আফতাব চৌধুরী
রাজধানী ঢাকা, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটে যাওয়া বেশকটি খুন, অপহরণ, ছিনতাই, রাজনৈতিক হত্যাকা-, বোমাবাজি এবং সন্ত্রাসী কর্মকা-ই প্রমাণ করে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। দেশের এ হাল অবস্থায় সাধারণ মানুষ তাদের জানমালের নিরাপত্তাজনিত কারণে অসহায় ও বোবা হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলের জনসাধারণ নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতিতে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও শংকিত অবস্থায় দিন গোজরান করছে। এ নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের তরফে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তেমন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। তার কতিপয় সদস্যের টু-পাইসের ব্যাপারটা গোটা পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে ফেলেছে। তারা দেখেও দেখে না, শুনেও শোনে না বলে সাধারণ মানুষের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। নিজেরটা হয়ে গেলে অন্যদের নিয়ে চিন্তÍÍাভাবনা করার প্রয়োজনীতা তারা উপলব্ধি করে না বলে অভিযোগ রয়েছে। তারা বুঝতেও চায় না যে, তাদের দায়িত্ব কী? কেন তাদের বেতন-ভাতাসহ আনুষঙ্গিক অনেক-বাড়তি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়ে থাকে জনগণের করের টাকা হতে, যা সাধারণ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তুলনায় বেশি। অপরাধ বাড়ছে, অপরাধী সর্বদাই সক্রিয় রয়েছে। আবার এসব অপরাধ ও অপরাধীর সঙ্গে যোগ দিয়েছে তারা, যাদের দায়িত্ব অপরাধ প্রতিহত করা, অপরাধীদের দমন করা। এ অভিযোগ প্রায় সর্বত্রই। অপরাধ প্রবণতা এতই বৃদ্ধি পাচ্ছে যে, কে কখন কীভাবে আক্রান্ত হবে, কার সম্পত্তি কে দখল করবে, কে কখন লাঞ্ছিত হবে, কে কখন অপহৃত হবেÑ এ আশঙ্কায় সাধারণ মানুষের চোখে ঘুম নেই। এ অপরাধ প্রবণতা রোধে কেউই সক্রিয় হয়ে এগিয়ে আসছে না। সবাই যেন নীরব দর্শক। মূলত কারণ একটাই, ধূম্রজাল সৃষ্টি করে ফায়দা হাসিল করা।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যতদূর অবনতি হয়েছে তা বুঝতে পা-িত্য বা বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না। দেশে একটি সরকার রয়েছে। বিধিবদ্ধ আইনের আশ্রয়ে চলছে প্রশাসন। তাদের সহযোগিতায় আছে পুলিশ বিভাগ। অথচ প্রকাশ্যে প্রাণহানি, খুন, উৎখাত ইত্যাদির হুমকি দেওয়া হচ্ছে। প্রকাশ্যে জনবহুল এলাকায় চলছে অস্ত্রের মহড়া, ছিনতাই, রাহাজানি এবং তারপর খুন। রাজপথে বসছে বাজার, ফুটপাত দেওয়া হচ্ছে লিজ, রাজপথের উভয় পাশে যানবাহনের অবৈধ স্ট্যান্ড। এদের সরানোর উদ্যোগ তো নেই-ই বরং দৈনিক, সাপ্তাহিক ভিত্তিতে আদায় করা হচ্ছে চাঁদা। এখানে চাঁদাবাজ কারা, কে তাদের দেখবে, কে গ্রেফতার করবে, বিচার করবে কে? যারা করবে তারাই তো এসব অপরাধে জড়িত বলে সাধারণ মানুষের ধারণা। এদিকে মাননীয় বাণিজ্য ও অর্থমন্ত্রী নিজেরাই চাঁদাবাজির কথা স্বীকার করে বলেছেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এটাও একটি কারণ।
আবার অপরাধী, দুষ্কৃতকারী, সন্ত্রাসী, খুনিদের কোনো কোনো সময় গ্রেফতার করা হলে প্রতিবাদ, মিছিল, সভা হয়, বিবৃতি প্রদান করা হয়Ñ এটাও ঠিক। অপরাধীরা ঘৃণার পরিবর্তে আশ্রয়প্রাপ্ত ও উৎসাহিত হয়। রাজনীতি দলীয় গোষ্ঠী স্বার্থকে শিক্ষাঙ্গনে অনুপ্রবেশ করানো হচ্ছে। হাসপাতাল, ক্লিনিক, এমনকি কারাগার পর্যন্ত এখন আর নিরাপদ নয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীকে মারপিট করে হত্যা করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে, সত্য সংবাদ প্রকাশের জন্য সাংবাদিককে শুধু ভয় দেখানো হচ্ছে না খুনও করা হচ্ছে। সাগর-রুনি তার একমাত্র দৃষ্টান্ত নয়, আরো আছে। পরিস্থিতির অবনতির এর চেয়ে বড় দৃষ্টান্ত আর কী হতে পারে? ধর্ষণ করে খুন করা হচ্ছে, পুলিশ বিভাগের বড় কর্তাদের অফিস ও বাসার সামনে চলছে মদ, জুয়া, ছেঁড়া টাকা, পাউন্ড-ডলারের অবৈধ ব্যবসা, পতিতারা অবাধে চালিয়ে যাচ্ছে দেহব্যবসা, নেই কোনো প্রতিকার, নেই প্রতিরোধ। আছে আইন-নেই প্রয়োগ।
আমরা সবাই বলে থাকি, দেশের সার্বিক উন্নতি ও সমৃদ্ধির পূর্বশর্ত হচ্ছে আইন- শৃঙ্খলাজনিত স্বাভাবিক পরিবেশ ও সুষ্ঠু পরিস্থিতি। অথচ সেরূপ পরিস্থিতির নিশ্চয়তার জন্য প্রচেষ্টা কি চালানো হচ্ছে? যদি হয়ে থাকে তবে ফলাফল কোথায়? আসলে আমরা মুখে যা বলি কার্যক্ষেত্রে তাতে বিশ্বাসী নই। দেশের জনগণকে সব শক্তির- সব ক্ষমতার উৎস বলা হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই অস্ত্রধারী, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজদের আশ্রয় দেওয়া হয়। কিন্তু অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা কোনো দিনই রাজনৈতিক প্রত্যয় ও অঙ্গীকারে বলীয়ান নয়। তারা লোভী, ভোগ ও সুবিধাবাদী। এ সুবিধাবাদের কারণে তারা দল বদল করে, লেবাস পরিবর্তন করে। তারা অপরাধ করে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে থাকে। জুলুম ও জালেমকে যেখানে আমাদের ঘৃণা করা উচিত সেখানে আমরা কেবল নীরবই থাকি না, তাদের পক্ষে কথা বলি, নিরপরাধ বলে বিবৃতি-বক্তৃতা দিয়ে থাকি। এটা কি স্ববিরোধিতা নয়? আমাদের মনে রাখতে হবে, ঐক্যবদ্ধ সামাজিক প্রতিরোধ আর শাস্তির কঠোর বিধানই সন্ত্রাসের একমাত্র জবাব। এ কথা অবশ্য আমরা মাঝেমধ্যে বলে থাকলেও কার্যক্ষেত্রে তার প্রতিফলন ঘটাতে পারি না। ন্যায় ও নীতির অনুসরণে আইনের প্রতি আস্থাশীল জনসাধারণ সহযোগী শক্তিতে পরিণত হয়।
অন্যদিকে পরিস্থিতির অবনতি লক্ষ্য করেও ব্যবস্থা গ্রহণে সময় ক্ষেপণ করা হলে অবনতি দ্রুত হয়। প্রতিপক্ষ দুঃসাহসী ও শক্তিশালী হয়, পরিস্থিতি এ সময় আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণই বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। পরিস্থিতিকে সময়ের হাতে ছেড়ে দেয়া প্রজ্ঞার পরিচায়ক নয়। জনগণকে একসময় যতই অসহায় মনে করা হোক না কেন, জনগণই ক্ষমতার উৎস। জনগণের শক্তি অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলে যে নৈরাজ্য নেমে আসে তা কারো জন্য কল্যাণকর হতে পারে না, ইতিহাস এর সাক্ষী। কোনো শক্তিধর ব্যক্তি বা গোষ্ঠীই গণজোয়ার ঠেকাতে পারেনি এবং পারবেও না। নেতৃত্বহীন, নিয়ন্ত্রণহীন গণঅভ্যুত্থান ব্যাপক ধ্বংস নিয়ে আসে যা মোটেই কাম্য নয়। এ গণশক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখাই নেতৃত্বের পরিচয়। দেশের আইন- শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সারাদেশে বর্তমানে যে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে তাতে সহজেই বলা যায়, পরিস্থিতি নৈরাজ্যের দ্বারে উপনীত। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় বের করতেই হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন