এ সপ্তাহে লেখার বিষয় কী? এ প্রশ্নের জবাবে দেশের অধিকাংশ মানুষের যে উত্তর আসবে তা অবশ্যই ‘প্রিয়া সাহা’। যে বাংলাদেশ সারা পৃথিবীতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আদর্শ রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে, সেই বাংলাদেশ সম্পর্কে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান ঐক্য পরিষদের এককালের নেত্রী প্রিয়া সাহা সম্প্রতি যে জঘন্য মিথ্যা বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে বাংলাদেশের জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল মহলকেই শুধু বিস্মিত নয়, বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে। অবিলম্বে তার বিচারের দাবি উঠেছে বিশ্বে দেশের মর্যাদা ক্ষুণœকারী মন্তব্যের কারণে।
দৈনিক ইনকিলাবে সম্প্রতি প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত খবরের প্রধান শিরোনাম ছিল: “প্রিয়া সাহা কাÐে তোলপাড়’। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এ সম্পর্কে যে বক্তব্য দেন, তার শিরোনাম ছিল : ব্যবস্থা নিতেই হবে। শাসক দলের অন্যতম নেতা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ সম্পর্কে সাংবাদিকদের বলেন, অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হলে ব্যবস্থা। প্রতিবেদনে বলা হয়, সংখ্যালঘুদের নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে করা অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মানুসারীদের ওপর অন্যায় অত্যাচার চলছে, বহু ভিন্ন ধর্মাবলম্বী দেশ থেকে গুম হয়ে গেছেÑ এই মর্মে প্রিয়া সাহা যে বক্তব্য দিয়েছেন তা মিথ্যা ও বানোয়াট। এ বক্তব্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে বক্তব্য দিয়ে বলেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরÑ তার এ বক্তব্য রাষ্ট্রদোহী। দেশদ্রোহী হিসেবে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। দৈনিক ইনকিলাবে গত সোমবার প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল : ‘প্রিয়া সাহার খুঁটির জোর কোথায়’? এ প্রশ্নবোধক প্রতিবেদনের জবাব ঐ পত্রিকায় ঐ দিনেই পাওয়া যাবে যেখানে শাকক দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একটি সেমিনারে বলেনÑ ‘তড়িঘড়ি করে ব্যবস্থা নয়’।
যে ওবায়দুল কাদের এর আগে বলেছিলেন, ‘ব্যবস্থা নিতেই হবে’, হঠাৎ করে রাতারাতি তিনি এতটা উল্টো বক্তব্য দিতে গেলেন কেন, এর কারণ খুঁজতে গেলেই পাওয়া যাবে এর রহস্য। প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন এ সম্পর্কে তাড়াহুড়া করে প্রিয়া সাহার বক্তব্য শোনার আগে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করতে। প্রধানমন্ত্রীর এ মনোভাবের প্রমাণ মেলে দেশের বিভিন্ন আদালতে প্রিয়া সাহার দেশদ্রোহীমূলক বক্তব্যের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ খারিজ হওয়া থেকেও। এর অর্থ হলো : প্রিয়া সাহা দেশ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে যত ক্ষতিকর বক্তব্যই দেন, তার কোনো বিচার করা চলবে না।
এ দিকে প্রিয়া সাহার বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক বৈষম্য ও অন্যায় অত্যাচার প্রভৃতি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র এবং তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, প্রিয়া সাহার বক্তব্যের পেছনে রয়েছে মার্কিন দুরভিসন্ধি...।
তিনি বলেন, এর পেছনে একটা কারণই চিন্তা করা যায়, আর তা হলো মানবিকতার দোহাই দিয়ে আমাদের এই অঞ্চলে সেনা অভিযানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। তবে সজীব ওয়াজেদ জয় তাঁর এ বক্তব্যের সপক্ষে কোনো যুক্তি বা তথ্য প্রদান করেননি বা দিতে পারেননি। ফলে তার এ বক্তব্যকে তাঁর উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত কল্পনা বলে জনগণ মনে করতে বাধ্য।
আসলে সেনা অভিযানের যে আশঙ্কা থেকে সজীব ওয়াজেদ জয় এ ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন, তার লক্ষ্য হচ্ছে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু রাখা। যদি কঠোর বাস্তবতার আলোকে বর্তমান পরিস্থিতির বিচার করা যায়, তাহলে আমরা কী দেখব? দেখব যে, আওয়ামী লীগের বর্তমান শাসনামলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গণতন্ত্র।
সংবাদপত্র পাঠকদের মনে থাকার কথা, অতীতে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আমলে দেশের সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে মাত্র একটি সরকারি দল রেখে একদলীয় বাকশালী ব্যবস্থা চালু করেছিল আওয়ামী লীগ। এরপর কিছু দুঃখজনক ঘটনার মধ্য দিয়ে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনরায় চালু হলেও একপর্যায়ে একটি নির্বাচিত সরকারকে সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে বসেন তদানীন্তন সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তখন সারা দুনিয়াকে অবাক করে দিয়ে সেই সামরিক ক্যুর প্রতি সমর্থন দিয়ে বসেন আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা।
এরপর শুরু হয় জেনারেল এরশাদের দীর্ঘকালীন সেনা শাসন। বিএনপি ও অন্যান্য দল এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলেও আওয়ামী লীগ বহু দিন পর্যন্ত এসব আন্দোলন থেকে দূরে থাকে। ফলে রাজনীতিতে নবাগতা বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়ার মাধ্যমে আপসহীন নেত্রী হিসেবে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করতে সক্ষম হন।
এ পটভূমিতে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা এরশাদবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ শুরু করেন। এরপর একপর্যায়ে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে দেশে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচন দেয়ার প্রশ্নে একমত হন আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় সে লক্ষ্যে দুই নেত্রী এ ব্যাপারেও একমত হন যে, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন অস্থায়ী তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে।
যেমনটা আশা করা গিয়েছিল, নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়। সেই নির্বাচন চলাকালে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে একপর্যায়ে বলেন, আমি সকল জেলার খবর নিয়েছি। নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হচ্ছে। আপনারা লক্ষ রাখবেন, ভোটে হেরে গিয়ে এর মধ্যে কেউ যেন আবার কারচুপি আবিষ্কার না করে। এরপর ভোট গণনা শেষে যখন জানা গেল, আওয়ামী লীগ নয়, নির্বাচনে জয়লাভ করেছে বিএনপি। আওয়ামী নেত্রী অবলীলাক্রমে বলে ফেললেন, নির্বাচনে সূ² কারচুপি হয়েছে। তবে এ কথায় সংশ্লিষ্ট কেউ গুরুত্ব না দেয়ায় স্বাভাবিক নিয়মে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকার গঠন করেন এবং আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা হন সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী। বেগম খালেদা জিয়ার প্রধান মন্ত্রিত্বের মেয়াদ শেষে প্রধানত বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার দাবির মুখে দেশের সকল জাতীয় নির্বাচন অরাজনৈতিক অস্থায়ী তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবেÑ এই মর্মে সংবিধান সংশোধিত হয়।
বাংলাদেশের বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই ব্যবস্থাই যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধিক উপযোগী তা বাস্তবে প্রমাণিত হলো। ফলে দেশের দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বেশ কয়েকবার পালাক্রমে নির্বাচিত হয়ে দেশ চালনার সুযোগ লাভ করে। কিন্তু কিছুসংখ্যক রাজনীতিবিদের অতিরিক্ত ক্ষমতা-ক্ষুধার কারণে এই সুন্দর ব্যবস্থাটিকেও একপর্যায়ে পচিয়ে ফেলা হয়। একপর্যায়ে আওয়ামী লীগের শাসনকালে সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের পরিবর্তে পুনরায় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা চালু করা হয়।
দুই প্রধান দলের মধ্যে সমঝোতার প্রতি অসম্মান দেখানোকে বিএনপি বিশ্বাসঘাতকতা আখ্যা দিয়ে সে নির্বাচন বয়কট করে। বিএনপির বয়কটের ফলে সে নির্বাচন নির্বাচনী প্রহসনে পরিণত হয়। বিরোধী দল বিএনপির নেতাকর্মীরা তো দূরে থাক, সরকারি দল আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীও ভোটদানের জন্য ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার গরজ অনুভব করেননি। কারণ, তারা জানতেন বয়কটজনিত কারণে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের অনুপস্থিতির সুযোগে শাসক দলের অল্পসংখ্যক নেতাকর্মী শাসক দলের প্রার্থীদের ব্যালটে বেশি বেশি সিল মেরে তাদের অকল্পনীয়ভাবে বিপুল ভোটে বিজয় লাভের সুযোগ করে দেন।
এর ফলে দেশে অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনের সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়। প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার জন্য ক্ষমতাসীন দল যে লজ্জাবোধ করবে, তাও দেখা যায়নি। বরং সংসদে বক্তৃতাকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একপর্যায়ে বলেন, বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় এক হিসাবে ভালোই হয়েছে। সংসদে তাদের আবোল-তাবোল বক্তব্য শুনতে হচ্ছে না। বিরোধী দলের নির্বাচিত সদস্যদের বক্তব্য যাদের দৃষ্টিতে আবোল-তাবোল বক্তব্য বলে অনুভূত হয় তারা যে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নন, সে কথা বলাই বাহুল্য। কারণ, শুধু জনগণের অধিকাংশ সমর্থন লাভের নাম গণতন্ত্র নয়। গণতন্ত্রে সরকারবিরোধী জনগণের মতামতের যথাযথ মূল্যায়ন একেবারেই অবশ্যম্ভাবী। যতদিন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এই মনোভাবে বিশ্বাসী না হবেন এবং বাস্তবে তার প্রমাণ না দিতে পারবেন, ততদিন আওয়ামী লীগ একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে দাবি করতে পারবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন