শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সাহিত্য

নজরুল ইসলাম অনূদিত রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম

মু সা ফি র ন জ রু ল | প্রকাশের সময় : ৩১ মে, ২০১৯, ১২:০৯ এএম

ওমর খৈয়াম (১০৪৮-১১২৩)-এর বিচিত্র ও বহুমুখী প্রতিভা ও সুরের জীবনে একটা উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে আছে রুবাইয়াৎ। তাঁর রুবাইয়াৎ প্রচারে-প্রকাশে ও অনুবাদের সময়কাল অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে বিভিন্ন ভাষায় শুরু হয়েছে। আজ অবধি মুক্ত মনের পাঠক ওমরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও অনেক ক্ষেত্রেই অনেক অজানা তথ্য সমৃদ্ধ পূর্ণ বর্ণনা বিস্তারিতভাবে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে অবগত হচ্ছেন। ওমর খৈয়ামের অনেক অজানা অর্থ ইউরোপের বিভিন্ন অনুবাদক ফারসী থেকে ইংরেজীতে অনুবাদ করেছেন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) ফারসী থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন যা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে এক অপূর্ব ও অসাধারণ অবদান।

বাংলায় অন্যদের মধ্যে আর যারা রুবাইয়াৎ-এর অনুবাদ করেছেন তাদের চেয়ে কাজী নজরুল ইসলাম মূল কবির (ওমর খৈয়াম) দেশ ও কালের স্বাদ সঞ্চার করতে পেরেছিলেন বলে অধিক প্রশংসিত হয়েছে। আরবী ফারসী প্রয়োগ মুসলিম সমাজে ব্যবহার ও এর প্রচলন সম্পর্ক বিশিষ্ট নজরুল গবেষক শাহাবুদ্দিন আহমদ লিখেছেন, ফিটজেরাল্ডে ধারণা ছিলো, যুক্তিবাদী ওমর খৈয়াম সুফী ছিলেন না বরং ছিলেন নিয়তিবাদী। ওমরকে তিনি খুব চিন্তার মধ্যে অবস্থিত দেখেছেন, কিন্তু এই মতবাদ সবাই জানেননি। ফিটজেরাল্ড বলেছেন : ‘ও পধহহড়ঃ ংবব ৎবধংড়হ ঃড় ধষঃবৎ সু ড়ঢ়রহরড়হ’ অর্থাৎ ওমর যে ‘ঊঢ়রপঁৎবধহ’ তাঁর এই মত পরিবর্তনের কোন কারণ দেখেন না। এ দিক থেকে ওমরের সঙ্গে নজরুলের স্বভাবগত মিল খুঁজে পাওয়া কঠিন ব্যাপার নয়।

সমাজ জীবনে উত্তরের দৃষ্টিভঙ্গি রুবাইয়াৎ-এর অনুবাদ সম্পর্র্কে ভূমিকাংশে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন : “ওমর খৈয়ামের ভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে ফিটজেরাল্ডের কবিতায় যারা অনুবাদ করেছেন, তাঁরা সকলেই আমার চেয়ে শক্তিশালী ও বড় কবি। কাজেই তাঁদের মতো মিষ্টি শোনাবে না হয়ত আমার এ অনুবাদ। যদি না শোনায়, সে আমার শক্তির অভাব সাধনার অভাব, কেননা, কাব্যলোকের গুলিস্তান থেকে সঙ্গীতলোকের রাগিনী-দ্বীপে আমার দীপান্তর হয়ে গেছে। ....... কাজেই আমার অক্ষমতার দরুণ কেউ যেন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ওমর খৈয়ামের উপর চটে না যান। ওমরের রুবাইয়াৎ বা চতুষ্পদী কবিতা চতুষ্পদী হলেও তার চারটি পদই ছুটেছে আরবি ঘোড়ার মতো দৃপ্ত তেজে সমতালে ভÐামী, মিথ্যা বিশ্বাস, সংস্কার বিধি-নিষেধের পথে ধুলি উড়িয়ে তাদের বুক চূর্ণ করে। ওমরের বোররাক বা উচ্চেঃশ্রবাকে আমার মতো আনাড়ি সওয়ার যে বাগ মানাতে পারবে, সে ধৃষ্টতা আমার নেই। তবে লাগাম কষে প্রাণপণ বাঁধা দিয়েছি, যাতে সে অন্য পথে না যায়।” (কাজী নজরুল ইসলাম, ভূমিকা, রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম)

কাজী নজরুল ইসলাম ছাড়াও ফিটজেরাল্ড, কান্তি ঘোষ, সৈয়দ মুজতবা আলী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সিকান্দার আবু জাফর, নরেন দেবসহ আরো অনেকে রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম অনুবাদ করেছেন। তবে আওলাদ হোসেন তাঁর “ওমর খৈয়াম : মর্মবাণী ও জীবন রহস্য গ্রন্থে কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে বলেছেন, “কাজীর অনুবাদ সকল অনুবাদের কাজী।” তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ :
“পৌঁছে দিও হজরতেরে খৈয়ামের হাজার সালাম
শ্রদ্ধাভরে জিজ্ঞাসিও তাঁরে লয়ে আমার নাম
বাদশা নবী কাজি খেতে নাই ত নিষেধ শরীয়তে
কি দোষ করল আঙুর পানি? করলে কেন তায় হারাম?”
(কাজী নজরুল ইসলাম)

ওমর খৈয়াম ছিলেন স্বাধীনচেতা, বিদ্রোহী মনোভাবাপন্ন, কুসংস্কার, ভÐামী গোড়ামি ইত্যাদির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী। কাজী নজরুল ইসলাম ও ছিলেন বিদ্রোহী কবি, মানবতার কবি, ভন্ডামী-গোড়ামী কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদী :
“নাস্তিক আর কাফের বলো তোমরা লয়ে আমার নাম
কুৎসা গøানির পঙ্কিল স্রোত বহাও হেথা অবিশ্রাম।
অস্বীকার তা করব না যা ভুল করে যাই, কিন্তু ভাই
কুৎসিত এই গালি দিয়েই তোমরা পাবে স্বর্গধাম।”
(কাজী নজরুল ইসলাম)

রোমান্টিক মনোভাব এবং দার্শনিক মনোভাব মিলে ওমর খৈয়ামের চতুস্পদী কবিতাগুলো অপূর্ব ক্যাব্যিক রসে পরিপূর্ণ। কবি ওমর এবং দার্শনিক ওমর তাঁর দু’টি সত্তাকে একত্রিত করেছেন একই গ্রন্থটিতে। কবিতা রচনা করেছেন এবং দার্শনিক ওমর এসে তাতে মত প্রকাশ করেছেন। তাই ওমর খৈয়ামের কবিতাগুলো গভীরভাবে উপলব্ধি করার মতো। তাঁর কবিতার একদিকে যেমন জীবনবোধ অন্যদিকে অপূর্ব ছন্দে কবিতাগুলো উজ্জল :
“খৈয়াম তুই কাদিস কেন পাপের ভয়ে অযথা ?
দুঃখ করে কেঁদে কি তোর ভরবে প্রাণের শূন্যতা ?
জীবনে যে করলো না পাপ নাই দাবী তোর তার দয়ায়
পাপীর তরেই দয়ার সৃষ্টি, আনন্দ কর ভোল ব্যথা।”
(কাজী নজরুল ইসলাম)
উপরের চতুস্পদীটির প্রতি লক্ষ্য করলে স্পষ্ট বোঝা যাবে যে, কবি ওমর এখানে যুগিয়েছেন অপূর্ব শব্দের সমাহার এবং ছন্দ অন্য দিকে দার্শনিক ওমর এসে তাতে প্রকাশ করেছেন তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি। আর এজন্য প্রতিটি ‘রুবাই’ লাভ করেছে চরম সার্থকতা।
কেউ কেউ মনে করেন ভাবুক ও চিন্তাবিদ ওমর খৈয়াম অবকাশ যাপনের উদ্দেশ্যেই রুবাইগুলি রচনা করেন। রাজনীতিবিদ চার্চিল যেমন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় স্কেচ রচনায় হাত দিয়েছিলেন। ওমর খৈয়াম অবকাশ যাপনের সময় কিংবা উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে অথবা যে কোন কারণেই রুবাইসমূহ রচনা করেন না কেন তবুও এই রুবাইগুলোর মধ্যে ওমরের সুগভীর মুক্ত জ্ঞানবুদ্ধি ও মননশীল দৃষ্টি ভঙ্গি পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে।
জ্যোর্তিবিজ্ঞানী ওমর জীবনে মূলগত সমস্যার পীড়িত হয়েছেন এবং তিনি জীবনের একটা অর্থ ও তাৎপর্য নির্ণয় করতে চেয়েছেন। অন্ধকার এক লোক থেকে মানুষের অকস্মাৎ এই পৃথিবীতে আবির্ভাব মহাকালের তুলনায় অতি অল্পক্ষণের জন্যে এই পৃথিবীর খেলা সাঙ্গ করে মানুষ আবার কোন এক মহাশূন্যলোকে যাত্রা করে। আমরা কোথা থেকে এসেছি, কেন এসেছি, আবার কোথায় চলে যাব- মানব জীবনের এই চির পুরাতন ও চির নতুন রহস্য ওমর উম্মোচিত ও উদ্ঘাটিত করার প্রয়াস পেয়েছেন :
“কোথায় ছিলাম কেনই আসা এই কথাটা জানতে চাই,
জন্ম কালে ইচ্ছাটা মোর কেউতো তেমন শুধায় নাই।
যাত্রা পুনঃ কোন লোকেতে ? প্রশ্নটা মোর মাথায় থাক।
ভাগ্যদেবীর ক্রুর পরিহাস পেয়ালা ভরে ভোলাই যাক।
(কান্তি ঘোষ-৩০)

ওমর উপলব্ধি করেছেন, এই জগতে মানুষের আসা যাওয়া নিতান্ত অর্থহীন। কোন এক অন্ধকার লোক থেকে মানুষ এ জগতে আর্বিভূত হয়, তারপর স্বল্পকাল পর আবার মহাকালের কোলে বিলীন হয়ে যায়।
মানুষ হিসেবে এ রূপ-রস-গন্ধময় পৃথিবীতে এসে ওমর ধন্য। সত্য শিব সুন্দরের প্রতিফলন ঘটেছে তার কাব্যে। এ আনন্দ মেলায় কাঁটার মত একটি বেদনা তাকে অহরহ বিদ্ধ করছে। জীবন ক্ষণস্থায়ী, যেতে না চাইলেও যেতে হবে। এ জীবনের সমান্তি মৃত্যু। পরজন্মে তিনি বিশ্বাসী নন।
“হায়রে হৃদয়, ব্যথায় যে তোর ঝরিছে নিতুই রক্তধার,
অন্তরে নেই তোর এ ভাগ্য বিপর্যয়ের যন্ত্রনার।
মায়ায় ভুলে এই সে কায়ায় আনলি কেন রে অবোধ
আখেরে যে ছেড়ে যেতে হবেই এ আশ্রয় আবার।
(কাজী নজরুল ইসলাম)

ওমর জীবনবাদী শুধুমাত্র কামার্ত মাংসলোলুপ যৌবন বন্ধনাকারী তিনি নন। সর্বদেশের সকল কালের কবি শিল্পীই এই প্রাণের সত্ত¡া গতিশীল যৌবনেরই অপর নাম জীবন। জীবন ব্যর্থ নয়, মিথ্যা নয়, এর সর্ব সার্থকতা প্রেমে-দানে ও গ্রহণে। প্রেমই আনন্দ, আনন্দই প্রেম। মর্তমানবের এ সার্থকতা জীবনের সর্বত্র সর্বস্তরে। বিবেকানন্দ বলেছেন, “জীবে প্রেম করে যেই জন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর”। খৈয়াম দয়া নয়, অনুকম্পা নয়, এ বিশ্বভ্রমাÐে প্রেম দানের বলে মনে করেন :
“কারুর প্রাণে দুঃখ দিওনা কারো বরং হাজার পাপ
পরের মনে শান্তি নাশি বাড়িও না আর মনস্তাপ।
অমর আশিস লাভের আশা কর যদি হে বন্ধু মোর
আপনি সয়ে ব্যথা মুছে পরের বুকের ব্যাথার ছাপ।”
(কাজী নজরুল ইসলাম)

জীবনের যদি কোন মূল্যই নেই তবে জীবনে ত্যাগ কিসের ? জীবনকে চুটিয়ে ভোগ করে নাও।
“মদপিও আর ফুর্তি করো আমার সত্য আইন এই
পাপ পূর্ণের খোঁজ রাখিনা স্বতন্ত্র মোর ধর্ম সেই।”
এ জগতের সকল কিছু অনিত্য এবং মৃত্যুর পর কি আছে তা কবির অজ্ঞাত। তাই তিনি ক্ষণবাদী দর্শনে উপনিত হয়েছেন।
“সব ক্ষণিকের আসল ফাঁকি সত্য-মিথা কিছুই নয়।”
এই দুনিয়ার কোন কিছুরই মূল্য নেই, কোন কিচুর অর্থ নেই। সুতরাং এই অর্থহীন দুনিয়ায় মানুষ এক রাত্রির মুসাফির মাত্র। ওমর আনন্দে বিভোর হতে চেয়েছেন। এই দুনিয়ার সরাই খানার এক রাত্রির মুসাফিরের পক্ষে সুরাপান করে সাকির সাথে বিলাসলীলায় মত্ত হয়ে সময়টুকু কাটানোই সব চেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। তাই ওমর তাঁর রুবাইসমূহে জীবনের জয়গান গেয়েছেন। ভোগ করতে বলেছেন জীবনকে।
সংক্ষেপে ওমরের বাণী হচ্ছেÑ এইক্ষণকালীন জীবনে :
“নগদ যা পাও হাত পেতে নাও,
বাকীর খাতায় শূন্য থাক।”

এই নিখিল শান্তির মধ্যে ওমর মানুষের জন্য কোন মিথ্যে শান্তনা বা আশ্বাসের বাণী বহণ করে আনেননি। জগৎ জীবনকে আসার জেনেও তিনি একে আনন্দ স্বরূপে গড়ে তুলতে চেয়েছেন। তাই তিনি প্রকৃতির পটভূমিতে সুরা ও সঙ্গী নিয়ে মশগুল হতে চেয়েছেন :
“আবার যখন মিলবে হেথায় শারাব সাকির আঞ্জামে
হে বন্ধুদল, একটি ফোটা অশ্রæ ফেলো মোর নামে।
চক্রাকারে পাত্র ঘুরে আসবে যখন সাকির পাশ,
পেয়ালা একটি উল্টে দিও স্মরণ করে খৈয়ামে।”
(কাজী নজরুল ইসলাম - ১৯১)
অতএব, ওমর জীবনকে বিফল হতে দিতে নারাজ। জীবনের যদি কোন অর্থই না থাকে তবে সেই নিরর্থক জীবনকে অনর্থক বিফল হতে দেয়ায় কি লাভ ? তারচেয়ে জীবনকে ভোগ করাই শ্রেয়। ত্যাগে নয়, ভোগেই জীবনের সার্থকতা। এটাই ওমরের জীবন দর্শন। সুতরাং ওমরের রুবাইসমূহ তাঁর জীবনমুখী মনোভাবের পরিচায়ক একথা সত্য।

ওমর খৈয়াম উঁচুদরের বিজ্ঞানী ও দার্শনিক। তাঁর মধ্যে তাই বিন্যস্ত হয়েছে উচ্চ মাপের আধুনিকতা। যেখানে মানবগুরু আধুনিকতার মাপকাঠি হয়ে উঠেছেন। ‘মানুষে আল্লাহ ভজি’ এবং ‘সেই নিরাকার কেন আকাশে’; শুধু মানুষ কেন কুল মখলুকাতে কত জীবজন্তু, প্রাণী, তাদের কথাও ভাবতে হবে প্রকৃতি বাহার চন্দ্র সূর্য এবং পাতাল পরিধি একাকার। খসরু, রুস্তম, হাতিম তাঈ প্রমুখ ব্যক্তিত্বের উল্লেখ করে ওমর খৈয়াম মানব গুরুত্বের কথাও আহŸানের সুরে প্রতিধ্বনিত করেছেন। এই প্রতিধ্বনি আধুনিকতার স্মারক হয়ে উঠেছে যেন, যখন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও তাকে ‘মডার্ন’বলেছে। ওমরকে দেখে মনে হয় কোনও বিংশ শতাব্দীর কবিও বুঝি এত ‘মর্ডান’ হতে পারেন না।’ যখন তিনি উপমা দেন একজন আধুনিক কবির ধরণে যে, ‘মনে ব্যথার বিনুনি মোর খোঁপায় যেমন তোর চুনোট’ তখন আর কোন ও সংশয় থাকেনা।” (আওলাদ হোসেন, ওমর খৈয়াম ঃ মর্মবাণী ও জীবন রহস্য, পড়শী প্রকাশনী, ঢাকা, পৃষ্ঠা -১৩)।

ওমর খৈয়ামের কাব্য থেকে তাঁর মন ও মানসের যে পরিচয় পাওয়া যায় তাতে তাঁর দার্শনিক মতবাদ সম্পর্কিত গ্রন্থি জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে বলেই মনে হয়। কারণ তাঁর রুবাইয়াতে বহু কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক ও পÐিত তাদের চিত্তসত্ত¡ার প্রতিফলন উপলব্ধি করেছেন। আসলে ওমর ছিলেন জ্ঞানের সমুদ্র। যে সমুদ্রের জল নানা জনে নানান প্রয়োজনে ব্যবহার করেছেন। ওমর খৈয়ামের প্রতিটি রুবাই এর মধ্যে কোন না কোন দর্শন প্রকাশ পেয়েছে। কাব্যরসতো আছেই।
“আজ আছে তোর হাতের কাছে আগামী কাল হাতের বার,
কালের কথা হিসাব করে, বাড়াসনে তুই দুঃখ আর
স্বর্গ ক্ষরা ক্ষণিক জীবন করিসনে তার অপব্যয়।”
(কাজী নজরুল ইসলাম)

এখানে কবি ওমরের দর্শন চার্বাক পন্থী বলে মনে হয়। আসলে ওমরের দর্শন চার্বাক পন্থীদের মত নয়। মানুষ হিসেবে এ রূপ রসগন্ধ ভরা পৃথিবীতে এসে ওমর ধন্য। সত্য শিব সুন্দরের প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর কাব্যে। এ আনন্দ মেলায় কাঁটার মত একটা বেদনা অহরহ বিদ্ধ করছে জীবন ক্ষণস্থীয়ী, যেতে না চাইলেও যেতে হবে। এ জীবনের সমাপ্তি মৃত্যু। পরজন্মে তিনি বিশ্বাসী নন।
“হায়রে হৃদয় ব্যথার যে তোর ঝরিছে নিতুই রক্তধার
অন্তু যে নেই তোর এ ভাগ্য বিপর্যয়ের যন্ত্রনার।
মায়ায় ভুলে এই সে কায়ায় আনলি কেনরে অবোধ,
আখেরে যে ছেড়ে যেতে হবেই এ আশ্রয় আবার।
(কাজী নজরুল ইসলাম)
সুতরাং যতো দর্শন, বিজ্ঞান, গণিত আর জ্যোতিষ চর্চা ওমর করে থাকুন না কেন অদৃষ্টের অপরিবর্তনীয় লিপি আর অবধারিত শেষ পরিণাম মৃত্যু সম্পর্কে তাঁর ধারণা স্থির অনড়। কারণ বাহ্যিক জীবনের অনেক রহস্যের মুক্তি ঘটলে জীবন-মৃত্যু সৃষ্টি তত্তে¡র ব্যাখ্যা আজও আমাদের অজ্ঞাত।
দার্শনিক ওমর তাঁর কবিতার ভাষায় এই রহস্যের কারণ খুঁজেছেন। ব্যর্থ হয়েছেন বার বার। তাই তার কাছে মনে হয়েছে স্রষ্টা সৃষ্টি সব কিছুই মিথ্যা। আবার খানিক পরেই স্বীকার করেছেন সব কিছুরই অস্তিত্ব আছে। যদিও তিনি সঠিক কোন সিদ্ধান্তে উপনিত হতে পারেননি। তবুও জীবন ব্যর্থ নয়-মিথ্যা নয়। এর সর্ব সার্থকতা প্রেমে- দানে ও গ্রহণে, প্রেমই আনন্দ, আনন্দই প্রেম-
“মরুর বুকে বসাও মেলা, উপনিবেশ আনন্দের,
একটি হৃদয় খুশি করা তাহার চেয়ে মহত্বের।
প্রেমের শিকল পরিয়ে যদি বাঁধতে পার একটি প্রাণ
হাজার বন্দী মুক্ত করার চেয়েও অধিক পূণ্য এর।”
(কাজী নজরুল ইসলাম)

এখানে ওমর খৈয়াম একজন রোমান্টিক কবি। তাঁর কাব্য দর্শনের ছোঁয়ায় আরো উজ্জ্বল। পরিশেষে আমাদের একথা বলতে দ্বিধা নেই যে, ওমর একজন কবি ও দার্শনিক ছিলেন এবং কবি ওমর এবং দার্শনিক ওমর মিলিতভাবে রচনা করেছেন রুবাইসমূহ। তাঁর কাব্যপাঠান্তে এটাও স্পষ্ট যে, ওমর খৈয়াম এ মধুময় পৃথিবীকে ভালবেসেছেন। ভালবেসেছেন ভাগ্যের হাতের ক্রীড়ানক পৃথিবীর সকল প্রাণী জগৎকে। জয়ধ্বনি করেছেন, যৌবনের প্রশান্তি গেয়েছেন, স্রষ্টার নিষ্ঠুর নিয়তিকে মেনে নিয়েছেন, অবধারিত মৃত্যুকে করেছেন স্বীকার। ধরার ধূলোয় বসে ধরনীর জয়গান গেছেন। ওমর খৈয়ামের সঙ্গে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মিল সেখানেই।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (3)
Anonymous ৫ জুন, ২০১৯, ১১:১২ এএম says : 0
"Kazir onubad sokol onubader kazir" It's originally a quote by Syed Mustafa Ali not awlad Hussein.... Correction required!
Total Reply(0)
....দেব ৫ জুন, ২০১৯, ১২:২১ পিএম says : 0
"কাজীর অনুবাদ সকল অনুবাদের কাজী" এটা আওলাদ হোসেনের উক্তি নয় বরং সৈয়দ মুজতবা আলির উক্তি।সংশোধন করুন
Total Reply(0)
মো ঃ মাহবুবুল আলভ ৬ মার্চ, ২০২২, ১:৫৪ পিএম says : 0
সব কবিদের একটা বিষয়ে গভীর মিল খুঁজে পাওয়া যায় তা হল নিজেকে খুঁজে পাওয়া। আর এই নিজেকে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার মুল উৎস হল বিশ্বাস আর এই বিশ্বাসের মুল উৎস হল সত‍্য জ্ঞান অর্জন আর এই সত‍্য জ্ঞান অর্জনের মুল উৎস হল স্রষ্টা পদত্ত জ্ঞান বা পবিত্র কোরআন। আমি তো কিছুই ছিলাম না কিন্তু আমার আগেই স্রষ্টা সবই আমার জন‍্য দিয়ে রেখেছেন। যদি আমার চর্মচোখে দেখি অন্তর চোখে উপলদ্ধি করি তাহলে সব কিছুই পরিস্কার কোথায় আমাদের পরফর্তী অবস্থান। কিন্তু তা এই ধরাধাম থেকেই স্রষ্টার নির্দেশিত পথ থেকে খুঁজে নিতে হবে। আমার আপনার দর্শন মিথ্যে হতে পারে কিন্তু স্রোষ্টার সৃষ্টি মিথ্যা নয়। এবং আমাদের গন্তব্যে তাঁরই নিকট যেখান থেকে এসেছি। ভুল বললে ক্ষমা করবেন
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন