মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউজে গত সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের অধিকার হরণ প্রসঙ্গে বেশ কিছু অভিযোগ করেছিলেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া সাহা। যা নিয়ে পরবর্তীতে দেশের বিভিন্ন মহলে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়।
রোববার ‘বিবিসি বাংলা’র প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রিয়া তার বক্তব্যে– দেশে সংখ্যালঘুদের নির্যাতন প্রসঙ্গে বেশ কিছু তথ্য উত্থাপন করেন। যেখানে তিনি দেশ থেকে তিন কোটি ৭০ লাখ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নিখোঁজ হয়েছে বলে উল্লেখ করেন।পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে প্রিয়া সাহার এমন অভিযোগের ভিডিও ফুটেজ মুহূর্তের মধ্যে সোশাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়ে যায়। যা দেখে বাংলাদেশে সরকারি মন্ত্রী, রাজনৈতিক, পুলিশ কর্মকর্তা ছাড়াও বিভিন্ন স্তরের জনগণ তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন।
তাদের অনেকের দাবি, সম্পূর্ণ উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে সেই হিন্দু নেত্রী বিদেশে গিয়ে মিথ্যা অভিযোগ করেছেন। এতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। যে কারণে তার বিরুদ্ধে এখন দেশদ্রোহিতার অভিযোগে বিভিন্ন মহল থেকে মামলা দেওয়ার দাবিও উঠছে। যদিও সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলনকারী এই নেত্রীকে আত্মপক্ষ সমর্পণের আগে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের না করতে সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বর্তমানে ব্রিটেনে সফররত বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ দিকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ওয়াশিংটনে প্রিয়া সাহা যে অভিযোগ তুলে ধরেছেন- তা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, হোয়াইট হাউস কিংবা মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ঠিক কতটা আমলে দিতে পারে? এবার এ বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে জনমনে।
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের এএন্ডএম ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সমাজ ও রাজনৈতিক বিভাগের অধ্যাপক মেহনাজ মোমেন বলেন, ‘আমেরিকা ঠিক কোন কথাকে গুরুত্ব দেবে; আর কি দেবে না তা সম্পূর্ণই নির্ভর করছে পরিস্থিতির ওপর।’ তিনি বলেন, ‘অভিযোগ যদি এমন দেশ বা অঞ্চল থেকে আসে যেখানে আমেরিকার বিশেষ স্বার্থ রয়েছে, মূলত তখন সেই অভিযোগের গুরুত্বও অন্য রকম হয়।’ উদাহরণ স্বরূপ টেক্সাসের এ অধ্যাপক বলেন, ‘ইরাক যুদ্ধ শুরুর আগে দেশটির নাগরিকরা তাদের অত্যাচার নির্যাতন প্রসঙ্গে কোনো অভিযোগ করলেই তখন সেগুলো রেডিও, টিভি, সংবাদপত্রে ফলাও করে প্রচার হতো। তখন সে সব অভিযোগ দিয়ে ইরাক যুদ্ধকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা হয়েছিল।’
এর আগে পঞ্চাশের দশকে কিউবা থেকে সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে অভাব-অভিযোগ ফলাও করে প্রচার করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। তবে এখন বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে সম্পর্ক রয়েছে তাতে সংখ্যালঘু নির্যাতন ইস্যুতে প্রিয়া সাহার অভাব-অভিযোগ তেমন কোনো গুরুত্ব পাবে না বলে দাবি এ অধ্যাপকের। মেহনাজ মোমেন বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক আমি বলবো এখন বেশ স্থিতিশীল। সুতরাং প্রিয়া সাহার অভিযোগকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তেমন কোনো গুরুত্ব দেবেন সে সম্ভাবনা অনেকটা ক্ষীণ।’ তার মতে, ‘বাংলাদেশ হয়তো শব্দটি তার পরিচিত বলে প্রেসিডেন্ট প্রিয়া সাহার কথাগুলো শুনেছেন... ফটো দেখে হয়তো মনে হতে পারে তিনি অন্যদের কথা মন দিয়ে শুনছেন; কিন্তু আমার মনে হয় না এর কোনো ধারাবাহিকতা থাকতে পারে।’
হোয়াইট হাউসে আয়োজিত যে অনুষ্ঠানে প্রিয়া সাহা বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের অধিকার ইস্যুতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, সেখানে বিশ্বের মোট ২৭টি দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
সমাজ ও রাজনৈতিক বিভাগের অধ্যাপক মেহনাজ বলেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আমেরিকা সামরিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক দিক থেকে বিশ্বের প্রধান ক্ষমতাধর দেশে পরিণত হয়েছে। যে কারণে মানুষজন এখনো সেখানে গিয়ে নিজেদের অভাব অভিযোগ করেন।’ অধ্যাপক মোমেন বলেন, ‘এটা অনেকটা রেওয়াজ হয়ে গেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও সেই রেওয়াজ পালন করেছেন মাত্র। তার শাসনামলে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই যেভাবে সংখ্যালঘুদের ওপর হেনস্থা বাড়ছে, যেভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বাড়ছে তাতে মানবাধিকার বিষয়ে আমেরিকার অবস্থানের গুরুত্ব দিন দিন হ্রাস পেয়েছে।’
যদিও যুক্তরাষ্ট্রে প্রিয়া সাহার অভিযোগ প্রসঙ্গে বাংলাদেশে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে অধ্যাপক মোমেন এর ব্যাপক সমালোচনা করেন। টেক্সাসের এ অধ্যাপকের মতে, ‘প্রিয়া সাহা যে সংখ্যা বলেছেন তা হয়তো অতিরঞ্জিত হতে পারে, তবে এটা তো সত্যি যে বাংলাদেশে এখনো সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন... আন্তর্জাতিক ফোরামে যে এটা এভাবে উঠল এটা লজ্জাজনক, দুঃখজনক। এর শুভ সমাপ্তি হবে যদি এইসব ঘটনা আরও কমে আসে এবং শেষ হয়।’ সূত্র: বিবিসি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন