব্যাগ প্রস্তুত ও নদীতে ফেলার কাজে গতি আনতে আরো দুটি বর্জ ভাঙন কবলিত এলাকায় নিয়োজিত করা হচ্ছে। এখানে কীর্তনখোলার পূর্ব প্রান্তে ৪১ লাখ কিউবিক মিটার ড্রেজিং করে পলি অপসারনের মাধ্যমে নদীর গতিপথ পরিবর্তন করতে হবে। ইতোমধ্যে ৬২ হাজার ঘন মিটার পলি অপসারন কাজ শেষ হয়ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন