(পূর্বে প্রকাশিতের পর)
নামাজের পরিক্রমার মাঝে ইসলামের একটি পরিপূর্ণ স্মৃতি হচ্ছে নামাজের সময় নির্ধারণ করা। একথা সুস্পষ্ট যে, দুনিয়ার কোন কাজ সময় এবং কালের সংশ্লিষ্টতা হতে বিমুক্ত হতে পারে না। এ জন্য কোন কাজ সম্পাদনের সময় হতে বেনেয়াজ হওয়া সম্ভব নয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, নামাজের জন্য সময় নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা ছিল কি? মূল ঘটনা হলো এই : রাসূলুল্লাহ (সা:) যে পরিপূর্ণ দ্বীন ও জীবনব্যবস্থা নিয়ে প্রেরিত হয়েছিলেন, এর বড় বৈশিষ্ট্য হলো, তা আমলী বা ব্যবহারিক। শুধু স্মৃতি বা দশ্যপট নয়; তিনি যে নামাজের শিক্ষা দিয়েছেন তা শুধু নিয়মতান্ত্রিকতা ও স্মৃতি স্থাপনের জন্যই নয় : বরং এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, মানুষ প্রত্যহ বিভিন্ন সময়ে এই ফরজকে আদায় করবে। মানুষের মনোবিজ্ঞানভিত্তিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, যে কাজ তাকে সদা-সর্বদা করতে হত যতক্ষণ পর্যন্ত এর জন্য সময় নির্ধারণ করা না হয়, ততক্ষণ সে তা সচেতনতার সাথে ক্রমাগতভাবে আঞ্জাম দিতে পারে না। এজন্য প্রতিটি সুবিন্যস্ত, নিয়মতান্ত্রিক এবং সার্বক্ষণিক কাজের জন্য সময় নির্ধারণ করা একান্ত প্রয়োজন। আর এই তরীকাটি সারা দুনিয়া স্বীয় সুশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিক কাজগুলোর জন্য অবলম্বন করেছে। এর মাঝে মূল রহস্য হলো, যখন মানুষ বুঝতে পারে যে, তাকে কোনও কাজ করার জন্য ২৪ ঘণ্টার অবসর আছে, তবে সে সর্বদাই আলস্য ও দুর্বলতা হেতু এই কাজকে অপর বা অন্য সময়ের দিকে ঠেলে দিতে চাইবে। এমনি করে দিন কেটে যাবে, শেষ লগ্নটিও এসে যাবে, কিন্তুু সে সেই কাজ আঞ্জাম দিতে পারবে না। তবে কাজগুলোর জন্য যদি সময় নির্ধারিত থাকে, তাহলে প্রত্যেক নির্দিষ্ট সময় আগমনের সাথে সাথে সে কাজের কথা তার স্মরণ হবে এবং সে মনে করবে নির্দিষ্ট সময় চলে গেলে অপর একটি কাজ এসে হাজির হয়ে যাবে। এভাবেই সময় নিয়ন্ত্রক ফেরেশতা সব সময় মানুষকে ফরজগুলো স্মরণ করিয়ে দেয়। এমন করেই সকল কাজ নিয়ম-শৃঙ্খলাসহ আঞ্জাম পায়।
নামাজের সময় নির্ধারণের ক্ষেত্রে সে জিনিসটিও লক্ষ্য রাখা দরকার, যার উল্লেখ পূর্বেই করা হয়েছে। অর্থাৎ অংশীবাদহীনতার নিয়ম-কানুন যা ইসলামের মূল পরিচয়। মুসলমান বিভিন্ন শহরে, দেশে মহাদেশে লক্ষ কোটি জনসংখ্যা নিয়ে বসবাস করছে। কিন্তুু বৃহত্তর জনগোষ্ঠী একটি নির্দিষ্টি সময়ে এবং একটি নির্দিষ্ট অবস্থায় এক ও অভিন্ন রূপ ধারণ করে।
নভোমÐলে স্থাপিত কোনও দূরবীক্ষণ যন্ত্র দ্বারা যদি যমীনের প্রতি লক্ষ্য কর তাহলে দেখবে একটি নির্দিষ্ট সময়ে লক্ষ কোটি মানুষ একই অবস্থায় একই আকৃতিতে বিশ্ব¯্রষ্টার সামনে অবনত মস্তকে রয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত উদয় ও অস্তের দিগন্ত পরিষ্কার থাকবে, এই চিত্রের মাঝে কোনই পার্থক্য পরিলক্ষিত হবে না। সর্বত্র একই চিত্র পরিলক্ষিত হবে। বিভিন্ন দেশের উদয়াস্তের পার্থক্য যদিও এই অভিন্ন ও একক চিত্রকে এক সাথে হতে দেয় না। তবুও কমসে কম এই একাকীত্ব তো অবশ্যই আছে যে, যখন যে অবস্থায় একস্থানে সূর্য থাকে, সে অবস্থাটি যখন দ্বিতীয় স্থানে উপনীত হয়, তখন নামাজের অপরিহার্যতা সেখানে উপস্থিত হয় এবং নামাজ আদায় করা হয়। এই একতা ও অভিন্নতা সময় নির্ধারিত না হলে সম্ভব ছিল না। যদি এমনটি না হত তাহলে এই বিশ্বচরাচর কেন, একটি মহল্লা এবং একটি গৃহের মুসলমানও একস্থানে এবং এক অবস্থায় পরিদৃষ্ট হত না।
অন্যান্য ধর্মে নামাযের নির্ধারিত সময় :
এ কারণেই সময় নির্ধারণের এই উপকারিতা ও মুসলেহাতকে অন্যান্য ধর্মেও সমানভাবে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে এবং নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি ও নিয়ম-কানুন মোতাবেক এবাদত সমূহের জন্য সময় নির্ধারিত করেছে। হিন্দুরা সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় পূজা করে। জরদস্তী সম্প্রদায় শুধুমাত্র সূর্যোদয়ের সময় নিজেদের জমজমা পাঠ করে। আর রোমান ক্যাথলিক খৃস্টানরা প্রত্যুষে সূর্যোদয়ের পূর্বে, তারপর সন্ধ্যায়, তারপর রাতে শয়নকালে প্রার্থনা করে, ইহুদীরা তিন ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে, যাকে ‘দিগিল্লা’ বলা হয়। দানিয়াল নবীর কিতাবে আছে, “যখন দানিয়াল জানতে পারলেন যে, লিখিত দলিলের উপর স্বাক্ষর হয়ে গেছে, তখন তিনি গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন এবং বায়তুল মুকাদ্দাসমুখী স্বীয় গৃহের দরজা খুলে দিয়ে দিন ভর তিনবার হাঁটু গেড়ে আল্লাহর সামনে পূর্বে যেভাবে প্রণিপাত করতেন, সেভাবে প্রশংসাসুলভ হামদ ও দোয়া করলেন এভাবে প্রত্যহ তিনবার তিনি এবাদত করতেন (৬-১০ হতে ১৩ পর্যন্ত)। হযরত দাউদ (আ:)-এর কিতাব যাবুরে এই তিন ওয়াক্তের নির্ধারণ এভাবে করা হয়েছে, “সুতরাং আমি আল্লাহকে ডাকব তখন আল্লাহ আমাকে রক্ষা করবেন। সন্ধ্যায়, সকালে এবং দুপুরে আমি ফরিয়াদ করব এবং রোনাজারী করব, সুতরাং তিনি আমার ডাক শুনবেন (৫৫-১৬-১৭)। ইসলামী পরিভাষায় আমরা একে ফজর, জোহর এবং মাগরিবের নামাজ বলতে পারি।
হযরত ঈসা (আ:) দোয়া এবং নামাজের গুরুত্ব আরোও বর্ধিত করেন। লুক সঙ্কলিত ইঞ্জিলে আছে, “তারপর তিনি (হযরত ঈসা আ:) এজন্য যে তাকে সর্বদা দোয়ায় মুগ্ন থাকা এবং অবহেলা না করা আবশ্যক, একটি উদাহরণ পেশ করলেন।” (১৮-১) আর হাওয়ারীদের কর্মকাÐ হতে জানা যায় হযরত ঈসা (আ:)-এর শরীয়তেও নামাজের ঐ সময়ই নির্ধারিত ছিল, যার প্রচলন ইহুদেিদর মাঝেও ছিল। এমন কি তার চেয়ে বেশী ছিল। যোহরের নামাজ তাদের উপরও ছিল। সুতরাং ‘কর্মাবলীকাÐে’ আছে, পিটয়াছ দুপুরের কাছাকাছি সময়ে কুঠিতে দোয়া করতে গেলেন (আমাল ১০-৯)। তাছাড়া আরো কিছু সময় বর্ধিত করা হয়েছিল। অপর এক স্থানে আছে, সুতরাং পিটয়াছ এবং ইউহান্না এক সঙ্গে প্রার্থনার সময় তৃতীয় হায়কালের দিকে গমন করলো (আমাল ৩-১)। গ্রীক ভাষায় তৃতীয় প্রহরের স্থলে নবম ঘড়ির কথা লেখা আছে, যাকে আমরা আসর বলে থাকি। তারপর এ সময়ের নামাজের কথা আমাল ১০-৩০ শ্লোকেও উল্লেখ আছে। একবার হযরত ঈসা (আ:)-এর কোনও শাগরেদ নামাজের খাস দোয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো। তিনি প্রত্যুত্তরে বললেন, “দোয়ার উত্তম সময় হচ্ছে অর্ধ রাত্রি।” এবং এমন হলো যে, তিনি একস্থানে দোয়া করছিলেন। যখন তিনি দোয়া শেষ করলেন, তখন তার শাগরেদদের মাঝে একজন তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, হে প্রভু! আমাদেরকে দোয়া করতে শিক্ষা দিন যেমন হযরত ইউহান্না (হযরত ইয়াহইয়া (আ:) স্বীয় শাগরিদগণকে শিক্ষা দিয়েছেন)। তখন তিনি তাকে লক্ষ্য করে বললেন, যখন তুমি দোয়া করবে, তখন বলবে তোমাদের মাঝে কে আছে, যার এক বন্ধু হবে, অর্ধেক রাতে তার কাছে এসে বলবে, হে বন্ধু! আমাকে তিনটি রুটি ধার দাও! (লুক: ১১) এই উদাহরণেল মাঝে হযরত ঈসা (আ:) রাতের নামাজের শিক্ষা দিয়েছেন। সুতরাং যে রাতে তাঁকে বন্দী করা হয়, তখন তিনি একটি জমায়াতের সাথে এই তাহাজ্জুদ নামাজে নিমগ্ন ছিলেন। (লুক : ২২-৩৯)
ফজরের নামাজের কথাও ইঞ্জিলে আছে। মার্কস-এর সংকলিত বাইবেলের প্রথম অধ্যায়ের ৩৫ তম শ্লোকে আছে, “বড় তারকার উদয়ের পূর্বেই তিনি উঠে গেলেন এবং একটি জনশূণ্য বিরাণ স্থানে গমন করলেন এবং সেখানে দোয়অ করলেন।” ( লন্ডনে মুদ্রিত : ১৮৬৫ইং) বরং এর আরবী তরজমা যা সরাসরি গ্রীক ভাষা হতে অনুদিত (আদবিয়া প্রেস, বৈরুত, ১৮৮৬ ইং এবং অক্সফোর্ড প্রেস ১৮৯০ ইং) এ কথা বুঝা যায় যে, হযরত ঈসা (আ:) সর্বদা এ সময়ে নামাজ আদায় করতেন। সুতরাং এই আয়াতের তরজমা এভাবে করা হয়েছে :
অর্থাৎ অতি প্রত্যুষে উঠে, তিনি একটি শূণ্য ময়দানে চলে যেতেন এবং সেখানে নামাজ পড়তেন। সুতরাং এই সময়গুলোর কথা যা ইহুদী খৃস্টানদের পবিত্র কিতাবসমূহে উল্লেখ আছে, এগুলোকে যদি আমরা একত্র করি তাহলে ইসলামে প্রবর্তিত নামাজের সময় নির্ধারণ হয়ে যাবে। যার মাঝে প্রত্যুষের ফরজ, দ্বিপ্রহরের যোহর, সন্ধ্যার মাগরিব-এর উল্লেখ যাবুরের (৫৫-১৬ ও ১৭) মাঝে, ফজরের উল্লেখ মার্কস : (১-৩৫)-এ, এবং আসরের ‘আমালে’ (৩-১০=৩-৩০); এবং এশা রাতের নামাজের কথা লুক (১১ ও ২৩-৩৯)-এ আছে।
নামাজের জন্য উপযুক্ত প্রাকৃতিক সময় :
আসল কথা হচ্ছে এই যে, মানুষও ফেরেশতাদের মত রাত ও দিনে কেবল দোয়া ও নামাজে নিরত থাকারই কথা ছিল। কিন্তুু মানুষের প্রাকৃতিক ও শ্রেণীভিত্তিক প্রয়োজনসমূহের দরুন এমনটি হওয়া সম্ভব ও উপযোগী ছিলনা। এজন্য শরীয়তে এর পরিপূরণ এভাবে করা হয়েছে যে, এরজন্য কতিপয় উপযুক্ত সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতিটি মানুষ প্রত্যহ বিভিন্ন প্রকার কাজের মাঝে স্বীয় জীবনের চব্বিশটি ঘণ্টা অতিবাহিত করে। সকালে সে জাগ্রত হয়, দ্বি-প্রহর পর্যন্ত কাজ করে সামান্য সময় শ্রান্তি লাঘব করে। তারপর তৃতীয় প্রহর পর্যন্ত সে অবশিষ্ট কাজ আঞ্জাম দেয় এবং এসকল কাজ সমাধা করে ভ্রমণ ও বিচরণ এবং প্রাণপ্রিয় অনুষ্ঠানে নিজের মনকে ব্যাপৃত রাখে। সন্ধ্যা হয়ে গেলে গৃহে প্রত্যাবর্তন করে পারিবারিক জীবন শুরু করে। তারপর পানাহার সমাপ্ত করে সামান্য অবসর নিয়ে দীর্ঘ শান্তি এবং সুখ নিদ্রার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। সুতরাং ইসলামী নামাজসমূহের প্রতি একনজর দেখলে বুঝা যাবে যে, ইসলাম প্রাত্যহিক এসকল বিভিন্নমুখী কর্ম ব্যস্ততার প্রত্যেকটির শুরুতে এক ওয়াক্তের নামাজ স্থিরীকৃত করেছে। যাতে করে সকল সময় আল্লাহর স্মরণের মাঝেই পরিগণিত হতে পারে। আলোর কিরণ বিকাশের সময় যখন প্রভাতের শান্ত সমীরণ ‘হাইয়্যা আলাস, সালাহ’-এর প্রাণস্পশী সূর লহরী বয়ে আনে এবং প্রতিটি বস্তুুর জবান হতে বিশ্ব¯্রষ্টার তাসবীহ ও তাহমীদের স্বর বুলন্দ হতে থাকে সে সময়টি গাফেল মানুষের মাথা অবনত করার জন্যও অধিক উপযোগী হবে। কেননা জীবনের কিতাবে দৈনন্দিন কর্মকাÐের একটি নয়া পাতা সে সময় উন্মোচিত হয়। এজন্য এটাই উপযোগী যে, এদিনের কর্মকাÐের ফলকের উপর সর্বপ্রথম আনুগত্যের সেজদাহর মোহর অঙ্কিত হোক। যার পরে মানুষ স্বীয় মেহনত ও পরিশ্রমের কাজ শুরু করে এবং দ্বিপ্রহর পর্যন্ত একাজে ব্যাপৃত থাকে। দ্বিপ্রহরে দৈনিক কাজের অর্ধাংশ শেষ করে মানুষ সামান্য সময়ের জন্য আরাম করে। এ অবস্থায়ও তাকে আল্লাহর শোকর আদায় করা উচিত। কেননা, দিনের অর্ধেক কাজ সুষ্ঠু ও মঙ্গলজনকভাবে শেষ হয়েছে। তারপর তৃতীয় প্রহরের পর যখন স্বীয় কাজ শেষ করে ভ্রমণ ও বিনোদন এবং ব্যক্তিগত আরামের কাজ শুরু হয়, তখন এ সময়টিও আল্লাহর নাম স্মরণের জন্য। তারপর সন্ধ্যা হয়ে আসলে দুনিয়ার বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দ্বিতীয় দৃশ্য ফুটে উঠে। দিনভর কাজ-কর্মের পর এখন হতে শান্তি ও আরামের প্রবাহ শুরু হয়। এজন্য প্রয়োজন যে, এর প্রারম্ভও যেন আনুগত্যের সেজদাহ দ্বারা শুরু হয়। তারপর নিদ্রার সময় যখন মানুষ স্বীয় অনুভূতিপূর্ণ জিন্দেগী হতে সামান্য সময়ের জন্য বেখবর হতে শুরু করে তখন এটাও প্রয়োজন যে, আল্লাহর নাম নিয়েই যেন সে বেখবর হয়। কেননা, সে কি জানে যে, এ সময়ে বুজে আসা চোখ দুটো কখনো উন্মিলিত হওয়ার সুযোগ লাভ করবে কি? এভাবে শেষ জীবন পর্যন্ত দৈনন্দিন কাজের এই প্রস্তুতি নিজ নিজ স্থানে প্রত্যাবৃত হতে থাকে।
সকাল হতে দ্বিপ্রহর পর্যন্তই মানুষের আসল ব্যস্ততার সময়। এজন্য সকাল হতে সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়া পর্যন্ত কোন ফরজ নামাজ নেই। অনুরূপভাবে এশা হতে সুবেহ সাদেক পর্যন্তও কোন ফরজ নামাজ নাই। এ সময়টি শুধুমাত্র শান্তি দায়িনী নিদ্রার জন্যই উপযুক্ত। এই নির্দিষ্ট সময়গুলো ছাড়া বাকী সময় সবই হচ্ছে মানুষের কাজ করার সময়। এজন্য প্রতিটি কাজের পূর্বেই ফরজ নামাজগুলোকে বিন্যাস করা হয়েছে।
নামাজের ওয়াক্তগুলোর প্রতি এক নজর :
নামাজের সময় নির্ধারণে ইসলামের দৃষ্টিতে অপর একটি নিয়মতান্ত্রিকতাকে নজরে রাখা প্রয়োজন। পৃথিবীর অংশীবাদী ধর্মগুলোর ইতিহাস পাঠে জানা যায় যে, মানুষের শেরেকে নিপতিত হওয়ার সবচেয়ে বড় চিহ্ন হচ্ছে সৃষ্টজগতের সর্বোজ্জ্বল জ্যোতির্ময় পিÐ ‘সূর্য’। হিন্দুস্থান, ইরান, বাবেল, আরব, মিশর, শাম, রোম, গ্রীস সকল স্থানেই সূর্যের পূজা করা হত। যার উজ্জ্বল আলো মানব মনের অন্ধকারাচ্ছন্নতার বড় কারণ হয়ে দেখা দিয়েছিল। সূর্য পূজারী কাওমগুলোর মাঝে সূর্য পূজার নির্দিষ্ট সময় বিদ্যমান ছিল। প্রত্যুষে যখন সূর্য শাহানা শোভা ও দীপ্তি নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে, তারপর যখন তা ক্রমশ : সৃষ্টজগতের নতুন দিনকে জয় করে স্বীয় বিজয়ীর পতাকা উড্ডীন করে, তারপর যখন সন্ধ্যায় যখন তা বিশ্ব প্রকৃতি হতে অবসর গ্রহণ করে রাতের নেকাবকে মুখমÐলের উপর স্থাপন করে, সূর্য পূজারীরা তখনই উদ্বেল হয়ে উঠে।
সর্বপ্রথম যে তাওহীদবাদী সূর্য পূজার প্রদীপকে নিভিয়ে দিয়েছিলেন, তিনিই হযরত ইব্রাহীম খলীলুল্লাহ (আ:)। (সূরা আনয়াম রুকু-৯) মিল্লাতে ইব্রাহীমীতে নামাজের জন্য ঐ সকল সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল, যখন সূর্য পূজারীদের শ্রেষ্ঠ দেবতা সূর্যের উদয়-অস্তের সময় নয়; বরং সূর্য পশ্চিম গগনে ঢলে পড়া ও অস্তমিত হওয়ার পর সময় নির্ধারণ করা হয়। যেন এই সময়গুলো মুক্ত কণ্ঠে বলতে পারে যে, এই ইবাদত সূর্য পূজার বাতেল বিশ্বাসের পরিবর্তে ঐ সত্য বিশ্ব প্রতিপালকের বন্দেগী, যাঁর সামনে সেজদাহ অবনত হওয়ার চিহ্ন সূর্যের কপালেও অঙ্কিত আছে। দ্বীনে মোহাম্মদী (সা:) মিল্লাতে ইব্রাহীমীর (আ:) অপর নাম। এজন্য এতেও নামাজের ঐ সময়গুলোকেই নির্বাচন করা হয়েছে যা মিল্লাতে ইব্রাহীমীতে প্রচলিত ছিল। দিনের উদয়ের পূর্বে যখন বাতেল পরস্তির এই দেবতা (সূর্য) অনস্তিত্বের পর্দায় সমাচ্ছন্ন থাকে, এবং দ্বিপ্রহরের পরে যখন তা “স্বীয় পরিপূর্ণ অর্ধারোহণে পৌঁছে ক্ষয়ের দিকে অগ্রসর হয়, এই ক্ষয় এবং অবনয়নেরও তিনটি পর্যায় হয়। যখন মাথার উপর হতে নীচে নেমে আসে, যাকে যাওয়াল বলা হয়। তারপর যখন চোখের দৃষ্টির বৃত্ত হতে নীচে নেমে আসে, যাকে আসর বলা হয়। তারপর যখন দৃষ্টি সীমার নীচে চলে যায়, যাকে মাগরের বলা হয়। সূর্যের ক্ষয়িষ্ণুর এই তিনটি অবনমিত সময় এক একটি নামাজ আদায় করা হয়। তারপর ঠিকভাবে অস্ত যাওয়ার পর যখন তা’ অন্ধকারের কবরে শায়িত হয়ে যায়, সে সময় এশার নামাজ আদায় করা হয়। এ কারণে আল-কুরআনে নামাজের সময় উল্লেখকালে সূর্য অস্ত যাওয়ার এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়ার কথা নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ “নামাজ কায়েম কর সূর্য ঢলে পড়ার সময়, রাতের অন্ধকার পর্যন্ত (যোহর, আসর, মাগরের, এশা) এবং ফজরের নামাজ।” (সূরা বনী ইসরাঈল)
মোটকথা, এ কারণেই ইসলামে কোন ফরজ নামাজ সূর্যোদয়ের পর সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে না পড়া পর্যন্ত রাখা হয়নি। এ সময়টা সূর্যের উত্থানের সময়। বরং প্রত্যেক নামাজ সূর্যের ক্রমাগত ক্ষয়িষ্ণু ও অবনমিত এবং অদৃশ্য হওয়ার সময়ে রাখা হয়েছে। তাই দেখা যায়, সূর্য উদয়ের সময়, তার উত্থান ও পরিপূর্ণতার সময় এবং সূর্যাস্তের সময় নামাজ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কেননা, এই সময়গুলোতেই সূর্য-পূজারীদের নির্দিষ্ট এবাদতগুলো সম্পন্ন করা হয়। (সহীহ মুসলিম : কিতাবুস সালাত, নামাজের নিষিদ্ধ সময়)
(চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন