বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বিস্ময়কর প্রতিভা বলে এক সময় মধুসূদনকেই মনে করা হতো, কারণ সাত-আট বছরের সাহিত্য-সাধনার দ্বারা, ১৮৫৯-১৮৬৬ সময়কালের মধ্যে, তিনি বাংলা ভাষাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। মহাকাব্য, সনেট, নাটক, প্রহসন, প্রবন্ধ, পত্রকাব্য, অমিত্রাক্ষর ছন্দ- কী বা আমদানি করেননি মধুসূদন বাংলা ভাষায়! মধুসূদন বিস্ময়কর, সন্দেহ নেই। কিন্তু মধুসূদনের চেয়েও বিস্ময়কর প্রতিভারূপে পরবর্তীকালে আবির্ভূত হন নজরুল। বাংলা ভাষায় নজরুলের আবির্ভাব ছিল জুলিয়াস সিজারের মতো : এলাম, দেখলাম এবং জয় করে নিলাম। অবশ্য নজরুল, সিজারের সাথে নয়, নিজেকে তুলনা করেছেন ধূমকেতুর সঙ্গে।
মধুসূদনের আবির্ভাব ঘটেছিল এমন এক সময়ে যখন বাংলা ভাষায় সাহিত্যের খরা চলছিল। মধুসূদনই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি মধ্যযুগীয় রোমান্টিক ঘেরাটোপ থেকে বের হয়ে এসে বাংলা সাহিত্যে আধুনিক কাব্যবোধ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তার যুগে বাংলা সাহিত্যাকাশে এমন কোনো নক্ষত্র ছিল না, যার তীক্ষè আলো চোখ ধাঁধিয়ে দিতে পারে কারো। সেটা ছিল এমন একটা আকাশ, যেখানে বহু দূরের তারার আলোও উজ্জ্বল হয়ে ধরা দেয়। কিন্তু নজরুলের যখন আবির্ভাব ঘটল, তখন বাংলা ভাষায় চলছিল রবীন্দ্রযুগ; রবির মধ্যাহ্ন-আলোয় সমস্ত চাঁদ-তারা, মোমবাতি, হেজাক, ধূপকাঠি লজ্জায় অবগুণ্ঠিত হয়ে গুটিসুটি মেরে পড়ে ছিল এখানে-সেখানে। যেদিকেই চোখ যায়, কেবলই রবীন্দ্র-রশ্মি। কবিতায় রবীন্দ্র; সঙ্গীতে রবীন্দ্র; নাটকে রবীন্দ্র; উপন্যাস কী ছোটগল্প, সেখানেও রবীন্দ্র; প্রবন্ধ কী শিশুসাহিত্যÑরবীন্দ্রনাথ সেখানেও। এক কথায়, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য তখন এমন একটা স্তরে এসে পৌঁছেছিল যে, কারো পক্ষে কল্পনাও করা কঠিন ছিল রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করে একদিন কেউ বীরের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে বাংলা ভাষায়।
এরকমই একটা পরিবেশে ধূমকেতুর মতো এসে বাংলার সাহিত্যজগতে উপস্থিত হন নজরুল। এক ‘বিদ্রোহী’ কবিতা দিয়েই তিনি সূর্যগ্রহণ লাগিয়ে দিলেন বাংলার আকাশে। মধ্যাহ্নের রবিকে পর্যন্ত ঢেকে দিলেন তিনি তার নিজস্ব ছায়ায়। বাঙালির কান শিহরিত হলো, দুচোখ ধাঁধিয়ে গেল এবং হৃদয় ফেটে পড়ল তীব্র আবেগে। বীরের গল্প তারা শুনেছে এতকাল, দু’চোখে দ্যাখেনি কখনও। নজরুল যখন হুঙ্কার ছাড়লেন :
বল বীরÑ
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি আমারি, নতশির ঐ শিখর হিমাদ্রির!
বল বীরÑ
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি
চন্ত্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি
ভূলোক দ্যুলোক গোলোক ভেদিয়া,
খোদার আসন আরশ ছেদিয়া,
উঠিয়াছিচির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর।
মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটিকা দীপ্ত জয়শ্রীর।
বল বীরÑ
আমি চির-উন্নত শির!
তখন বিস্ময়ে ও আনন্দে সবাই থ বনে গেল একেবারে। কবি নয়, এ যেন সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে রাক্ষস-খোক্ষসের দেশ অতিক্রম করে রণসজ্জায় সজ্জিত হয়ে আকস্মিক আবির্ভূত হওয়া এক বিস্ময়-যুবক। কী তাঁর ছন্দ, কী অন্ত্য্যমিল, কী নিপুণ শব্দের ঝঙ্কার, আরবি-ফারসি-বাংলা-সংস্কৃতের মিশ্রণে কি অপূর্ব এক ভিন্ন কাব্যভাষা! রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড় কবি বটে, কিন্তু তার কোনো কাব্যভাষা নেই। নজরুল তার প্রথম ভুবনমাতানো কবিতায় জানান দিয়ে গেলেন যে, সম্পূর্ণ আলাদা, নতুন এক কাব্যভাষা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন তিনি। অবশ্য নজরুলের মতো নিজস্ব কাব্যভাষা মধুসূদনেরও ছিল।
মধুসূদন ইংরেজি-সাহিত্য রচনা করা থেকে হাত গুটিয়ে নেন ১৮৫৬-৫৭ সালের দিকে। তার রচিত সর্বশেষ যে ইংরেজি কবিতাটি পাওয়া যায় সেটি ছিল শিরোনামহীন, মাদ্রাজের জনৈক মিথুনিয়াকে নিয়ে রচিত, লেখা হয় ২০ জুলাই ১৮৫৭ তারিখে। এর পর শুরু হয় তার বাংলাসাহিত্যের যুগ। শর্মিষ্ঠা নাটক (১৮৫৯) দিয়েই তার উত্থান এবং চতুর্দশপদী কবিতাবলী (১৮৬৬) দিয়েই তাঁর স্বর্ণযুগের অবসান। এরপরও তার কিছু সাহিত্যকর্ম থাকলেও সেগুলো উল্লেখযোগ্য নয়। মোটামুটি বলা যায়, ১৮৫৯ থেকে ১৮৬৬Ñএ সাত-আট বছরের সাহিত্যসাধনাই মধুসূদনকে অমরত্ব দান করেছে বাংলা ভাষায়। নজরুলের সাহিত্যযুগও মধুসূদনের মতো। যদিও বলা হয় বিশ বছরের মতো সাহিত্যসাধনা করে গেছেন নজরুল, বিষয়টা কিন্তু সেরকম নয় একটুও। নজরুলের তেজোদীপ্ত সাহিত্যের সময়কাল ১৯২২ থেকে ১৯৩০-এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এরপরও কিছু গ্রন্থ প্রকাশিত হলেও সংখ্যার দিক দিয়ে তত উল্লেখযোগ্য নয়। নজরুলের রচনাবলির প্রকাশকালের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
নজরুলের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ অগ্নিবীণা; প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালে; প্রকাশক আর্য্য পাবলিশিং হাউস, কলকাতা। ওই বছর অবশ্য তার একটি প্রবন্ধের বইও বের হয় যুগবাণী নামে। দোলনচাঁপা বের হয় ১৯২৩ সালে; ১৯২৪-এ বিষের বাঁশী ও ভাঙার গানÑ দুটো গ্রন্থই বাজেয়াপ্ত করে ব্রিটিশ সরকারÑ বিষের বাঁশীর বাজেয়াপ্তি প্রত্যাহার করা হয় ১৯৪৫-এ এবং ভাঙার গান-এর, ১৯৪৯-এ; ১৯২৫-এ প্রকাশিত হয় ছায়ানট, পুবের হাওয়া, চিত্তনামা ও সাম্যবাদীÑএক বছরে চারটি গ্রন্থÑবর্মণ পাবলিশিং হাউস, কলকাতা প্রকাশ করে ছায়ানট, ভোলার মুজিবুল হক বিকম পুবের হাওয়া, কলকাতার ডি এম লাইব্রেরি চিত্তনামা ও বেঙ্গল পাবলিশিং হাউস সাম্যবাদী; ১৯২৬-এ প্রকাশিত হয় দু’টি গ্রন্থÑ সর্বহারা ও ঝিঙেফুল; ১৯২৭-এ তিনটি গ্রন্থÑফণিমনসা, সিন্ধু-হিন্দোল ও সাতভাই চম্পা; ১৯২৮-এ জিঞ্জির ও নির্বাচিত কবিতা-সংকলন সঞ্চিতাÑ সঞ্চিতা অবশ্য দুটো প্রকাশনী থেকে বের হয়: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উৎসর্গিত সঞ্চিতা প্রকাশ করে ডি এম লাইব্রেরি, মিস ফজিলাতুন্নেসাকে উৎসর্গিত সঞ্চিতা বর্মণ পাবলিশিং হাউস; ১৯২৯-এ প্রকাশিত হয় চক্রবাক ও সন্ধ্যা; ১৯৩০-এ প্রলয়শিখা ও রবাইয়াৎ-ই-হাফিজ। এরপর দেখা যায় আকস্মিক গতি-ছেদ; পাঁচ বছর পর ১৯৩৫-এ বের হচ্ছে নির্ঝর, ১৯৪৫-এ নতুন চাঁদ, ১৯৫০-এ মরু-ভাস্কর, ১৯৫৫-এ সঞ্চয়ন, ১৯৫৮-এ শেষ সওগাত, ১৯৫৯-এ রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম, ১৯৬০-এ ঝড়, ১৯৬১-এ পিলে পটকা, পুতুলের বিয়ে, ১৯৬৪-এ ঘুম ভাঙানো পাখী ও ১৯৬৫-এ ঘুম পাড়ানী মাসী-পিসী; নজরুল অবশ্য তখন সৃজনীশলতার জগৎ থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে।
রবীন্দ্রনাথের মতো বিপুল কবিতা লিখে যেতে পারেননি নজরুল। তার কি দরকার ছিল আদৌ? বিশ্বের প্রথম শ্রেণির কবি যারা, তাদের শ্রেষ্ঠ কবিতার সংখ্যা কিন্তু বিপুল নয়। জনসংখ্যাবহুল বাংলাদেশে কবিরাও দেখি বিপুল সৃজনে মত্ত। হয়তো এদেশবাসীর প্রজনন ও সৃজন ক্ষমতার পেছনে এর মৃত্তিকার উর্বরাশক্তিই বহুলাংশে দায়ী। তবে পাগলেও বোঝে, সংখ্যা দিয়ে নয়, গুণগত মান দিয়েই সবকিছুর শ্রেষ্ঠত্ব নির্ণীত হয়। এখন দেখার বিষয়, নজরুলের কবিতার শ্রেষ্ঠত্ব কোনখানে। যদিও বুদ্ধদেব বসুর মতো অপরিপক্ব কবি ও হুমায়ুন আজাদের মতো অল্প-মেধাবী অধ্যাপকেরা নজরুলের কবিতার বিরূপ-সমালোচনায় নিজেদেরকে নিয়োজিত রেখেছেন সব সময়, তাতে নজরুলের কাব্য-খ্যাতি তিল পরিমাণও হ্রাস পায়নি কখনও; বরং বাংলাদেশ ছাড়িয়ে, বহির্বিশ্বে, রবীন্দ্রনাথের সাথে প্রতিযোগিতা করে, নজরুলের কদর বেড়েই চলেছে দিন দিন। এর একটাই কারণ, নজরুলের কবিতার অভূতপূর্ব ম্যাসেজধর্মিতা। সত্যি বলতে কী, নজরুলের কবিতায় সাম্যবাদ, মানবহিতৈষা এবং বার্ধক্য-জরাজীর্ণতা-কুসংস্কার-অশিক্ষা ও অজ্ঞতার বিরুদ্ধে যে বৈপ্লবিক রণহুঙ্কার উচ্চারিত হয়েছে, তার নজির বিশ্বে আর কোথাও নেই। দেশ, ধর্ম ও কালের গÐি অতিক্রম করে নজরুল কেবল মানুষরূপেই, বৈশ্বিক মানুষরূপে, নিজেকে মূর্ত করে তুলেছেন তার কবিতায়।
বাংলার খাঁটি বিশ্বকবিই হলেন নজরুল। নজরুলের এ বৈশ্বিক রূপটি তাজমহলের মতো মূর্ত হয়ে উঠেছে তার বিস্ময়কর কাব্যগ্রন্থ সাম্যবাদীতে। মাত্র এগারোটি কবিতার ছোট্ট এ গ্রন্থটি পারমাণবিক বোমার মতো শক্তিশালী। সাম্যবাদের এমন জোরালো ¯েøাগান আর কোনো কবির কণ্ঠে এর আগে উচ্চারিত হতে পৃথিবী কখনও শুনেনি। পৃথিবীর সব ধর্মের, সব বর্ণের, সব গোত্র ও শ্রেণির মানুষকে এক মনুষ্যত্বের বন্ধনে বেঁধে তিনি নির্মাণ করতে চেয়েছেন এক সাম্যবাদী সমাজ, যেখানে মানুষে মানুষে কোনো বৈষম্য থাকবে না। (অসমাপ্ত)
এ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাই ‘সাম্যবাদী’; কবিতাটি শুরু হয়েছে এক বৈপ্লবিক উচ্চারণ দিয়ে:
গাহি সাম্যের গানÑ
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রিশ্চান।
কবিতাটি শেষও হয়েছে এক অবিনশ্বর বাণী দিয়ে :
মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড়ো কোনো মন্দির-কাবা নাই।
‘ঈশ্বর’ কবিতায় কবি মানুষকে বনে-জঙ্গলে, পাহাড়ে-পর্বতে, আকাশে-পাতালে ঈশ্বর না খুঁজে মানুষের মধ্যেই ঈশ্বর খোঁজার পরামর্শ দিয়েছেন। কবি বলেন :
সকলের মাঝে প্রকাশ তাহার, সকলের মাঝে তিনি!
আমারে দেখিয়া আমার অদেখা জন্মদাতারে চিনি।
নজরুলের কবিতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, তার কবিতা মীর তকী মীর কিংবা আসাদুল্লাহ খাঁ গালিবের কবিতার মতো, প্রতিটা পঙক্তিই কবিতা, সমস্ত পঙক্তি মিলে এক কবিতা হয়ে ওঠার ব্যাপার-স্যাপার তার মধ্যে দুর্লভ, তার প্রতিটা উচ্চারণই অলৌকিক পুরুষের মতো, যার একটা শব্দও উপেক্ষা করবার জো নেই। এ গ্রন্থের বোধহয় শ্রেষ্ঠ কবিতা দুটি : ‘মানুষ’ ও ‘নারী’, যে কবিতা দু’টি পাঠ না করলে মানুষ আধুনিক সভ্যতার সারবত্তা অনুধাবন করতে পাররে না মোটেও। এলিয়টের ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ ইংরেজিতে রচিত বলেই বিশ্বের প্রায় সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য; নজরুলের এ দু’টি কবিতাও অনুরূপ অবশ্য-পাঠ্য হওয়ার দাবি রাখে; দুর্ভাগ্য যে, এগুলো আধুনিক সভ্যতার আলো থেকে অনেক দূরে, পরাধীন ভারতবর্ষের এক প্রান্তে, বঙ্গদেশে, বাংলায় রচিত হয়েছিল!
‘মানুষ’ কবিতায় কবি ধর্মের বিরোধিতা না করে ধর্মব্যবসায়ী ও কপট ধার্মিকদের মুখোশ খুলে দিয়ে জয়গান গেয়েছেন মানুষের। কবি বলেন :
গাহি সাম্যের গানÑ
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।
নজরুল যখন জনৈক ক্ষুধার্ত মানুষের মসজিদ ও মন্দির হতে বিতাড়িত হওয়ার করুণ কাহিনী বর্ণনা করার পর এভাবে বলেন :তব মসজিদ-মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবি,
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি!
কোথা চেঙ্গিস, গজনী-মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়?
ভেঙে ফেল ওই ভজনালয়ের যত তালা-দেওয়া-দ্বার!
তখন আমরা মর্ম-বেদনায় জ্বলি, সহমর্মিতায় ও মানবিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে একাত্মতা ঘোষণা করি তার সাথে, মনে হয় আমরাও চেঙ্গিস খানের মতো মুহূর্তে ভেঙে চুরমার করে দেই যত অনিয়ম-অবিচার, সমান করে দেই সভ্যতার যত উঁচু-নিচু, বিভেদ ও বৈষম্য।
‘নারী’ কবিতায় কবি প্রতিষ্ঠিত করেছেন নারী জাতির মর্যাদা। পৃথিবীর নারীবাদীরা সবাই মিলে যা করেছেন, নজরুল একাই তার চেয়ে বেশি করেছেন অবহেলিত-অপাঙক্তেয় নারী জাতির জন্য। নারীদের জন্য তিনি পুরুষের করুণা-অনুকম্পা নয়, চেয়েছেন পুরুষের সমান অধিকার। কবিতাটি শুরুই হয়েছে এই বলিষ্ঠ ঘোষণায়Ñ
গাহি সাম্যের গানÑ
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।
বিশ্বের যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
নারীর সপক্ষে তার যুক্তির শেষ নেই। সভ্যতার শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত নারীর অবদান তুলে ধরে তিনি পুরুষের বিরুদ্ধে উচ্চারণ করেছেন তার তীব্র ক্ষোভের কথা নারীদেরকে নিপীড়িত ও নিগৃহীত করে রাখার জন্য। কবি বলেন :
সে যুগ হয়েছে বাসি,
যে যুগে পুরুষ দাস ছিল না ক, নারীরা আছিল দাসী!
বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি,
কেহ রহিবে না বন্দী কাহারও, উঠিছে ডঙ্কা বাজি’।
নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে
আপনারি রচা ঐ কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে!
যুগের ধর্ম এইÑ
পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই!
কবি ‘নারী’ শেষ করেছেন এক বিস্ময়কর ভবিষ্যদ্বাণী দিয়ে, যা আধুনিক যুগে এসে আলোর মুখ দেখা শুরু করেছে; কবিরা যে ভবিষ্যত-দ্রষ্টা, নজরুলের কবিতায় তার মূর্ততা দেখে আমরা বিস্মিত হয়েছি বারবার। কবি বলেন :
সেদিন সুদূর নয়Ñ
যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়।
এ কাব্যগ্রন্থের বাকি কবিতাগুলোওÑরাজা-প্রজা, মিথ্যাবাদী, বীরাঙ্গনা, কুলি-মজুর, পাপ, চোর-ডাকাত, সাম্যÑএকই রকম তেজোদীপ্ত, একই রকম বৈপ্লবিক ঘোষণায় উজ্জ্বল। ভাষার সরলতার কারণে কোনো কোনো সমালোচক নজরুলকে তীক্ষèবাণে জর্জরিত করার চেষ্টা করেছেন। রবীন্দ্রনাথও তো সরল ভাষার কবি। যারা পৃথিবীর কাব্যজগতের খোঁজ-খবর রাখেন তারা জানেন, আদি কবি হোমার থেকে শুরু করে আধুনিককালের শ্রেষ্ঠ প্রায় সমস্ত কবির কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো সরলতা। সরলতা কোনো দোষ নয়, বরং এটা একজন সৃষ্টিশীল মানুষের দুর্লভ গুণ, যা তাকে মুক্তি দেয় সমস্ত কৃত্রিমতা থেকে ও দুর্বোধ্যতা থেকে। যে সাহিত্য মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়, তা কখনও জনপ্রিয় হয় না, ডাইনোসরের মতো বিশাল সৃষ্টি হলেও তা বিলুপ্ত হয়ে যায় অনিবার্যভাবে। নজরুল এ ধরনের কোনো কবি নন, কবি তিনি মাটি ও মানুষের, সমগ্র বিশ্বের। প্রত্যেক দেশের জাতীয় কবির মতো পৃথিবীরও যদি জাতীয় কবি থাকার প্রথা থাকত তাহলে তার জন্য উপযুক্ত হতেন একমাত্র নজরুল তার কবিতার মানবিক ও বৈশ্বিক আবেদনের কারণে, তা হলফ করে বলা যায়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন