সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

নির্বাচনের নামে প্রহসন বন্ধ হোক

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ৬ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

বেশ কিছু দিন ধরে দেশে অগ্নিকান্ডে ক্ষয়ক্ষতি আর অপঘাতে মৃত্যু প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অগ্নি নিরাপত্তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কিছুটা বিলম্বে হলেও একগুচ্ছ দিকনির্দেশনা দিতে বাধ্য হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এ পদক্ষেপের জন্য তাকে আমরা ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তবে প্রধানমন্ত্রীর সকল কাজের জন্য আমরা তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে পারছি না বলে দুঃখিত। বিশেষ করে দেশে গণতন্ত্র সুরক্ষা করার ক্ষেত্রে তার সরকারের যেসব পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ ছিল তা না নেয়ায় জনগণ হতাশ।
স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর যে চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ঘোষণা করা হয়, তার মধ্যে গণতন্ত্র ছিল সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ। এর বড় প্রমাণ গণতন্ত্র অপরিবর্তীত রয়েছে। অপর তিনটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা সময়ে পরিবর্তন ও সংশোধন করা হলেও কোনো সরকারই গণতন্ত্রের গায়ে আচড় কাটতে সাহস করেনি; গণতন্ত্রের প্রতি জনগণের অকুণ্ঠ ও ব্যাপক সমর্থনের কারণে। অথচ দুঃখের বিষয় এই যে, এই গণতন্ত্রকেই বাংলাদেশে সর্বাধিক অপব্যবহারের শিকার হতে হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম সরকারের আমলে গণতন্ত্রের টুটি চেপে ধরে সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একটি মাত্র সরকাফর দল রেখে দেশে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা করা হয়।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে পাকিস্তান আমলে সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের অতিরিক্ত ক্ষমতাক্ষুধার কারণে দেশে কখনও গণতন্ত্র জোরদার হতে পারেনি, একারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে গণতন্ত্র বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছিল। স্বাধীনতা লাভের পর গণতন্ত্র অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করা জনগণের আশা বেড়ে গিয়েছিল অনেক। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে জনগণ কী দেখলো?
জনগণ দেখলো প্রথম সরকারের আগেই গণতন্ত্রের টুটি চেপে ধরে সমগ্র রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একটি মাত্র সরকারি দল রেখে দেশে একদলীয় বাকশালী শাসন কায়েম করা হয়। যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা জীবন ধরে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করে এসেছেন তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে একদলীয় বাকশালী ব্যবস্থা কায়েমের স্বপক্ষে তিনি নিজে কিছু না বললেও বাকশালী ব্যবস্থার অন্যতম সমর্থক কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মনি সিং এ সম্পর্কে যে সাফাই গেয়েছেন সেটা বিবেচনার আনলে এ ব্যাপারে একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, বাকশাল কোনো একাংক নাটক নয়, বাকশাল নামের বহু অংক নাটকের শেষ অংশের শেষ দৃশ্য না আসা পর্যন্ত এ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করা উচিৎ হবে না। বাকশাল সম্বন্ধে মনি সিংয়ের এ বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, তিনি সম্ভবত বাকশালের সমর্থক সেজে দেশে গণতন্ত্রের টুটি চেপে ধরে চূড়ান্ত পর্যায়ে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু এ জন্য ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়ে প্রাণ দিতে হয়েছিল গণতন্ত্রের লড়াকু সৈনিক বঙ্গবন্ধুকে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের মনে থাকার কথা, বহু দলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবার পর একটি নির্বাচিত সরকারকে সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কবজা করে বসেন বাংলাদেশের তদানীন্তন জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সে সময় সারা দুনিয়াকে অবাক করে দিয়ে ঐ সামরিক ক্যুর প্রতি সমর্থন জানিয়ে বসেন বাংলাদেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগ।
এর সম্ভাব্য কারণ হয়ত এটা ছিল যে, সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত হওয়া ঐ নির্বাচিত সরকারের নেতৃত্বে ছিল নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি। এর পর শুরু হয় জেনারেল এরশাদের সুদীর্ঘ স্বৈরশাসনের পালা। পাশাপাশি শুরু হয় বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের স্বৈরাচারী এরশাদ-বিরোধী আন্দোলন। এভাবে জেনারেল এরশাদের স্বৈরশাসন বিরোধী সংগ্রামে নেতৃত্ব দানের মাধ্যমে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আপোসহীন নেত্রী হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
এদিকে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা প্রথম দিকে বেশ কিছু দিন এসব আন্দোলন থেকে দূরে সরে থাকলেও এরশাদ বিরোধী আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠলে এক পর্যায়ে তিনিও এ আন্দোলনে যোগ দেন। এর এক পর্যায়ে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনাবিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া দেশে একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রশ্নে একমত হন। নির্বাচন যাতে সম্পূর্ণ অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়, সে লক্ষ্যে দুই নেত্রী একমত হন যে, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে।
যেমনটা আশা করা গিয়েছিল তেমনি নির্বাচন অত্যন্ত অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছিল। নির্বাচন চলাকালে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতাকালে এক পর্যায়ে বলেন, আমি সকল জেলার খবর নিয়েছি। নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। আপনারা লক্ষ রাখবেন, ভোটে হেরে গিয়ে কেউ যেন এর মধ্যে কারচুপি আবিষ্কার না করেন। ভোট গণনা শেষে যখন দেখা গেল, আওয়ামী লীগ নয়, জয়ী হয়েছে বিএনপি। তখন শেখ হাসিনা অবলীলাক্রমে বলে ফেললেন, নির্বাচনে সূ² কারচুপি হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কেউ তাঁর এই স্ববিরোধী বক্তব্যে গুরুত্ব না দিয়ে স্বাভাবিকভাবে যা করণীয় তাই করলেন। ফলে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া হলেন প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী হলেন আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা। বেগম খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদ শেষ হয়ে এলে প্রধানত বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার দাবির মুখেই সিদ্ধান্ত হয় নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে দেশের সকল জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
বাংলাদেশের বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই ব্যবস্থাই যে গণতন্ত্রের জন্য অধিকতর প্রজোয্য তা বাস্তবেও প্রমাণিত হয়। এই ব্যবস্থাধীনে দেশে বেশ কয়েকটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং তার ফলে দেশের দুই প্রধান দল পর পর দেশ পরিচালনার সুযোগ লাভ করে। এর মধ্যে এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেত্রীর প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে সংবিধান সংশোধন করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে বিএনপি নির্বাচন বয়কট করে। দেশের অন্যতম প্রধান দলের নির্বাচন বর্জন বাস্তবে পরিণত হয়ে পড়ে একটি নির্বাচনী প্রহসনে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা তো দূরের কথা, সরকারি দলের অনেক নেতাকর্মীও সে নির্বাচন ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার গরজ অনুভব করেনি। কারণ তারা জানতেন তারা ভোট কেন্দ্রে না গেলেও তাদের ভোট দানের ব্যবস্থা দলের পক্ষ থেকে করা হবে।
বাস্তবে হয়ও সেটাই। বিরোধী দলের বয়কটের সুযোগে শাসক দলের অল্পসংখ্যক নেতাকর্মীই ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত থেকে ইচ্ছা মতো দলীয় প্রার্থীর ব্যালটপত্রে সিল মেরে সরকার দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে প্রদত্ত ভোট অকল্পনীয়ভাবে অধিক সংখ্যায় দেখানোর সুযোগ গ্রহণ করেন। অথচ ভোট দানের জন্য নির্ধারিত সময়ে অধিকাংশ ভোট কেন্দ্র ছিল ফাঁকা, জনশূন্য। এভাবে সরকারী দলের প্রার্থীরা বিরাট ব্যবধানে বিজয়ী ঘোষিত হন। পরদিন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সরকারী দলের প্রার্থীদের এভাবে বিরাট বিজয়ের সাংবাদের পাশাপাশি ভোট প্রদানের নির্ধারিত সময়ে অধিকাংশ ভোট কেন্দ্রের জনশূন্য, ফাঁকা অবস্থা সচিত্র প্রতিবেদনে প্রকাশিত হলে জনগণের নিকট ব্যাপারটি ফাঁস হয়ে পড়ে। ফলে জনগণ এই নির্বাচনের নাম দেন ভোটারবিহীন নির্বাচন। দেশে এভাবেই বিভিন্ন পর্যায়ে হয় ভোটারবিহীন নির্বাচনের প্রহসন।
সরকারী নেতারা এই ভোটারবিহীন নির্বাচনে যে সামান্যতম লজ্জিত বোধ করেননি তার প্রমাণ জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে। তিনি জাতীয় সংসদে বিরোধী দল সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, বিএনপি নির্বাচন বয়কট করায় এক হিসেবে ভালই হয়েছে। সংসদে তাদের সরকার-বিরোধী আবোল-তাবোল বক্তৃতা শুনতে হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী এ বক্তব্য তাঁর গণতন্ত্রপ্রীতির প্রমাণ বহন করে না।
এই জাতীয় সংসদের ভোটারবিহীন নির্বাচনের দৃষ্টান্ত এখন ছড়িয়ে পড়েছে অন্যান্য সব নির্বাচনে। ফলে দেখা যাচ্ছে, দেশের মানুষ নির্বাচনের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। অথচ বাংলাদেশের মানুষ যে নির্বাচনের প্রতি আস্থাশীল ছিল না, তা নয়। দেশের অনেক বড় বড় নির্বাচন হয়েছে। যেমন পাকিস্তান আমলে ১৯৪৬ সালের নির্বাচন এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচন। ১৯৭০ সালে স্বাধিকার চেতনার পক্ষে এদেশের নির্বাচনের জনগণ ভোর বেলায়ই অন্যান্য কাজ কর্ম ফেলে আসে ভোটের লাইনে দাঁড়ায়। ওটাই ইতিহাস।
বাংলাদেশের এ গৌরবজনক ইতিহাসের বিপরীতে যখন থেকে শাসক দলের মাথায় ভোটারবিহীন নির্বাচনের ভূত ঢুকল, যখন নির্বাচনকে নির্বাচনী প্রহসনে পরিণত করা হল, তখন থেকেই দেশে গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটল। আমরা এখনও জানিনা আমাদের দেশে গণতন্ত্র পুর্নজীবিত হবে কি না।
আজকের এ লেখা শেষ করার আগে নির্বাচন সংক্রান্ত ব্যাপারে বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার যে কথা বলেছেন, তার উল্লেখ করতে চাই। তিনি বলেছেন, জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন সর্বতোভাব কমিশনের হাতে ন্যাস্ত করা প্রয়োজন। তিনি বলেছেন, রিমোট কন্ট্রোলের নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য বিপর্যয়কর। মাহাবুব তালুকদার তার বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে যা বলেছেন তা সরকার গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবে কি?

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন