অবশেষে এই প্রথম মহাবিশে^র অন্যতম অতি গোপন রহস্যময় বস্তু বø্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহরের ছবি তুলতে সক্ষম হয়েছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। বø্যাকহোলের ছবিতে এক অন্ধকার গোলক ঘিরে কমলা রঙের আলোর ছটা দৃশ্যমান। এর ফলে এতদিন যা ছিল কল্পনায়, কল্পবিজ্ঞান কাহিনীতে শিল্পীর তুলিতে আঁকা, এখন তা বাস্তব ছবি। বø্যাক হোল হলো এমন একটি জায়গা, যেখানে কোনো কিছু প্রবেশ করলে আর ফিরে আসে না। এমনকি আলোও এই গহŸরকে অতিক্রম করতে পারে না। নাম গহŸর হলেও বø্যাক হোলের মধ্যে কিন্তু পুরোটা ফাঁকা জায়গা নয়। বরং এর মধ্যে খুব অল্প জায়গায় এত ভারি সব বস্তু আছে যে এসবের কারণে তীব্র মহাকর্ষীয় শক্তি উৎপন্ন হয়। বø্যাক হোলের পেছনে ‘ইভেন্ট হরাইজন’ নামের একটি স্থান আছে, যাকে বলা হয় ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’। এই জায়গায় মহাকর্ষীয় শক্তি এতটাই তীব্র যে এখান থেকে কোনো কিছুই আর ফেরত আসতে পারে না।
যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল লেটার্স নামের বিজ্ঞান সাময়িকীতে বুধবার এই কৃষ্ণগহŸর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেন বিজ্ঞানীরা। কৃষ্ণগহŸরটির আকার প্রায় ৪০ বিলিয়ন কিলোমিটার। সহজ কথা, কৃষ্ণগহŸরটি পৃথিবীর প্রায় ৩০ লাখ গুণ বড়! আকারে এটি এতটাই বিশাল যে বিজ্ঞানীরা একে ‘দৈত্যাকৃতি’র বলে উল্লেখ করেছেন। বুধবার বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করেন যে ৫ কেটি ৫০ লাখ আলোককর্ষ দূরে অবস্থিত মেসিয়ার ৮৭ বা এম-৮৭ ছায়াপথের কেন্দ্রে ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ (ইএইচটি)-এর মাধ্যমে ওই বø্যাক হোলের ছবি তোলা হয়েছে। বø্যাক হোলটির ওজন স‚র্যের ৬০০ কোটি গুণ বেশি।
বø্যাক হোলের ছবি দেখিয়ে ইএইচটি-র প্রধান বিজ্ঞানী ও হার্ভার্ড-স্মিথসোনিয়ান মহাকাশ পদার্থবিজ্ঞানের জ্যোতির্বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. শেপ ডোয়েলম্যান এদিন ওয়াশিংটনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বললেন, ‘যাকে দেখা যায় না বলে আমরা এতদিন জেনে এসেছি, তা দেখলাম। একটা বø্যাক হোলের ছবি দেখলাম এবং তা তুলে ফেললাম।’ এ হচ্ছে একটি বিশাল কৃষ্ণ গহŸরের বাইরের আকৃতি, যা প্রধানত ধুলো ও গ্যাসের একটি স্তর। এতদিন ধরে ধারণা করা হতো, মহাশূন্যের কৃষ্ণ গহŸরগুলো এই মহাবিশ্বের সৃষ্টিকালীন সময়ে তৈরি হওয়া একেকটি কালো ফাঁদের মতো, যা আলো কিংবা অন্য সবকিছুকেই গ্রাস করতে সক্ষম। তবে দীর্ঘ গবেষণার পর জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের পাওয়া ফলাফল বলছে কৃষ্ণ গহŸরের ক্ষেত্রে পদার্থবিজ্ঞানের জাগতিক কোনও স‚ত্রই কাজ করে না। তিনি বলেন, এ এক বিরাট সাফল্য। একই সাথে বিশ্রে আরো ৫টি স্থানে এ সাংবাদিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওয়াশিংটনে পর্দায় যখন বø্যাকহোলর ছাব দেখানো হয় তখন উপস্থিতদের আনন্দধ্বনি ও করতালিতে কক্ষটি মুখরিত হয়ে ওঠে।
বø্যাক হোলের ছবি তোলার জন্য আট বছর ধরে চেষ্টা চালান ডোয়েলম্যান এবং তার সহযোগী দুশ’ বিজ্ঞানী। তারা ঘুরে ঘুরে বেরিয়েছেন অ্যান্টার্কটিকা থেকে স্পেন এবং চিলিতে অবস্থানরত আটটি টেলিস্কোপে, যার কোনোটা পাহাড় চূড়ায় অথবা কুমেরু প্রদেশে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৫ মিটার উঁচু বরফের পাশে। যে তরঙ্গে এসেছে বø্যাক হোলের খবর, সে তরঙ্গ প্রসারে বিঘœ ঘটায় জলীয় বাষ্প। তাই খুঁজতে হয়েছে এমন জায়গার দ‚রবীন, যেখানে জলীয় বাষ্প প্রায় অনুপস্থিত। অবশেষে আট দ‚রবীনের সমষ্টি ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ দিয়ে ছবি তোলা সম্ভব হয়েছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, বø্যাক হোলের চারপাশে যে চৌহদ্দি, যার মধ্যে এক বার গিয়ে পড়লে রেহাই নেই কোনও কিছুরই, তখন কেবলই পতন, সেই চৌহদ্দির নাম ‘ইভেন্ট হরাইজন’। সেই চৌহদ্দির দিকে ধাবমান বস্তুপিÐ ঘুরতে থাকে ভীষণবেগে। ধাবমান সেই বস্তু থেকে বেরোয় নানা রকমের ছটা। তারা বলেন, বø্যাক হোলের খিদে এমন আগ্রাসী যে, তা গিলে খায় সব কিছু, রেহাই দেয় না কোনও রকমের তরঙ্গকেও। সে জন্যই তার নামে ‘বø্যাক’। বাংলায় ‘অন্ধক‚প’।
বিজ্ঞানীরা বলেন, সব সময়েই ‘খাই খাই’ অবস্থায় থাকে বø্যাক হোল। কখনওই তার খিদে কমে না। পেটও ভরে না। চার পাশে থাকা কোনও ছায়াপথের যে নক্ষত্র, ধুলোবালি, ধুলো আর গ্যাসের মেঘকে তার অত্যন্ত জোরালো অভিকর্ষ বলের টানে কাছে নিয়ে আসে বø্যাক হোলগুলো, সেগুলো বø্যাক হোলের পেটে গিয়ে পড়ার আগে ছুটে আসার সময় একে অন্যকে ধাক্কা মারে। ধাক্কা মারে বø্যাক হোলের চার পাশে থাকা ধুলোবালি আর জমাট বাঁধা গ্যাসের মেঘকে। তার ফলে সৃষ্টি হয় এক ধরনের আলোর। যাকে বলা হয় এক্সরে। যা আমরা দেখতে পাই না। তবে সেগুলিও তড়িৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ বা ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ। যা খুব বেশি দ‚র যেতে পারে না। তাই খুব দ‚র থেকে তা দেখা সম্ভব হয় না আমাদের। এমনকি, আমাদের হাতে তেমন কোনও শক্তিশালী টেলিস্কোপ জএখনও পর্যন্ত নেই, যা দিয়ে বø্যাক হোলের ইভেন্ট হরাইজন থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসা সেই এক্স-রে দেখা সম্ভব।
তারা বলেন, প্রচুর আধানযুক্ত কণা ইভেন্ট হরাইজ্নে থাকে বলে বø্যাক হোলের চার পাশের ওই এলাকায় অত্যন্ত শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র বা ম্যাগনেটিক ফিন্ডের জন্ম হয়। সেই শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রগুলির মধ্যে দিয়ে ইভেন্ট হরাইজ্ন থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসে আরও এক ধরনের আলো। যা আসলে রেডিও তরঙ্গ। যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনেক গুণ বেশি। তা অনেক অনেক দ‚র পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে। যা এক্স-রে পারে না।
বিজ্ঞানীদের মতে, সত্যিই বø্যাক হোল বড় বিচিত্র। এত অভিনব তার চরিত্র যে এক সময়ে স্বয়ং আইনস্টাইনই পর্যন্ত বিশ্বাস করতে চাইছিলেন না এর অস্তিত্ব। বø্যাক হোল মানে নক্ষত্রের মৃতদেহ। যে কোনও তারায় চলে দুই বিপরীত ক্রিয়া। প্রচÐ পরিমাণ পদার্থের নিষ্পেষণে তারা সঙ্কুচিত হতে চায়। ওদিকে আবার হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম (হাইড্রোজেন বোমায় যা ঘটে) উৎপাদনের আগুনে তারা লুচির মতো ফুলতে চায়। জ্বালানি ফুরাতে আগুনও শেষ। তখন শুধুই নিষ্পেষণ। নক্ষত্রের মরণকাল। এর পর? অন্তিম দশা নির্ভর করে তারার মৃতদেহের ওজনের উপরে। যদি মৃতদেহ খুব ভারি হয়, তবে তা এগোয় বø্যাক হোলের দিকে।
বø্যাকহোলের ছবি তোলার জন্য টেলিস্কোপ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা অব্যাহত ছিল। ২০১৮-র এপ্রিলে গ্রীনল্যান্ডের একটি টেলিস্কোপ এত যুক্ত হয়। ড. ডোয়েলম্যান বলেন, এ সব পর্যবেক্ষণাগারগুলোর কাজ অব্যাহত রাখা হবে। কারণ, আরো অনেক কিছু করার আছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন