শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সাহিত্য

নজরুলের অগ্নিবীণা

আ লী এ র শা দ | প্রকাশের সময় : ৩১ মে, ২০১৯, ১২:০৯ এএম

নজরুলের লেখা সমস্ত কবিতার মধ্যে যে কবিতাটি সবচেয়ে বেশি পঠিত, যে কবিতা নজরুলকে দিয়েছে আলাদা পরিচিতি, যে কবিতা বাংলা সাহিত্যে তথা বিশ্বসাহিত্যে সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে সেই কবিতাটির নাম ‘বিদ্রোহী’। আর এই কবিতাটি যে বইয়ে সংকলিত করা হয়েছ তার নাম অগ্নিবীণা”।

১৯২২ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় তাঁর অমর কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা। এই গ্রন্থে মোট বারোটি কবিতা আছে। কবিতাগুলি হচ্ছে - ‘প্রলয়োল­াস’, ‘বিদ্রোহী’, ‘রক্তাম্বর-ধারিণী মা’, ‘আগমণী’, ‘ধূমকেতু’, কামাল পাশা’, ‘আনোয়ার ‘রণভেরী’, ‘শাত-ইল-আরব’, খেয়াপারের তরণী’, কোরবানী’ ও মোহররম’। এছাড়া গ্রন্থটির সর্বাগ্রে বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষ-কে উৎসর্গ করে লেখা একটি উৎসর্গ কবিতাও আছে। ‘অগ্নিবীণা’ প্রচ্ছদপটের পরিকল্পনা ছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং এঁকেছিলেন তরুণ চিত্রশিল্পী বীরেশ্বর সেন। বইটির তৎকালীন মূল্য ছিল ৩ টাকা।

মাত্র বারোটি কবিতা দিয়ে নজরুল বুঝিয়ে দেন কোয়ান্টিটি নয় কোয়ালিটিই আসল কথা। কবিতা বারো শত কিংবা বারো হাজার লিখতে হয় না। কবিতার মতো কবিতা একটিই যথেষ্ট। বইয়ের দ্বিতীয় কবিতাটি হচ্ছে বিদ্রোহী। যা নজরুলকে খ্যাতির সর্বোচ্চ শিখরে নিয়ে গেছে। কবিতাটি ব্যাপকভাবে আলোচিত এবং সমালোচিত।

যখন বইটি প্রকাশ হয় তখন কবি বলতে সবাই রবীন্দ্রনাথকেই বুঝতো, তরুন কবিদের কবিতায় রবীন্দ্র প্রভাব ছিলো স্পষ্ট। এমন সময় রবীন্দ্র বলয়ের বাইরে এসে সম্পূর্ন ভিন্নধারার কবিতা নিয়ে হাজির হন কাজী নজরুল ইসলাম। সাহিত্যাঙ্গনে রীতিমতো হৈচৈ ফেলে দেন তিনি।


অগ্নিবীণা› কাব্যগ্রন্থের সবক›টি কবিতায় অনুপ্রাস, উপমা, রূপক এবং ছন্দ প্রয়োগে অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন নজরুল।
প্রলয়োল­াস কবিতায় কবি বলেন,
তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!!
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল্-বোশেখির ঝড়।
তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!!গ্ধ

কবিতাটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্তকবি ছন্দের দোলায় পাঠককে বিমোহিত করে রেখেছেন। পঙক্তিগুলোকে ঢেউয়ের মতো নাচিয়েছেন কবি। কবি যেমন ছিলেন চির চঞ্চল তেমনি নতুনদের স্বাগতম জানিয়েছেন তা ধিন, তা ধিন নৃত্যময় ছন্দে।
ঐ ভাঙা-গড়া খেলা যে তার কিসের তবে ডর?
তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!–
বধূরা প্রদীপ তুলে ধর্!
কাল ভয়ঙ্করের বেশে এবার ঐ আসে সুন্দর!–
তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!!গ্ধ

ভাঙা-গড়া, ভয়ংকর-সুন্দর এমন বিপরীতার্থক শব্দগুলো পাশাপাশি থাকায় অন্যরকম এক দ্যোতনার সৃষ্টি হয়েছে। কবিতাটিতে কবি নতুনদের জয়গানে মুখর হয়েছেন। কবি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, নতুনরাই পারে নব কিছু সৃষ্টি করতে। নতুনদের জয়গান করার পরেই কবি তাদের দেখান কিভাবে শির উঁচু রাখতে হয়। লিখেন বিখ্যাত কবিতা ‹বিদ্রোহী›।
বল বীর –
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!
বল বীর
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’ চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’

ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া, উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!’ এই কবিতায় কবি অন্যায়, অনাচার, অনিয়মের বিরুদ্ধে আপাদমস্তক একজন বিদ্রোহী সৈনিক। অশুভ শক্তিকে নাশ করতে কিভাবে জ্বলে উঠতে হয় তাই বলেছেন ছন্দের ঝংকারে।
আমি রুষে উঠি যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া, ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া! আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া!


এ যেন চরম বিদ্রোহ। মুক্তির চুড়ান্তগর্জন। ধ্বংসের পর যেমন সবকিছু নতুন করে জেগে উঠে, কবিকেও তেমনি
বিদ্রোহের পাশাপাশি দেখতে পাই প্রেমিকরূপে। কবি বলেন, আমি ইন্দ্রাণী-সুত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর রণ-তূর্য;গ্ধ তবে কবির এই প্রেমিক রূপকে ছাপিয়ে বিদ্রোহী রূপই মূখ্য হয়ে ফুটে উঠেছে কবিতায়। কবির এই বিদ্রোহ ঘুণে ধরা সমাজ, পুঁজিবাদী রাষ্ট্র, তথা ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। কবির বিদ্রোহ থামবার নয়, যতদিন না অসুরের বিনাশ হয়, যতদিন না সত্যের বিজয় হয়। নজরুল সৈনিক জীবনে উপলব্ধি করতে শিখেছিলেন প্রতিবাদ ছাড়া, যুদ্ধ ছাড়া কোনোকিছুই সহজে আদায় সম্ভব নয়, ঘুমিয়ে থাকলে প্রভু শ্রেণী চাইবে আরো ঘুমাক। তাই নজরুল সবাইকে জাগ্রত করার জন্য কথার চাবুক ছুড়ে মেরেছেন।

এরকম মানুষ জাগানিয়া পঙক্তি রয়ছে ‹আনোয়ার› কবিতাটিতেও। কবি মুসলিম জাতির দুঃখ দূর্দশা দেখে আক্ষেপ করে বলেন,
্রআনোয়ার! আনোয়ার!
যে বলে সে মুসলিম জিভ ধরে টানো তার!
বেইমান জানে শুধু জানটা বাঁচানো সার!
আনোয়ার! ধিক্কার!
কাঁধে ঝুলি ভিক্ষার -
তলওয়ারে শুরু যার স্বাধীনতা শিক্ষার!
যারা ছিল দুর্দ্দম আজ তারা দিকদার!
আনোয়ার! ধিক্কার!গ্ধ

যে জাতি একদিন অপ্রতিরোধ্য ছিল, যাদের বীরত্বের কথা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ইতিহাসের পাতায় তাদের দৈন্যদশা কবিকে দারুনভাবে আহত করেছিল, তাই তিনি ধিক্কার জানিয়েছেন মুসলিম নামধারী পথভোলা নেতাদের। ‹ধূমকেতু› কবিতায় নজরুল যেন আরও বেশি সাহসী, অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় তাঁর কথার স্ফুরণ। ্রআমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুন মহাবিপ্লব হেতু এই গ্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!
ধূমকেতু কবিতায় নজরুলকে পাই একজন প্রথাবিরোধী লেখক হিসেবে, তিনি কোন বিধিনিষেধের গÐিতে আবদ্ধ হতে রাজি নন।

নজরুলের অগ্নিবীণা বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। উপযুক্ত শব্দচয়নের মাধ্যমে অগ্নিবীণার প্রত্যেকটি কবিতায় ছন্দালংকার এবং অর্থালংকার সার্থক প্রয়োগ ঘটিযেছেন কবি। নজরুল পঙক্তি বিন্যাসে ও মাত্রাচেতনায় সচেতন ছিলেন; ছিলেন নিরীক্ষাপ্রবণও। উপপর্ব, অপূর্ণপর্ব এবং অসমদৈর্ঘের পঙক্তি ব্যবহার করে মধ্যম লয়ের মাত্রাবৃত্ত ছন্দের কবিতাগুলোকে অন্যরকম এক কাঠামোতে দাঁড় করিছেন তিনি যা কিছুটা ধীর লয়ে পাঠ করতে হয়। বীণাতে সুর উঠিয়ে গায়ক আনন্দের, বিরহের গান গায় কিন্তু নজরুল দেখালেন যে বীণাতে অগ্নিমাখা সুর তোলে জালিমের বুকে কাঁপনও তোলা যায়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন