শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

কৃষকের দুর্দিনের ঈদ

মহিউদ্দিন খান মোহন | প্রকাশের সময় : ৪ জুন, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

বিশ্ব মুসলিম জাহানের সবচেয়ে বড় আনন্দ উৎসব ঈদুল ফিতর। একমাস সিয়াম সাধনার পর ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ পালন করবেন পবিত্র ঈদুল ফিতর। প্রতি বছর এ দিনটি আমাদের জন্য অনাবিল আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে। শেষ রোজার ইফতারের পর যখন বেতার টেলিভিশনে বেজে উঠে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই কালজয়ী ঈদ-সঙ্গীত ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’- তখনই ঈদের আবহ ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, কবি নজরুলের এই সঙ্গীতটি যেন আমাদের ঈদের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। গানটি শুনলেই একটি অন্যরকম অনুভ‚তি কাজ করে অন্তরে। নজরুল তাঁর এ গানে ঈদের তাৎপর্য, মহিমা এবং মুসলমানদের দায়িত্ব-কর্তব্য অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেছেন। এ গানটির মর্মবাণী যারা সম্যক উপলব্ধি করতে পারেন, তাদের কাছে ঈদের অর্থটাই বদলে যায়। নজরুল তাঁর এ গানে খুশির ঈদে আপনাকে অর্থাৎ নিজেকে বিলিয়ে দিতে আসমানী তাগিদ অর্থাৎ আল্লাহর নির্দেশের কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি আহ্বান জানিয়েছেন সোনা-দানা বালাখান সব জাকাত দিয়ে মৃতপ্রায় মুসলিম জাহানের ঘুম ভাঙাতে। তিনি দোস্ত-দুশমন ভুলে গিয়ে হাতে হাত মিলাতে বলেছেন, আহ্বান জানিয়েছেন প্রেম দিয়ে বিশ্ব নিখিলকে ইসলামে শামিল করার কথাও বলেছেন। হৃদয়ের তস্তুরিতে (পিরিচ) তৌহিদের ফিরনি বিতরণের জন্য সবাইকে উদ্বুদ্ধ হতে বলেছেন। জাতীয় কবির এ গানটি যে ঈদ সম্পর্কে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুল (সা.) এর নির্দেশনারই সারসংক্ষেপ তা নতুন করে বলার দরকার পড়ে না।

কিন্তু বাস্তবতা যে সেরকম নয় তা অস্বীকার করবে কে? সমাজে ধনী-দরিদ্রের যে বৈষম্য প্রতিনিয়ত বাড়ছে, তার প্রতিবিধানের কোনো উপায়ই যেন নেই। অথচ ইসলাম সে সমস্যারও সমাধান দিয়েছে যাকাত আদায়ের নিয়ম প্রবর্তন করে। যাকাত আমাদের দেশে অনেকেই দেন। কিন্তু ধনবান সে ব্যক্তিরা ইসলামের নির্দেশনাকে পুরোপুরি অনুসরণ করে যাকাত আদায় করেন কি না তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সাধারণত ঈদুল ফিতরেই আমাদের দেশে যাকাত আদায়ে করে থাকেন বিত্তবান মানুষেরা। তবে, ইসলামের বিধানকে সুচারুরূপে অনুসরণ করে ক’জন যাকাত আদায় করেন তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। সাধারণত যাকাত হিসেবে দরিদ্রদের মধ্যে শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণ করে থাকেন তারা। আর তা বিতরণ করতে গিয়ে বাড়ির সামনে দরিদ্র মানুষের প্রচন্ড ভীড় জমিয়ে হৈ হট্টগোল বাঁধিয়ে দেন। এ থেকে মর্মান্তিক ঘটনাও কম ঘটেনি। একটি শাড়ি বা একটি লুঙ্গি কিংবা কাগজের একটি নোট পেতে দরিদ্র মানুষের হুড়োহুড়িতে পায়ে পিষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে অনেক। অথচ ওই ধনবান ব্যক্তি চুপিসারেই তার এ দানকর্ম সম্পাদন করতে পারতেন। কিন্তু তাদের কাজকর্ম দেখলে মনে হয়, হৈ চৈ না করে যাকাত আদায় করলে তা বোধকরি আল্লাহ্র গোচরে আসবে না। কিন্তু তারা বোঝে না যে, লোক দেখানো দান-খয়রাতের চেয়ে নিরবে নিভৃতে দান করাকেই আল্লাহ্ পছন্দ করেন বেশি। পর পর কয়েকটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর অনেকেই এখন ঢাক-ঢোল পিটিয়ে যাকাত দেয়া বন্ধ করেছেন। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, রমজান মাস এলেই গণমাধ্যমে ‘যাকাতের শাড়ি বা লুঙ্গি’ বিক্রির বিজ্ঞাপন দেখা যায়, বিভিন্ন দোকানে ব্যানার ঝুলতে দেখা যায়- ‘এখানে যাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি পাওয়া যায়’। এসব শাড়ি লুঙ্গি হয়ে থাকে অত্যন্ত নিম্নমানের; যা ব্যবহারের প্রায় অনুপযোগী। প্রশ্ন হচ্ছে যাকাতের শাড়ি বা লুঙ্গির কি কোনো বিশেষ মানদন্ড আছে? ওগুলো কম দামী এবং নিম্নমানের হতে হবে এমন কোনো বিধান আছে কি? ভালো মান এবং বেশি মূল্যের শাড়ি লুঙ্গি কি যাকাত হিসেবে দেওয়া যায় না? যাবে না কেন? অবশ্যই যায়। তবে, আমাদের সমাজের এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে এ ধারণা বেশ শক্তভাবেই প্রোথিত হয়ে আছে যে, যাকাত মানেই দয়ার দান; তা কোনো রকম হলেই হলো। কিন্তু যাকাত যে শ্রেফ দয়ার দান নয়, তা কোরান-হাদীসে সুস্পষ্টই উল্লেখ করা আছে। যাকাত হলো ধনীদের সম্পদের ওপর দরিদ্রের হক; যা তারা কড়ায় গন্ডায় আদায় করতে বাধ্য। এটাই ইসলামের বিধান। আর এজন্যই ইসলাম সাম্যের ধর্ম হিসেবে সমাদৃত। সম্পদের সুষম বণ্টনের মাধ্যমে ধনী-গরীবের ব্যবধান কমিয়ে আনার জন্যই ইসলাম এ বিধান চালু করেছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, আমরা সে বিধান মেনে চলতে চাই না, কখনো কখনো তা উপেক্ষা করতেও দ্বিধা করি না। সমাজে আজ যে অসাম্য বিরাজ করছে, বিশৃঙ্খলার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে, তার পেছনে রয়েছে এসব ধর্মীয় মূল্যবোধকে এড়িয়ে চলার প্রবণতা।

বাংলাদেশে এবার এমন এক সময়ে ঈদুল ফিতর এসেছে, যখন সঙ্কটের আবর্তেই আমরা ঘুরপাক খাচ্ছি। ঈদের আনন্দে সবার মেতে ওঠার কথা থাকলেও দেশের বিরাট একটি জনগোষ্ঠী সে আনন্দ থেকে এবার বঞ্চিত থাকছে এটা অস্বীকার করা যাবে না। দেশের একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল প্রতি ঈদের পরদিন ‘কৃষকের ঈদ আনন্দ’ নামে একটি অনুষ্ঠান প্রচার করে থাকে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদের নিয়ে নির্মিত সে অনুষ্ঠানটি নিঃসন্দেহে উপভোগ্য হয়। কিন্তু এবার সে অনুষ্ঠানটি কতটা উপভোগ্য হবে তা নিয়ে অনেকেরই সংশয় রয়েছে। বিশেষত যাদেরকে নিয়ে অনুষ্ঠানটি নির্মিত হয়, তারা কী ঈদের আনন্দ উপভোগ করার মতো মানসিক অবস্থায় আছে? শরীরের ঘাম ঝরিয়ে আর অর্থ বিনিয়োগ করে উৎপাদিত ধানের দাম না পেয়ে যে কৃষক হাঁটে বসে অঝোরে চোখের পানি ফেলেছে, কিংবা রাগে দুঃখে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে স্বরোপিত সোনলী ধানের ক্ষেতে, তার কাছে এবারের ঈদ কী উপভোগ্য হবে?

ধানের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে সারা দেশের কৃষকদের মধ্যে সঞ্চারিত ক্ষোভ হতাশার কথা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। তবে, অবাক না হয়ে পারা যায়নি এ সংকট থেকে উৎপাদক কৃষককে রেহাই দেওয়ার কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত না হওয়ায়। বরং ধানের দাম হ্রাস পাবার দায় উৎপাদক কৃষকের ঘাড়ে চাপানোর হাস্যকর প্রয়াস দেখে বিস্মিত হতে হয়েছে সবাইকে। ‘চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হওয়ায় ধানের দাম কম’- খোদ কৃষিমন্ত্রীর এ বক্তব্য কি কৃষকের কাঁধে দায় চাপানোর প্রয়াস নয়? অভিজ্ঞজনেরা পরামর্শ দিলেন- সংকট মোকাবিলার জন্য সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনার জন্য। সরকারও ঘোষণা করল তা-ই করা হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ফড়িয়া মহাজনরাই সরকারের গুদামে ধান সরবরাহ করছে। এমন কি ধান সরবরাহ করার কাজে নেমে পড়েছে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় কর্মীরাও। এমনই একটি খবর এসেছে পাবনার ভাঙ্গুরা উপজেলা থেকে। গত ১ জুনের একটি দৈনিকের খবরে বলা হয়েছে- উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদুর রহমান তারেক ও সাংগঠনিক সম্পাদক সবুজ হোসেন নয়ন স্থানীয় খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে ধান সরবরাহের স্লিপ আনতে যায়। কর্মকর্তা জানান, স্লিপের মাধ্যমে এখন আর ধান সংগ্রহ করা হবে না। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে সরবরাহকৃত কৃষকদের তালিকা অনুযায়ী ‘আগে এলে আগে নেওয়া হবে’ ভিত্তিতে ধান কেনা হবে। এতে উত্তেজিত হয়ে ক্ষমতাসীন দলের ওই দুই ছাত্রনেতা গুদাম কর্মকর্তাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ এবং তাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয়। এমন ঘটনা যে আরও ঘটেনি তা বলা যাবে না। বরং সামনে এ ধরনের ঘটনার আরো খবর পাবার আশঙ্কাই বেশি। ধানের দাম কমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সবচেয়ে কৌতুককর ঘটনা ছিল ছাত্রলীগ নেতাদের ধান কাটার ফটোশ্যুট। মাথায় গাছা বেঁধে তারা মাঠে গিয়েছিলেন ধান কেটে কৃষককে সাহায্য করতে। এ যেন পেটের অসুখের জন্য চোখের ওষুধ দেওয়া। ধান কাটার সঙ্গে দামের কী সম্পর্ক বোঝা গেল না। এমন যদি হতো মজুরের অভাবে কৃষক ধান কেটে গোলায় তুলতে পারছে না, তাহলে এ মহড়ার তাৎপর্যটা বোঝা যেত। কিন্তু সমস্যা তো সেটা নয়। তাহলে কেন এই অর্থহীন প্রয়াস? এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। তবে, সেসব যে তারা খুব একটা গায়ে মাখছেন না, তা বেশ বোঝা যাচ্ছে।

সত্যিকার অর্থেই দেশের কৃষক এবং কৃষিজীবীরা বর্তমানে চরম দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। উৎপাদিত শস্য বিক্রি করে উৎপাদন খরচও তারা তুলতে পারছে না। অথচ মাথার ওপর তীক্ষ্ন খড়গের মতো ঝুলন্ত রয়েছে মহাজনের পাওনা। সে পাওনা শোধ করতে গিয়ে তারা ধান বিক্রি করে দিচ্ছে উৎপাদন খরচের অর্ধেকেরও কম দামে। অথচ সামনে পড়ে আছে পুরোটা বছর। কী খাবে, কীভাবে দিনাতিপাত করবে, সে ভাবনায় তারা এখন উদভ্রান্ত। ঠিক এমনই সংকটকালে চিরায়ত ঈদ এসেছে তাদের দ্বারেও। কিন্তু তারা কি সে আনন্দ উপভোগ করতে পারবে বরাবরের মতো? গত ১ জুন একটি জাতীয় দৈনিক এ বিষয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এক পাতা জুড়ে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পত্রিকাটির সংবাদদাতারা পাঠিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ভাষ্য। তারা সবাই প্রায় একই কথা বলেছেন। উৎপাদিত ফসলের মূল্যের এমন ধস তাদের ঈদ আনন্দকে ম্লান করে দিয়েছে। তারা বলেছেন, সন্তানদের নতুন কাপড় কিনে দেওয়া দূরের কথা, সেমাই-চিনি কেনার সামর্থ্যও নেই তাদের। দেশের মানুষের মুখের খাবার যারা উৎপাদন করেন, তাদের এ দুর্দশার খবরে কার না হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হবে?

তবে, এটা নিশ্চয়ই অস্বীকার করা যাবে না, এ দেশের কৃষক সমাজের এবারের ঈদ কাটবে অত্যন্ত নিরান্দময় পরিবেশে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতারা মাঠে গিয়ে ধান কেটে কৃষকদের সহায়তা করতে চেয়েছে। সরকার যদি কৃষকদের সহায়তা দিতেই চায়, আসন্ন ঈদকে যদি তাদের কাছে আনন্দময় করে তুলতে চায়, তাহলে তাদের পাশে সরকারের দাঁড়ানো উচিত। প্রয়োজনীয় সাহায্য দিয়ে তাদেরকে ঈদ আনন্দে শামিল করা হলে তা হবে একটি প্রশংসনীয় কাজ। শুধু সরকার নয়, প্রতিটি সামর্থ্যবান মানুষেরই উচিত তার আত্মীয়-অনাত্মীয় প্রতিবেশীদের ঈদ আনন্দে শরিক করার উদ্যোগ নেওয়া। নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার যে আসমানী তাগিদের কথা জাতীয় কবি বলেছেন, তার মর্মার্থ অনুধাবন করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন