মুহাম্মদ আবদুল বাসেত
প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগত জীবনের যেমনি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা চাই, তেমনি দায়িত্ব ও কর্মস্থলের একটি স্বচ্ছ ও সময়োপযোগী কর্মপরিকল্পনা থাকা দরকার। সে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা আবার বাৎসরিক, মাসিক, দৈনিক ও ঘণ্টাসহ বিভিন্ন মেয়াদে বিন্যাস করে নেয়াও সময়ের অপরিহার্য দাবি। যে কথাটুকু এখন আর শুধু বুলিতে সীমাবদ্ধ নয়। সফলকামী অনেকেই তার বাস্তবতাও দেখিয়েছেন। যে কানো কাজের পরিকল্পনা গ্রহণ বাস্তবায়নের অর্ধেক। আবার পরিকল্পনার ক্রিয়াদাংশ পালন হলেও বাকি অর্ধেক বাস্তবায়িত হয়। প্রতিক্ষণ ব্যয় হয় যেন ফলাফলভিত্তিক। যে কাজে যতটুকু সময় ব্যয় করবেন তার ফলটুকুও নিয়ে নিতে সচেষ্ট হবেন। নচেৎ ওই সময় ব্যয় বৃথার নামান্তর হবে।
অবহেলা-অসচেতনতায় না কাটিয়ে প্রতিটি ক্ষণকেই শিক্ষাপোযুক্ত হিসেবে গ্রহণ করা যায়। স্বাভাবিকভাবে শিক্ষার্জনের মাধ্যম দুটি। এক-বই পড়ে, দুই-ভ্রমণের মাধ্যমে। অনেকেই বই পড়া বা জ্ঞান অর্জন করেন শুধুমাত্র চাকরি লাভের জন্য। যেটি নিছক সংকীর্ণতার পরিচায়ক, যা ব্যক্তিকে মহৎ না করে আরো সঙ্কীর্ণমনা করে তোলে। তবে ভ্রমণের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান অধিক স্থায়ী ও কার্যকরী। আবার অনেকে শিক্ষার্জনের সময়টুকু কাটায় আহম্মকতায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একই সাথে দুই যাত্রী ঢাকা থেকে কক্সবাজার ভ্রমণ করে এলো। একজন আসা-যাওয়ার পথে ও কক্সবাজার এলাকার শিক্ষণীয় বিষয়গুলোর সুস্পষ্ট বিবৃতি দিল, কিন্তু অন্যজন কিছুই বলতে পারল না। তিনি আসা-যাওয়ার পথে ঘুমিয়েছেন বা শুধু ভ্রমণের জন্যই ভ্রমণ করেছেন। অথচ দুজনের একই সময় অতিবাহিত হয়েছে। একজন ভ্রমণটিকে নিয়েছেন শিক্ষণীয় হিসেবে। অন্যজন নিয়েছেন গতানুগতিক সময় অতিক্রম হিসেবে।
এভাবে জীবন চলার পথে কোনো সময় শিক্ষাও কাজে লাগানোর বাহিরে না হওয়া চাই। সময়ের প্রকৃত মূল্য অনুধাবনশীল ব্যক্তিদের জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কোষ্ঠকাঠিন্যতায় ভোগা ব্যক্তিকে করেছে জগৎবিখ্যাত। শৌচাগারের অধিক সময় অতিক্রান্ত হওয়া সময়কে পত্র-পত্রিকা পাঠ ও অন্যান্য কর্মে কাজে লাগানোর মধ্য দিয়ে। ইবনে বতুতা ইউরোপ, আফ্রিকা এবং এশিয়ায় ৭৫,০০০ মাইল পরিভ্রমণ করে হয়েছেন বিশ্ব পর্যটক। দীর্ঘদিনের দীর্ঘপথের পরিভ্রমণে ক্ষুধা-তৃষ্ণা, প্রাকৃতিক বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশ এবং ভয়ভীতি ইত্যাদি জানার আগ্রহ তাকে দমাতে পারেনি। যদিও তিনি কবি-সাহিত্যিক ছিলেন না, কিন্তু তার অনুসন্ধিৎসু ভ্রমণ শুধু কাহিনী নয়, বরং শিক্ষণীয় হিসেবে জগৎবাসী স্মরণ করে রেখেছেন। একটু চিন্তা করে দেখুন, আমাদের চলার পথের দীর্ঘ বা ক্ষুদ্র সময়ের ভ্রমণগুলো অন্যের জন্য না হোক, কতটুকু নিজের জন্য স্মরণীয় ও শিক্ষণীয় করে রাখতে পেরেছি। এমন তো আর নয় যে, ইবনে বতুতা আলাদা জগতের কোনো মানুষ ছিলেন বা স্বাভাবিকের চেয়ে দীর্ঘায়ু পেয়েছিলেন।
বাল্যকাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত স্ব-স্ব স্থান থেকে প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও অন্যান্য দায়িত্বের স্থান থেকে শত ব্যস্ততার মাঝেও সবটুকু কাজকে সঠিকভাবে আঞ্জাম দিতে পেরেছেন কিনা; খতিয়ে দেখা দরকার। আসলে কাজ করার জন্য প্রয়োজন কাজ করার মানসিকতা। এক্ষেত্রে সময়ের অজুহাত ফাঁকিবাজদেরই কাজ। সময় ব্যবস্থাপকের চাই দৈনন্দিন কার্যকর রুটিন, যা তৈরির ক্ষেত্রে অতি আবেগি না হয়ে ধীরে ধীরে কাজের ভার বেশি গ্রহণের মানসিকতা তৈরি করা। সাময়িক লাভজনক কিন্তু ভবিষ্যৎ অকল্যাণকর এমন কর্ম সম্পাদন সময়ের দাবি নয়।
অন্যের সফলতা ও মঙ্গল দেখে খুব বেশি হতাশ ও ঈর্ষান্বিত না হয়ে তার দৈনন্দিন সময় ব্যয়ের কার্যতালিকা দেখা যেতে পারে। নিজের প্রতিপক্ষ না ভেবে তার থেকে অর্জনীয় দিকগুলো গ্রহণ করা। হোক না তিনি সমবয়সী বা কম বয়সী কোনো লোক। হিংসাকে যত বেশি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, ততই মঙ্গলকর। হিংসা কোথাও বিজয় হলে সেখানে ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী।
মাঝে মাঝে নিজের জীবনে নষ্ট হওয়া ক্ষণগুলো একটু হলেও ভাবনায় নিয়ে আসা, এতে কিছুটা হলেও অনুশোচনা হওয়ার সাথে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অভিজ্ঞতালব্ধ উপদেশের বাণীও হতে পারে। প্রতিযোগিতার বাজারে প্রকৃত প্রতিযোগী কখনো শেষ মুহূর্তে এসে প্রস্তুতি গ্রহণ না করে বরং অন্য প্রতিযোগীদের ঘুমিয়ে রেখে তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সচেষ্ট হন।
সমাজ উন্নয়ন বা কোনো মিশন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অতিবাহিত হওয়া সময়টুকু সবচেয়ে বড় নিঃস্বার্থ দান। অপেক্ষাকৃত স্বার্থহীন ব্যক্তিগণ স্বীয় সময় ব্যয়ের জন্য পৃথিবীবাসীর নিকট অধিক স্মরণীয়, বরণীয় ও ভাস্বর হয়ে থাকবেন। বস্তুত নিঃস্বার্থ জনকল্যাণে ব্যয় হওয়া সময়টুকু স্বীয় কল্যাণেও আসে। কারণ বৃহৎ লক্ষ্য ক্ষুদ্র লক্ষ্যের স্বাধটুকুও মিটিয়ে দেয়। বৃহৎ স্বার্থে সময় দিতে যারা বিভিন্ন কৌশলে নিজেদেরকে আড়াল করে রাখে অনেক সময় খালি ঝুড়িও তাদের ভাগ্যে মেলে না। যা নিতান্তই নিজের, সমাজ ও জাতির সাথে ধোঁকার নামান্তর।
অনেকেই আবার সময়কে গালি দিতে খুব বেশি অভ্যস্ত, যা স্বয়ং ¯্রষ্টার সাথেও বাড়াবাড়ি। সময়ের দাবি অনুযায়ী সময় ব্যবস্থাপনার অভাবে অনেককেই স্বীয় কর্মের জন্য লজ্জিত ও লাঞ্ছিত হতে হয়। ভাগ্যকে দোষারোপ করা অজ্ঞতা বৈ কিছুই নয়। অনর্থক গল্প, গীবত-চোগলখুরিসহ অন্যের সমালোচনায় যে সময়টুকু ব্যয় হয়, বাৎসরিক সময়ের যোগফল থেকে তার বিয়োগফল বের করা দরকার। তাহলে হয়তো সময়ের সঠিক পরিমাপ ও গুরুত্ব বুঝতে কিছুটা হলেও সম্ভব হবে।
¯্রষ্টা প্রদত্ত সময় বিন্যাসÑ “যে রাত্রিকে বিশ্রাম ও দিনকে কর্মের” এর যতটুকু ব্যতিক্রম যারা করেছে, বিজ্ঞান কর্তৃকও প্রমাণিত তাঁরা শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবে নিজেরদের ততটুকু ক্ষতিই করেছে। সময় ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ¯্রষ্টার নীতির দিকে লক্ষ্য রাখা কল্যাণকর।
সময়ের ব্যবধানে অনেকেই হারিয়ে ফেলে আপনজনকে। একটু পেছনের দিকে তাকালেই দেখা যায়, শিশুকালে বেড়ে ওঠার সময় থেকে এখন পর্যন্ত কতজনের অবদান ছিল আমার জীবন সংগ্রামের সহযোগী হয়ে। হয়তো সৌজন্য আচরণের পরিবর্তে দাম্ভিক পদচারনা তাদের হৃদয়ে আঘাত হেনেছে বারবার। যে বান্দা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে জানে না, সে ¯্রষ্টার কৃতজ্ঞ বান্দাও হতে পারে না। সময়ের লাঞ্ছনা অপদস্থতা ছাড়া তার ভাগ্যে ভালো কিছু জোটে না। হোক তিনি বাহ্যত দৃষ্টিতে অনেক বড়। সময়ের ব্যবধানে অনেককে দেখা যায়, বাবা-মা, আপনাজনকে ছেড়ে আলাদা ভুবন তৈরি করতে, যা তার পরবর্তী প্রজন্মের জন্যও একটি বার্তা সময়ের উপযুক্ত জবাব দিতে। সেজন্য বাবা-মা, আত্মীয় ও পাড়া-প্রতিবেশীর সাথে কিছু সময় ব্যয়ের রুটিন থাকা দরকার। নিজের জীবনের বেড়ে ওঠার পেছনে আদর-¯েœহ, সহযোগিতা পাওয়া লোকগুলোর অবদানের জাবরকাটা, যা ব্যক্তিকে অপেক্ষাকৃত বিনয়ী ও কৃতজ্ঞ করে তোলে।
পৃথিবীকে যারা বরণ করে নিতে পেরেছেন, তারা সময়ের কাজ সময়মতোই করেছেন। সাময়িক শক্তি দিয়ে এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ উচিত হবে না, যার বেগ পোহাতে হবে যুগ থেকে যুগান্তর। আবার সাময়িক কষ্ট পরবর্তী বৃহৎ ক্লান্তি থেকে পরিত্রাণেরও রয়েছে উৎকৃষ্ট উদাহরণ। সময়ের অভিজ্ঞতা একজন ব্যবস্থাপকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। সেজন্য চাকরির বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষাগত যোগ্যতার চেয়ে কর্মবয়সের অভিজ্ঞতা প্রাধান্য পায় বেশি।
কথায় আছে, কারো বয়স বাড়ে না বরং কমে। বাস্তবতাও তাই। দৈনিক সময় চব্বিশ ঘণ্টা শুনতে অনেক লম্বা মনে হলেও গভীর মনোনিবেশে ঘড়ির কাঁটার দিকে একটু তাকিয়ে দেখুন টিক্ টিক্ করে সময় কত দ্রুত গড়ায়। তার মানে জীবন থেকে এ সময়গুলো পার হয়ে যাচ্ছে, যা সেকেন্ড থেকে মিনিট, ঘণ্টা, দিন, সপ্তাহ, মাস, যুগ ইত্যাদি নামে নামকরণ হয়ে থাকে। যে শিশুকে দেখলাম মায়ের কোলে কাতরায়, বছরখানেকের ব্যবধানে সে হাঁটে। কিছু দিন পরে তরতাজা যুবক-দাম্ভিক। যার ভয়ে এক সময় পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি বহির্বিশ্ব পর্যন্ত থরথরে কাঁপত। সে এখন এবলো-থেবলো, অবলা শিশুর মতো কাঁথার নিচে কাতরাচ্ছে। সময়ের বাস্তবতা বুঝেছেন মহাবীর আলেকজান্ডার। তিনি বলেছেন, মৃত্যুর পর দাফনের সময় আমার হাত দুটো উন্মুক্ত করে রাখবে। তাহলে মানুষ বুঝতে পারবে, যে ধনদৌলতের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছি মৃত্যুর সময় তা না নিয়ে খালি হাতেই চলে যেতে হচ্ছে।
যে ক্ষুদ্র জীবনের জন্য এত ব্যবস্থাপনা। তাহলে মৃত্যু পরবর্তী অনন্ত জীবন সাজানোর জন্য আলাদা সময় পাব কোত্থেকে? একজন প্রকৃত সময় ব্যবস্থাপক তার পার্থিব সময় ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে অনন্ত জীবনেরই প্রস্তুতি গ্রহণ করে থাকে।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন