এবিসিদ্দিক
বিশাল বাজেটের ব্যয় মেটাতে যথারীতি ঋণের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। দেশি ও বিদেশ উৎস থেকে ঋণ প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩৭ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ১ লাখ ৯৮ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ১ লাখ ৪২ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ ৪৪ হাজার ৫০৪ কোটি আর স্বল্পমেয়াদী ঋণ প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৯৮ হাজার ২৬৯ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের মূল বাজেটে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে মোট ঋণ প্রাপ্তি ধরা হয়েছিল ১ লাখ ৩৮ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা যা সংশোধিত বাজেটে কমিয়ে আনা হয় ১ লাখ ৩১ হাজার ৭৩১ কোটি টাকায়। ব্যাংক বহির্ভূত খাত থেকে নতুন বাজেটে ঋণ প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৫৬ হাজার ৪০ কোটি টাকা যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরের মূল বাজেটে ধরা হয়েছিল ৪৮ হাজার ৮৯৪ কোটি টাকা যা সংশোধিত বাজেটে বেড়ে দাঁড়ায় ৬০ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকায়। নতুন বাজেটে অভ্যন্তরীণ ঋণ পরিশোধে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ পরিশোধে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৫৯৪ কোটি আর স্বল্পমেয়াদী ঋণ পরিশোধে ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮৮ হাজার ২৪১ কোটি টাকা। ব্যাংক বহির্ভূত খাতের ঋণ পরিশোধ করার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৩ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। অনুদান ব্যতিত সামগ্রীক ঘাটতি ধরা হয়েছে প্রায় ৯৭ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা (জিডিপি’র ৫ শতাংশ যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ছিল ৩ দশমিক ৯ শতাংশ। প্রায় ২ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকার ঋণ নির্ভর এই বাজেটে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের বোঝা চাপানো হয়েছে জনগণের উপর। মোট রাজস্ব প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরের মূল বাজেটে ছিল ২ লাখ ৮হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা যা সংশোধিত বাজেটে ৩১ হাজার ৪৩ কোটি টাকা কমিয়ে ১ লাখ ৭৭ হাজার ৪০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। নতুন বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে রাজস্ব প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩ হাজার ১৫২ কোটি টাকা যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরের মূল বাজেটে ছিল ১ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ টাকা যা সংশোধিত বাজেটে কমিয়ে আনা হয় দেড় লাখ কোটি টাকা। নতুন বাজেটে আয় ও মুনাফা কর ধরা হয়েছে ৭১ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরের মূল বাজেটে ছিল ৬৪ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা পরে সংশোধিত বাজেটে ৫১ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকায় কমিয়ে আনা হয়। মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট বা মূসক) থেকে প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৭২ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরের মূল বাজেটে ছিল ৬৪ হাজার ২৬২ কোটি টাকা যা সংশোধিত বাজেটে ৫৩ হাজার ৯১৩ কোটি টাকায় কমিয়ে আনা হয়। রাজস্ব বহির্ভূত খাত থেকে রাজস্ব প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৭ হাজার ২৫০ কোটি, আর কর ব্যতিত রাজস্ব প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৩২ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। ভ্যাট ও আয়করের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং এই দু’টি খাত থেকে ৭০ শতাংশের বেশি রাজস্ব প্রাপ্তি ধরা হয়েছে। সরকারের ঋণ পরিশোধ ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরকে ভিত্তি ধরে গত ৯ অর্থবছরের ব্যবধানে সরকারের এ সুদ পরিশোধ ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৩৩ গুণ। বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে রেকর্ড পরিমাণ ঋণ নেয়া হয়েছে সঞ্চয়পত্র থেকে। সাধারণের অর্থ দিয়ে বাজেট ঘাটতি অর্থায়ন বেড়ে গেছে। অপর দিকে দাতাদের সাথে নানা টানাপড়েনে বৈদেশিক ঋণ কমে গেছে। এতে দুই ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে। প্রথমত. সরকারের ব্যাংক ঋণ সমন্বয়ের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে মুদ্রানীতিতে। ব্যাংকিং খাতও পড়েছে বেকায়দায়। দ্বিতীয়ত. সরকারের ঋণ পরিশোধ ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এতে সরকারের সামগ্রিক ঋণের পরিমাণও বাড়ছে। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন বাজেটে সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ব্যয় ছিল ৭ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণের সুদব্যয় ছিল ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। ৯ বছরের ব্যবধানে চলতি অর্থবছরের বাজেটে মোট সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় বেড়ে হয়েছে ৯৩৫ হাজার ১০৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৩ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ হিসেবে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ব্যয় ৯ বছরে বেড়েছে ৩ হাজার ২৫২ শতাংশ বা প্রায় ৩৩ গুণ। আর বৈদেশিক ঋণের সুদ ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৩২ শতাংশ। অস্বাভাবিক হারে সরকারের সুদ ব্যয় বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো তিনটি। প্রথমত দাতা সংস্থাগুলোর সাথে নানা টানাপড়েনের কারণে বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে সরকার বৈদেশিক ঋণ সহায়তা কম পাচ্ছে। এ কারণে বাজেট ঘাটতি অর্থায়ন বৈদেশিক ঋণ নির্ভরতা কমে গেছে। দ্বিতীয় কারণ হলো, বৈদেশিক ঋণসহায়তা কমে যাওয়ায় বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে অভ্যন্তরীণ ঋণের ওপরই নির্ভরশীলতা বেড়েছে। যেখানে বৈদেশিক ঋণের সুদ পাওয়া যায় ১ শতাংশেরও কম সুদে সেখানে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নিতে ১১ পর্যন্ত পর্যন্ত ব্যয় করতে হচ্ছে। তৃতীয় কারণ হলো, ব্যবসা বাণিজ্য মন্দার কারণে ব্যাংকের ঋণচাহিদা নেই বললেই চলে। ঋণ স্থবিরতার কারণে ব্যাংকগুলো আমানত সংগ্রহে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছে। আগে যেখানে ১০০ টাকা আমানত নিতে ব্যাংকগুলোর ১৪ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করতে হতো, সেখানে এখন তা ৭ শতাংশে নেমে গেছে। মূল্যস্ফীতির সাথে তুলনা করলে আমানতকারীদের ব্যাংক থেকে আয় ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। কিন্তু সঞ্চয়পত্রের সুদহার এখনো ১১ শতাংশের ওপরে রয়েছে। মানুষ ব্যাংক থেকে আমানত তুলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছে। ফলে অস্বাভাবিক হারে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বেড়ে গেছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নেয়ার কথা ছিল প্রায় সাড়ে ৫৬ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে সাড়ে ৩৮ হাজার কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ৮ মাসেই নেয়া হয়েছে ২৩ হাজার কোটি টাকার ওপরে। সঞ্চয়পত্র থেকে অধিক হারে ঋণ নেয়ার কারণ হলো দেশের চলমান বিনিয়োগ মন্দা। বিদ্যুৎ, গ্যাস সঙ্কটসহ অবকাঠামো সুবিধার অভাব দীর্ঘ দিনের। এর সাথে রয়েছে চলমান অনিশ্চয়তা ও আস্থার সঙ্কট। বিশেষ করে ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসের তৎকালীন প্রধান বিরোধীদলহীন নির্বাচনের পর থেকেই এ অনিশ্চয়তা শুরু হয়, যা আজো বিনিয়োগকারীদের তাড়া করে ফিরছে। এতে ব্যাংকের বিনিয়োগ স্থবিরতা দীর্ঘ মেয়াদে রূপ নিয়েছে। দীর্ঘ দিন যাবত কাক্সিক্ষত হারে নতুন বিনিয়োগ চাহিদা না থাকায় ব্যাংক আমানত সংগ্রহে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ে। ব্যাংকের আমানতের সুদের হার অস্বাভাবিক হারে কমে যাওয়ায় মানুষ ব্যাংকে আর নতুন করে আমানত না রেখে সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এর ফলে রেকর্ড পরিমাণ সঞ্চয়পত্রে বিক্রি বাড়ছে।
লেখক : সাংবাদিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন