সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

ঈদে বেপরোয়া চাঁদাবাজি

সেলামি ও অনুষ্ঠানসহ নামে-বেনামে টাকা আদায়

আবদুল্লাহ আল মামুন | প্রকাশের সময় : ২ জুন, ২০১৯, ১২:৪৩ এএম

ঈদ বকশিশের নামে রাজধানীসহ সারাদেশে চলছে বেপরোয়া চাঁদাবাজি। বড় ব্যবসায়ী থেকে ফুটপাথের ক্ষুদে দোকানী, এমনকি পরিবহন সেক্টরেও চলছে চাঁদাবজির মহোৎসব। রাজনৈতিক ক্যাডার থেকে পাড়া মহল্লার মাস্তানরা আদায় করছে চাঁদার টাকা। পেশাদার শীর্ষ চাঁদাবাজদের নাম ব্যবহার করছে মৌসুমী চাঁদাবাজরা। ঈদ সেলামী, ইফতার মাহফিল, জাকাতের কাপড় কেনা, গরীবদের সহায়তা, ঈদ পরবর্তী নানা অনুষ্ঠানের নামে চলছে কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি। কোথাও ব্যবসায়ীদের অস্ত্রের ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। এসব চাঁদাবাজদের প্রতিরোধে পুলিশের শীর্ষ পর্যায় থেকে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করা হলেও চাঁদাবাজি চলছেই।

গত কয়েকদিন রাজধানীর নিউমার্কেট, খিলগাঁও, মালিবাগ, গুলিস্তান, ইসলামপুর কেরানীগঞ্জ, মিরপুর, ফার্মগেট, উত্তরা, টঙ্গী ও পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকার মার্কেট ঘুরে এবং ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে চাাঁদাবাজির বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। এছাড়া দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী, পলাতক ও সাজাপ্রাপ্ত সন্ত্রাসীদের নাম ব্যবহার করে চাঁদা আদায় করছে শিষ্যরা।

ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট সূত্রের হিসাব মতে, সরকারি তথ্যে রাজধানীতে প্রায় ১৪৭টি শপিংমল থাকার কথা বলা হলেও বাস্তবে এ সংখ্যা আরো অনেক বেশি। এসব শপিংমলে অন্তত লাখ খানেক ব্যবসায়ী ব্যবসা করেন। এর বাইরে ফুটপাথে রয়েছে আরও কয়েক লাখ ছোট ব্যবসায়ী। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যবসাভেদে প্রত্যেকের কাছ থেকে সর্বনিম্ন ৫ হাজার টাকা থেকে শুরু করে লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা নেয়া হচ্ছে। অভিজাত এলাকার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে আরও কয়েকগুন বেশি। আর ফুটপাথ থেকে সর্বনিম্ন ২০০ টাকা থেকে নেওয়া হচ্ছে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত।

গুলিস্তানের ফুটপাথের দোকানী শাহ আলম বলেন, ফুটপাথের দোকানদারদের কাছ থেকে সর্বনিম্ন ২০০ টাকা সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে। টাকা না দিলে দোকান বসাতে বাধা দেয়। এছাড়া টাকা না দিলে পুলিশও ঝামেলা করে বলে তিনি অভিযোগ

করেন। নিউমার্কেটের পোশাক ব্যবসায়ী সুমন বলেন, ক্ষমতাসীন দলীয় নেতাকর্মীরা নামে বেনামে, ঈদ সেলামী ও ঈদ পরবর্তী অনুষ্ঠানসহ বিভিন্নভাবে টাকা তুলছে। টাকা না দিলে নেতারা কল করে অথবা সশরীরে এসে প্রভাব দেখিয়ে টাকা আদায় করছে। ফার্মগেটের হকার ইউসুফ আলী বলেন, গত বছর যারা চাঁদা নিত, তাদের সাথে এ বছর আরও কয়েকটি নতুন গ্রুপ যুক্ত হয়েছে। উঠতি মাস্তানরাও জোর করে ভয় দেখিয়ে টাকা নিচ্ছে।
পুরান ঢাকার ইসলামপুরের বড় ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বাপ দাদার জায়গায় ব্যবসা

করলেও অসাধু সিন্ডিকেটকে বিপুল অঙ্কের টাকা চাঁদা দিতে হয়। বিভিন্ন স্লিপে টাকার অঙ্ক বসিয়ে দোকানে দিয়ে যাওয়া হয়। কেউ নির্ধারিত টাকা দিতে অনীহা প্রকাশ করলে ভয়ভীতি দেখানো হয়। এছাড়া বেশিরভাগ ব্যবসায়ী নিরাপত্তা শঙ্কা চিন্তা করে প্রতিরোধ করেন না।

ইসলামপুরের থান কাপড় ব্যবসায়ী মোবিন আহমেদ বলেন, চাঁদা না দিলে ঝামেলা আরও বেশি। তখন ব্যবসা করতে নানাভাবে বাধা দেওয়া হয়। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, কোন ব্যবসায়ীকে কয়েক লাখ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এক শ্রেণির অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে এসব সিন্ডিকেটে জড়িত থাকায় অভিযোগ করলে উল্টো আরও ক্ষতি হয়।
বাংলাদেশ হকার ফেডারেশনের তথ্য অনুযায়ী সারাদেশের সিটি করপোরেশন, বন্দর, হাটবাজার ও জেলা-উপজেলার নিবন্ধনকৃত হকারের সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। এর মধ্যে শুধুমাত্র রাজধানীতে প্রায় এক লাখের উপরে হকার। এর বাইরে অনিবন্ধিত ও মৌসুমী হকার রয়েছে আরো কয়েক লাখ। ক্ষমতাসীন ও প্রভাবশালী নেতাদের নাম ভাঙ্গিয়ে চাঁদা নেওয়া হয়।

বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের সভাপতি আবুল কাশেম বলেন, হকারদের কাছ থেকে চাঁদা তোলার জন্য প্রতিটি ফুটপাথে আলাদা আলাদা লাইনম্যান আছে। রমজানের শুরু থেকে ঈদের আগ পর্যন্ত চাঁদাবাজি চলতে থাকে। ঈদের আগে চাঁদার পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়।
এদিকে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি পরিবহন সেক্টরেও এক শ্রেণির চাঁদাবাজদের দৌরাত্মে নাজোহাল অবস্থা। প্রতি বছর ঈদের আগে টার্মিনাল ও ফেরিঘাট ঘিরে এসব চক্র সক্রিয় উঠে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া ও ঢাকায় প্রবেশকালে চাঁদা দিতে হয়। এছাড়া ট্রাফিক পুলিশও কাগজপত্র চেক করার নামে অহেতুক হয়রানি করা টাকা আদায় করে। ভুক্তভোগী চালকরা বলেন, প্রতি বছর ঈদের আগে নির্দিষ্ট পয়েন্ট ছাড়া আরও

শ’খানিক নতুন পয়েন্টে চাঁদা দিতে হয়। টাকা না দিলে গাড়ি আটকে অযথা হয়রানি করে। রাজধানীর সায়েদাবাদ টার্মিনালে বেপরোয়া চাঁবাজির অভিযোগ করেছেন মালিকরা। জানা গেছে, সায়েদাবাদে রুটভিত্তিক চাঁদাবাজি অতীতের তুলনায় অনেক বেড়েছে। মালিক ও শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সায়েদাবাদে যে সব রুটে সবচেয়ে বেশি চাঁদাবজি হয় তার মধ্যে রয়েছে, নবীনগর রুট, লাকসাম-কুমিল্লা রুট, বরিশাল-কুয়াকাটা-তালতলী
রুট, কিশোরগঞ্জ রুট, সিলেট রুট, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা রুট। এসব রুটে একেকজনের নেতৃত্বে চাঁদার টাকা তোলা হচ্ছে প্রকাশ্যে। নবীনগর রুটে দেড়শ গাড়ি থেকে সাড়ে ৫শ’ টাকা করে চাঁদা তোলে আক্তার ও দেওয়ানের লোকজন। আগে এই চাঁদার পরিমান ছিল ৩শ’ টাকা।
কালামের নেতৃত্বে লাকসাম-কুমিল্লা রুটের চাঁদার পরিমাণও বেড়ে গেছে। আগে এই রুটে গাড়ি প্রতি চাঁদার পরিমাণ ছিল ৬শ’ টাকা। ঈদকে কেন্দ্র করে তা বেড়ে হয়েছে ৮শ’ টাকা।

বরিশাল রুটে চাঁদা তোলের জাহাঙ্গীর লোকজন। আগে ৩৮০ টাকা করে চাঁদা তোলা হলেও ঈদকে কেন্দ্র করে চাঁদা তোলা হচ্ছে ৬শ’ টাকা করে। কিশোরগঞ্জ রুটের চাঁদা তোলে তৈয়ব আলী। আগে ৪২০ টাকা করে চাঁদা তোলা হলও ঈদকে সামনে রেখে আরও দুশ’ টাকা বেড়েছে। সিলেট রুটের চাঁদা ওঠে আরিফের নেতৃত্বে। দেড়শ’ গাড়ি থেকে প্রতিদিন সাড়ে ৫শ’ টাকা করে চাঁদা তোলা হচ্ছে। চট্টগ্রাম রুটের ৩ শতাধিক গাড়ি থেকে ১২শ’ টাকা করে চাঁদা তোলা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। চাঁদা তোলার দায়িত্বে রয়েছেন সেলিম ও সরোয়ার। আর কুমিল্লা রুটের গাড়ি থেকে চাঁদা তোলা হচ্ছে খায়ের, কাইল্ল্যা খোকন, জ্বিন জাকির, রাজিব, রাজু ও শমসেরের নেতৃত্বে। সাধারণ মালিকরা অভিযোগ করে বলেন, টার্মিনালের সেক্রেটারি পড়ে জাহাঙ্গীর দায়িত্ব নেয়ার পর টার্মিনালের চাঁদাবাজি বেড়ে গেছে। ঈদকে সামনে রেখে এখন তা বেপরোয়া হয়ে গেছে। এখানে চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করার মতো কেউ নেই। প্রতিবাদ করলেই গাড়ি বের হতে বাধা দেয়া হয়।

এদিকে, রোজা ও ঈদকেন্দ্রিক চাঁদাবাজদের প্রতিরোধে গত ২৬ মে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী। তিনি সড়ক ও মহাসড়কে চাঁদাবাজি বন্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণের জন্য সারা দেশের পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টসমূহে সিসিটিভি স্থাপন, ট্রাক, পিকআপ এবং পণ্যবাহী ট্রাকে যাত্রী পরিবহণরোধ এবং সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া মহাসড়কে যানবাহন না থামানোর নির্দেশ দিয়েছেন। যদিও এসব নির্দেশনার বাস্তব প্রতিফলন নিয়ে বরাবরের মতো প্রশ্ন রয়ে গেছে।

এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানা বলেন, ঈদকে সামনে রেখে অনেক অসাধু চক্র চাঁদাবাজি করে। তাদের প্রতিরোধে আইন শৃঙ্খলাবাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক ও তৎপর আছে। তারপরেও কিছু অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটছে। তিনি ভুক্তভোগীদের পুলিশ সদর দফতরে অভিযোগ জানাতে আহবান জানান। ##

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (12)
রুবি আক্তার ২ জুন, ২০১৯, ১২:৪৪ এএম says : 0
Absolutely right.... Sir.....
Total Reply(0)
Ezazul Haque ২ জুন, ২০১৯, ১২:৪৪ এএম says : 0
ভাই কাকে কি বলবো । আমাদের প্রশাসন আর কর্তাবাবুরা কথায় খুব পটু বাট কাজে আসে শুধু ক্যামরায় মুখটা দেখায় আর বকবক করে চলে যায় ।
Total Reply(0)
ওয়াছেল ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ২ জুন, ২০১৯, ১২:৪৫ এএম says : 0
দেশের সকল শ্রেণির কর্মকর্তারায় দুর্নীতি চাঁদাবাজি নিয়ে ব্যস্ত।কার বিচার কে করবে,যার কাছে বিচার দিবেন সেও চোর।
Total Reply(0)
Mohin Mohammad ২ জুন, ২০১৯, ১২:৪৫ এএম says : 0
আমরা সাধারন মানুষ এদের হাত থেকে রেহাই পাবো না?
Total Reply(0)
Mohin Mohammad ২ জুন, ২০১৯, ১২:৪৬ এএম says : 0
এজন্য মানুষ এখন বলে বড় চাঁদাবাজ হচ্ছে পুলিশ।কারণ সদর ঘাটের কুলাঙ্গারদের মাস্তানির কথা এপর্যন্ত অনেক সাংবাদিক,এবং সাধারন জনগন পুলিশকে বিষয়টি অবগত করলেও তারা এব্যাপারে কোন একশান নেয়নি,নিবে কিভাবে তাহলেতো গরিব দুখীদের টাকা দিয়ে তাদের পকেট বরতে পারবে না।
Total Reply(0)
Md. Mofazzal Hossain ২ জুন, ২০১৯, ১২:৪৬ এএম says : 0
প্রশাসনের বিছার আল্লাহ করুক,যাতে প্রশাসনের বিছার দুনিয়ার মানুষ করতে ব্যর্থ তাই আল্লাহর কাছে বিছার দিলাম,আল্লাহ তাদের হেদায়েত দিন না হলে ধ্বংশ করে দিন।কারণ এদের চোখের সামনে সদর ঘাটের এ কুলাঙ্গাররা আমাদের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে।টাকা না দিলে,এরা ব্যাগ নিয়ে লঞ্চে উঠতে বা নামতে দেয়না,আরো একশ বা দুইশ টাকা না এরা চায় ৫০০,১০০০,২০০০,৫০০০ টাকা। টাকা না দিলে গালাগালি,ব্যাগ নিয়ে টানা হিচড়া,মারধোর এছাড়া বিভিন্ন অত্যাচারের শিকার হতে হয়।নিজের ব্যাগ নিজে বহন করি তারপরও তারা বেশি টাকা না দিলে আমাদের সাথে এমন করে।আর বাইরে পুলিশ তাদের থেকে এ টাকার ভাগ নেয়।
Total Reply(0)
Mahmudul Hasan Shah Aziz ২ জুন, ২০১৯, ১২:৪৭ এএম says : 0
দীর্ঘদিন ধরে এদের দৌরাত্ম্য ও জন দূর্ভোগ দেখা সত্বেও এই বিষয়ে কর্তৃপক্ষের এড়িয়ে যাওয়া ও কর্নপাত না করায় এদের (কর্তৃপক্ষের) প্রতি তীব্র নিন্দা জানাতে বাধ্য হলাম।
Total Reply(0)
Md Neaz Morshed ২ জুন, ২০১৯, ১২:৪৭ এএম says : 0
এটা যুগ যুগ ধরেই হচ্ছে, বহু লেখা লেখছে কোনো লাভ হয়নি অার হবেও না।
Total Reply(0)
Abul Kalam Polash ২ জুন, ২০১৯, ১২:৪৮ এএম says : 0
এই গুলি ডাকাত! এদের সব কটাকে জেলে দেওয়া দরকার! কিন্তু সম্ভব না! কারণ এদের ডাকাতির একটা বড় অংশ পায় নেতা ও প্রশাসন!
Total Reply(0)
Alamgir Sikder ২ জুন, ২০১৯, ১২:৪৯ এএম says : 0
বালা দেশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সব সময়ের জন্য এই হয়রানির প্রতিকার চাই।
Total Reply(0)
Joglul Kabir ২ জুন, ২০১৯, ১২:৪৯ এএম says : 0
চাঁদা বাজিদের শায়েস্তা করার দায়িত্ব জনগনকে নিতে হবে।
Total Reply(0)
Jewel Ahmed ২ জুন, ২০১৯, ১২:৫০ এএম says : 0
দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার সরকারের,,,কারন এরা সরকারের প্রসাশনিক ভাবমূর্তি নষ্ট করছে,,
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন